বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

বিভ্রান্তির বেড়াজালে - কুরবানি


বিভ্রান্তির বেড়াজালে - কুরবানি

 
আরিফিন হক ॥ যার টাকা আছে তার জন্য নির্দিষ্ট দিনে পশু জবাই করা বাধ্যতামূলক এমন কোন নির্দেশনা কুরআনে নেই। কুরআন পূর্ণ মীমাংসা (১০:৩৭),  এতে কোন সন্দেহ নেই (১০:৩৭) এবং সর্বোপরি যেহেতু 'আকাশে ও পৃথিবীতে এমন কোন রহস্য নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে লেখা নেই' (২৭:৭৫) সেহেতু আল্লাহর নৈকট্য লাভে কুরআন ভিন্ন অন্য কোন উৎসের তালাশ করা জ্ঞানময় কিতাবের আয়াতকে অবমাননা করার শামিল।

এতদসত্ত্বেও, ফতোয়া জারী করা হয়েছে যে, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়ষ্ক মুসলিম (পুরুষ অথবা নারী), যার প্রাত্যহিক চাহিদা ও খরচ বাদে ৬১৩.৩৫ গ্রাম রূপা (প্রায় ৯০হাজার টাকা) বা সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি স্বর্ণ বা তার সমমূল্য পরিমাণ অর্থ অথবা সম্পদ উদ্ধৃত থাকে তার উপর পশু জবাই ওয়াজিব হবে। (আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫)।

এটি স্পষ্ট যে উক্ত বিধান ফতোয়া দাতার, পরমজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালার নয়। আল্লাহর বাণী জ্ঞানময় কুরআনে এমন কোন ইঙ্গিতও নেই যা থেকে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে। যারা আল্লাহর বাণী অনুসারে বিধান দেয় না তাদের সম্পর্কে কুরআনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে - “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই কাফের, ফাছেক ও জালেম। (কুরআন ৫ : ৪৪, ৪৫, ৪৭ এর শেষ অংশ )। কোন ব্যক্তির সিদ্ধান্ত বা ব্যাখ্যা মানতে কুরআনিক মুসলিম বাধ্য নয়। কিন্তু কুরআনিক মুসলিম কুরআন মানতে বাধ্য। অথচ, অধিকাংশ মানুষ এখন আর কুরআন বুঝার চেষ্টা করে না। মানুষ এখন মেতে আছে ফতোয়া নিয়ে। অধিকাংশ মানুষই কুরআন অনুসরণ করে না, অনুসরণ করে ফতোয়াবাজ মুফতিদের। ফতোয়াবাজদের প্রতাপে বিবেক বুদ্ধির প্রয়োগও হারিয়ে ফেলছে অনেকে।

ফতোয়াবাজদের মতে পশু জবাই করা সুন্নতে মুআক্কাদা, মতান্তরে ওয়াজিব, মতান্তরে এমন একটা সুন্নত যা পালন না করলে আল্লাহ কোন শাস্তি দেবেন না। পশু জবাই সম্পর্কিত এসব বিতর্কিত ফতোয়া এসেছে রসুল (সা.)-এঁর ওফাতের প্রায় ৩০০ বছর পর রচিত হাদিসের ভিত্তিতে। হাদিস বিশেষজ্ঞরা হাদিসগুলোকে ছহীহ (বিশুদ্ধ), হাসান (ভালো), যঈফ (দুর্বল), মুরসাল (সাহাবী বিহীন সনদ), মনকাদি (সংযোগ বিচ্ছিন্ন), জাল ইত্যাদি নানাভাবে বিভক্ত করেছেন। হাদিস বিশেষজ্ঞগণ নিজেরোই দুর্বল ও জাল হাদিসের অস্তিত্ব স্বীকার করেন এবং দুর্বল ও জাল হাদিসকেও তারা হাদিস হিসেবেই আখ্যায়িত করেন।

কুরআন মহানবী (সা.) এঁর সময়েই লিখিত আকারে সংরক্ষিত ছিল, কণ্ঠস্থ ছিল অনেক সাহাবির। তাই ইসলামের শত্রুরা কুরআনে হাত দিতে পারেনি। কিন্তু নবী করীম (সা.) এঁর হাদিস লিখিত আকারে ছিল না। এই সুযোগে ইসলামের শত্রুরা ও মুসলিম নামধারী বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল জাল হাদিস লিখে হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম করেছে এবং ইসলামকে বিতর্কিত করেছে। এখন অবস্থা এতোই খারাপ যে, 'এমন আলিম প্রাপ্তি পশ্চিমা ডলফিন প্রাপ্তির চেয়েও দুর্লভ হয়ে পড়েছে যারা জাল হাদিস চিহ্নিত করে ইসলামকে বিতর্কমুক্ত করবে'। [ সূত্র : ইমাম ইবনুল জাওযী, সিলসিলাতুল আহাদীছ আয-যাঈফাহ ওয়াল মওযূআহ ১/৪১]।

ইমাম ইবনুল জাওযীর যুগেই যেখানে জাল হাদিস চিহ্নিতকরণে পন্ডিতদের অভাব ছিল, সেখানে বর্তমান যুগে এ অভাব আরও তীব্র হওয়াই স্বাভাবিক। তাই সারা বিশ্বে এখন যঈফ ও জাল হাদিসের ছড়াছড়ি। খতিব, ওয়ায়েয, প্রবন্ধকার, তথাকথিত মুহাদ্দিস সকলের মুখে যঈফ ও জাল হাদিস শুনা যায় প্রতিনিয়ত।

আমরা বুখারি, মুসলিম, আবুদাউদ, নাসাঈ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ এসব ইমামদের হাদিস গ্রন্থগুলিকে ছিহাহ সিত্তাহ বলে থাকি। যার অর্থ হাদিসের ছয়টি ছহীহ কিতাব। আসলে কি এ ছয় খানি কিতাবই ছহীহ হাদিসের কিতাব? নিবিড় পাঠে দেখা যায়, সব হাদিসের কিতাবেই যঈফ ও জাল হাদিস রয়েছে। হাদিসের সংকলকগণও তাদের কিতাবগুলোকে ছহীহ হিসেবে নামকরণ করেননি। মুহাদ্দিস আলবানি প্রণীত চারটি যঈফ গ্রন্থে প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যে,  নাসাঈতে যঈফ হাদিসের সংখ্যা ৪৪০ টি, আবু দাউদে যঈফ হাদিসের সংখ্যা ১১২৭ টি, তিরমিযিতে যঈফ হাদিসের সংখ্যা ৮২৯ টি, ইবনু মাজাহ্‌তে যঈফ হাদিসের সংখ্যা ৯৪৮টি। উক্ত ৪টি গ্রন্থে মোট ৩৩৪৪ টি যঈফ হাদিস রয়েছে। আল্লামা জামালুদ্দীন ক্বাসেমি বলেন - ইমাম বুখারি, মুসলিম, ইয়াহ্‌ইয়া ইবনে মঈন, ইবনুল আরাবি, ইবনে হাযম এবং ইবনু তাইময়াহ প্রমুখ মনীষীগণের মতে ফযীলত কিংবা আহকাম কোন ব্যাপারেই যঈফ হাদিস আমল যোগ্য নয়। [সূত্র : ফাওয়ায়েদুত্‌, তাহদিস পৃষ্ঠা-৯৫]।

যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যা হাদিস প্রচার করে তার ঠিকানা জাহান্নাম। অথচ কোরবানি বিষয়ে আমাদের দেশে যে সব হাদিসের প্রচলন রয়েছে তার অধিকাংশই জাল। ওয়ায়েজ, মুফতি এবং বিভিন্ন প্রবন্ধকারও এসব জাল হাদিসের উদ্বৃতি দিয়ে প্রবন্ধ লেখেন যা অতি জঘন্য অপরাধ। শায়খ মুহাম্মদ নাছিরুদ্দীন আলবানী তাঁর “মিশকাতে বর্ণিত যঈফ ও জাল হাদিসসমূহ গ্রন্থে  কোরবানি বিষয়ক কিছু জাল হাদিসের উল্লেখ করেছেন এবং সূত্র দ্ধারা এসব জাল ও ভিত্তিহীন হাদিসকে অনুসরণ না করার জন্য যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। হাদিসের নামে মিথ্যাচার ও জঘন্য অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার জন্য শায়খ মুহাম্মদ নাছিরুদ্দীন আলবানী'র গ্রন্থে উল্লেখিত কোরবানি বিষয়ক যঈফ ও জাল হাদিসগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো -

১. জাবের (রা.) বলেন, রসুল (সা.) এক কোরবানির দিনে দু'টি ধূসর রংয়ের শিংওয়ালা খাসী দুম্বা জবেহ করলেন এবং যখন ওদের কেবলামুখী করলেন তখন বললেন, 'আমি আমার চেহারাকে ফিরে নিলাম তাঁর দিকে যিনি নিজেকে ইব্রাহিম (আ.)-এঁর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত করেন; আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। উপরন্তু আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবই জগৎ সমূহের প্রতিপালক আল্লাহ্‌র উদ্দেশে। তাঁর কোন শরীক নেই। আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি মুসলিমদের অন্তর্গত। হে আল্লাহ! আপনার পক্ষ হতে প্রাপ্ত এবং আপনারই জন্য উৎসর্গিত। কবুল করুন মুহাম্মদের পক্ষ হতে এবং তার উম্মতগণের পক্ষ হতে। অতঃপর রসুল (সা.) বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবর' বলে জবেহ করলেন। (আবুদাঊদ হা/২৭৯৫; ইবনু মাজাহ হা/৩১২১; মিশকাত হা/১৪৬১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৭৭, ৩/২২৩ পৃষ্ঠা)।

২. হানাশ (রহ.) বলেন, আমি আলীকে দু'টি দুম্বা কোরবানি করতে দেখলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, এই কি? তিনি উত্তর করলেন, রসুল (সা.) আমাকে ওছিয়ত করে গেছেন, আমি যেন তাঁর পক্ষ হতে কোরবানি করি। সুতরাং আমি তাঁর পক্ষ হতে (একটি) কোরবানি করছি। (আবু দাঊদ হা/১৭৯০; তিরমিযী হা/১৪৯৫; মিশকাত হা/১৪৪২; তাহক্বীক, সনদ হা/৮৪৩)।

৩. আলী (রা.) বলেন, রসুল (সা.) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন চোখ ও কান উত্তম রূপে দেখে নেই এবং আমরা যেন যে পশুর কানের অগ্রভাগ কাটা গিয়েছে, যার কানের শেষ ভাগ কাটা গেছে অথবা যার কান গোলাকারে ছেদিত হয়েছে বা যার কান পাশের দিকে ফেড়ে গিয়েছে তার দ্বারা  কোরবানি না করি। (আবু দাঊদ হা/২৮০৪; তিরমিযী হা/১৪৯৮; মিশকাত হা/১৪৬৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৭৯, ৩/২২৪ পৃষ্ঠা) ।

৪. আলী (রা.) বলেন, রসুল (সা.) নিষেধ করেছেন, আমরা যেন শিং ভাঙ্গা ও কান কাটা পশু দ্বারা কোরবানি না করি। ( যঈফ ইবনে মাজাহ হা/৩১৩৫; যঈফ তিরমিযী হা/১৫০৪।)

৫. আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি , ছয় মাস পূর্ণ ভেড়া উত্তম কোরবানি। (তিরমিযী হা/১৪৯৯; মিশকাত হা/১৪৬৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৮৪, ৩/২২৬)।

৬. আয়েশা (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিনে বনী আদম এমন কোন কাজ করতে পারে না যা আল্লাহ্‌র নিকট রক্ত প্রবাহিত করা অপেক্ষা প্রিয়তর। কোরবানির পশুর শিং, পশম ও খুরসহ ক্বিয়ামতের দিন হাজির হবে এবং কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহ্‌র নিকট সম্মানের স্থানে পৌঁছে যায়। (তিরমিযী হা/১৪৯৩; মিশকাত হা/১৪৬৮; মিশকাত হা/১২৮৬, ৩/২২৬)।

৭. আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, দিনসমূহের মধ্যে এমন কোন দিন নেই যা আল্লাহ্‌র ইবাদত করা তাঁর প্রিয়তর হতে পারে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন অপেক্ষা। এর প্রত্যেক দিনের সিয়াম এক বছরেরর সিয়ামের সমান এবং প্রত্যেক রাত্রির সালাত ক্বদরের রাত্রির সালাতের সমান। (তিরমিযী হা/৭৫৮; ইবনু মাজাহ হা/১৭২৮; মিশকাত হা/১৪৭১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৮৭)।

৮. ইবনু ওমর (রা.) বলেন, রসুল (সা.) মদীনায় দশ বছর বছর অবস্থান করেছেন আর বরাবর কোরবানি করেছেন।  (তিরমিযী হা/১৫০৭; মিশকাত হা/১৪৭৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৯০)।

৯. যায়দ ইবনু আরকাম (রা.) বলেন, এক দিন রসুল (সা.)-কে সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্‌র রসুল (সা.)! এই কোরবানি কী? তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহিম-এঁর সুন্নত। তাঁরা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের কী রয়েছে হে আল্লাহ্‌র রসুল (সা.)? রসুল (সা.) বললেন, কোরবানির পশুর প্রত্যেক লোমের পরিবর্তে একটি নেকি রয়েছে। তাঁরা আবার জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্‌র রসুল (সা.)! পশমওয়ালা পশুদের পরিবর্তে কি হবে? রসুল (সা.) বললেন, পশমওয়ালা পশুর প্রত্যেক পশমের পরিবর্তেও একটি নেকি রয়েছে। (ইবনু মাজাহ হা/               ৩১২৭; মিশকাত হা/১৪৭৬ বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৯১, ৩/২২৮ পৃষ্ঠা)।

১০. আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, আমি ওহি প্রাপ্ত হয়েছি যে, আল্লাহ তা'আলা কোরবানির দিনকে এই উম্মতের জন্য ঈদ রূপে পরিণত করেছেন। এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ্‌র রসুল ! আমি যদি মাদী 'মানীহা' (দুধ দেয় এমন গাভী) ব্যতীত অপর কোন পশু না পাই, তবে কি উহা দ্বারা কোরবানি করব? রসুল (সা.) বললেন, না; কিন্তু তুমি (কোরবানির দিনে) তোমার চুল ও নখ কাটবে, তোমার গোঁফ খাট করবে এবং নাভির নীচের কেশ খৌরী করবে - এটাই আল্লাহর নিকট তোমার পূর্ণ কোরবানি। (আবু দাঊদ হা/২৭৮৯; নাসাঈ হা/৪৩৬৫; মিশকাত হা/১৪৭৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৯৪)।

আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, পশুর গোশত ও রক্ত তাঁর কাছে পৌঁছে না। অথচ হাদিস মতে জবেহকৃত পশুর রক্ত জমিনে পতিত হবার পূর্বেই তা আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। শুধু রক্ত নয় জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশমও হাদিস মতে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। এইসব হাদিস কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক, আল্লাহর বাণীর সাথে বিদ্রোহ।  আল্লাহর রসুল আল্লাহর বাণীর বিরুদ্ধে কোন বাণী বা হাদিস দিতে পারেন না। অতএব যে গ্রন্থেই লেখা থাকুক না কেন তা জাল। সাধারণ বিচার-বিবেচনা যাদের আছে তারাও একটু চিন্তা-ভাবনা করলে এইসব হাদিসের জালিয়াতি ধরতে পারবেন। 

সব পশুর সাইজ এক নয় তাই তাদের গায়ের লোমের সংখ্যারও বিরাট তফাৎ আছে। ছাগল বা ভেড়ার চাইতে গরুর গায়ের লোম বেশি, আবার গরুর চাইতে উটের গায়ে লোম বেশি। তার মানে কি এই -  যে ব্যক্তি একটি ছাগল কোরবানি দিবে তার চাইতে যে ব্যক্তি একটা উট বা গরু কোরবানি দিবে সে বেশি নেকি পাবে? আবার যারা বহুসংখ্যক পশু কোরবানি দিবে তারা বহুসংখ্যক নেকি পাবে? যদি তা-ই হয় তাহলে যারা গরিব পশু জবাই করতে পারল না, তাদের কি হবে? নির্ধারিত দিন সমূহের জন্য যদি তারা রোজা রাখে তাহলে তাদের নেকি কোন্‌ পশু বা পশুসমূহের সমান হবে? তারা কি একটা ছাগল, নাকি একটা গরু, নাকি একটা উটের লোমের সংখ্যার সমান নেকি পাবে?  উক্ত হাদিস মতে যে বেশি ধনী সে কয়েক ডজন গরু একত্রে কোরবানি দিলে লোমের হিসাবে অনেক সওয়াব পাবে। আর যে মধ্যবিত্ত সে যদি মাত্র একটি ছোট ছাগল কোরবানি দেয় কিংবা গরিবরা যদি একটা গরুর সাত ভাগের এক ভাগ অংশীদার  হয়ে কোরবানি দেয় তাহলে অতি সামান্য সওয়াব পাবে। তাই যদি হয় তাহলে কি আল্লাহ তায়ালার বিধান বৈষম্যমূলক হয় না? টাকা দিয়ে নেকি কিনার মতো হয় না? যার যত বেশি টাকা আছে তার তত বেশি নেকি এমন বৈষম্যমূলক বিধান আল্লাহ-রসুলের বিধান হতেই পারে না। আল্লাহ পরম ন্যায় বিচারক, তিনি লোমের হিসাবে নেকি দেন না। লোম, রক্ত ও গোশতের হিসাব তিনি রাখেন না, তিনি হিসাব রাখেন তাকওয়ার।

উল্লিখিত হাদিসগুলো ছাড়াও কোন সনদের উল্লেখ না করেই একদল ফতোয়াবাজ বলে থাকেন - “কোরবানির পশু পুলসীরাতের উপর তোমাদের বাহন হবে। তাই তোমরা মোটা তাজা পশু কোরবানি কর। এই জাল হাদিসটি সরাসরি কুরআনিক চেতনা পরিপন্থী ও হাদিসের নামে জালিয়াতি। তারগীব নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে একবার হযরত নবী করিম (সা.) স্বীয় কন্যা ফাতেমাকে (রা.) ডেকে বললেন “হে ফাতেমা! তুমি তোমার জবাইকৃত জন্তুর নিকট যাও কেন না পশু জবেহ করার পর রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে তোমার যাবতীয় গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। হযরত ফাতেমা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! এটা কি শুধু আমার জন্য? প্রিয় নবী (সা.) জবাব দিলেন “এটা সকল মুসলমানের জন্য। এটিও একটি বাতিল বাণী। সুরা মায়িদার ২৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ সবার কোরবান কবুল করেন না, কেবল মুত্তাকীদের কোরবান কবুল করেন। ইমাম বোখারী এবং ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলের মতো বিখ্যাত হাদিস সংকলকগণ মনে করেন উক্ত হাদিস আবদুল্লাহ বিন নাফায়ের ভাষ্য, যা মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়।

গোশত খাওয়া যাবে কতদিন?  'কোরবানির গোশত তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ করা যাবে না' -  এই মর্মে মুসলিম শরিফে আলি (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত রয়েছে। ফতোয়াবাজরা বলেন এই হাদিস রহিত হয়ে গেছে (সম্ভবত ফ্রিজ আবিষ্কারের ফলে!)। এখন সালমা ইবনে আকওয়া (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসটি ব্যবহার করা হয় যার মূল কথা - 'তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর'। তাই এখন যতদিন ইচ্ছা ততদিন কোরবানির গোশত সংরক্ষণে রাখা যায়। তাতে কোন অসুবিধা হয় না, নেকির কমতি হয় না। ফতোয়া মতে -  কোরবানির গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেয়া উত্তম। কিন্তু পুরো গোশত নিজের ভোগের জন্য রেখে দিলেও তাতে কোনো অসুবিধা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলমগীরী (৫/৩০০)।

ফতোয়া রয়েছে, কোরবানির পশু কেনার পর বা নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে উপকৃত হওয়া জায়েয নয়। যেমন হালচাষ করা, আরোহণ করা, পশম কাটা ইত্যাদি। যদি কেউ উপকৃত হয় তবে উপকারের মূল্য - যেমন পশমের মূল্য, হালচাষের মূল্য ইত্যাদি সদকা করে দিতে হবে। (মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, নায়লুল আওতার ৩/১৭২, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০০)। ফতোয়া রয়েছে, কোরবানির পশুর দুধ পান করা যাবে না। যদি জবাইয়ের সময় আসন্ন হয় আর দুধ দোহন না করলে পশুর কষ্ট হবে না বলে মনে হয় তাহলে দোহন করবে না। প্রয়োজনে ওলানে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দেবে। এতে দুধের চাপ কমে যাবে। যদি দুধ দোহন করে তাহলে তা সদকা করে দিতে হবে। নিজে পান করে থাকলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে।  (মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭)। সত্যিই তো!  যে বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে ত্যাগের সংকল্প করলাম  তা আবার ভোগ করি কি করে? অথচ মানুষ জবেহ করে পুরো পশুর গোশত ভোগ করে। কি আশ্চর্য ব্যাপার! একমাত্র কোরবানির গোশত ব্যতীত আর কিছু নেই যা মানুষ ত্যাগ করার পর ভোগ করে। ত্যাগ আর ভোগ দুটি পরস্পরের বিপরীত। ত্যাগ করলে ভোগ করা যায় না ভোগ করলে ত্যাগ করা যায় না। অথচ প্রচলিত কোরবানিতে দুটিই একসাথে চলে!

ফতোয়া রয়েছে - ছাগল বা দুম্বা দ্বারা কোরবানি করাই উত্তম। এই ফতোয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় - রসুল (সা.) মদিনায় থাকা অবস্থায় উট, গরু ইত্যাদি পাওয়া যাওয়া সত্ত্বেও সর্বদাই তিনি (সা.) নাকি দুম্বা কোরবানি দিয়েছেন। ইব্রাহিম (আ.) যখন তার পুত্র ইসমাঈল (আ.) কে কোরবানি করতে নিলেন তখন আল্লাহ তায়ালা ইসমাঈল (আ.) এর পরিবর্তে জান্নাত থেকে যে পশু প্রেরণ করেছিলেন তাও নাকি ছিল দুম্বা। মানুষের ব্যবহারিক জীবনে উট ও গরুর তুলনায় দুম্বা বা ছাগলের প্রয়োজন অনেক কম আবার অধিকাংশ মানুষের ক্রয় সীমারও মধ্যে কিন্তু সম্ভবত লোমের হিসাবে কম হওয়ায় এই ফতোয়া বাঙালী মুসলমানদের পছন্দ হয়নি!

ধর্ম, জাতি ও বর্ণ নির্বিশেষে মিথ্যাকে পাপ, অন্যায় ও ঘৃণিত মনে করা হয়। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মানুষকে সর্বাবস্থায় সত্যপরায়ণ হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাথে সাথে মিথ্যাকে ঘৃণিত পাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তজ্জন্য ভয়াবহ শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। মিথ্যা সর্বদা ঘৃণিত। মিথ্যা যদি রসুল (সা.) এঁর নামে হয় তাহলে তা আরো বেশি ঘৃণিত ও ক্ষতিকর। সাধারণ মিথ্যা মানুষের বা মানব সমাজের জন্য জাগতিক ক্ষতি বয়ে আনে। আর রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ধ্বংস ও ক্ষতি করে। অথচ রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যাচার চলছে সকল প্রচার মাধ্যমে। রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যা প্রচারের দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথমত, নিজে মিথ্যা বলা ও দ্বিতীয়ত, অন্যের বলা মিথ্যা গ্রহণ ও প্রচার করা। উভয় পথ রুদ্ধ করার জন্য কুরআনে আল্লাহ ও রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যা বলতে কিংবা সন্দেহজনক কিছু বলতে কিংবা আন্দাজে কিছু বলতে কঠুরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এবং রসুল (সা.) এঁর নামে যে কোন কথা বলার আগে নির্ভুলতা যাচাই করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয। প্রত্যেক মুসলিমকে স্মরণে রাখতে হবে, “যে ব্যক্তি রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যা বলবে তার আবাসস্থল জাহান্নাম

প্রায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্‌ আজ হাদিসের খপ্পরে পড়ে গেছে। হাদিসের প্রচারে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত  হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহর হাদিস বা কুরআন ক্রমেই চাপা পড়ে যাচ্ছে।। একদিকে, আল্লাহ তায়ালা একবারও যা করতে বলেননি তা হয়ে গেছে এখন মুসলমানের মানদন্ড (যেমন - দাড়ি রাখা, টুপি পড়া ইত্যাদি আরো অনেক কিছু)। অন্যদিকে, মানুষ মনোযোগ দিতে পারছে না কুরআনের প্রতি। ফলে কুরআনের উদার, মানবিক আহ্বানের প্রতি সাড়া দেয়ার যথেষ্ট সুযোগ তৈরী হচ্ছে না।
মুসলিমের দায়িত্ব হলো কুরআন অধ্যয়ন, বুঝা এবং কুরআন দর্শনকে জীবন দর্শন হিসেবে গ্রহণ করা, লালন করা, পালন করা। প্রত্যেক মুসলিমকে আল্লাহর দরবারে তার নিজ কর্মের হিসাব দিতে হবে। অন্যে কারো কর্মের জন্য আমাদেরকে দায়ী করা হবে না, হিসেবও চাওয়া হবে না। তাই কথায় কথায় হাদিসের ব্যবহার থেকে প্রত্যেক মুসলিমকেই সতর্ক হতে হবে। কোন অজুহাত দেখিয়ে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়া যাবে না। কারণ আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষকেই বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। প্রত্যেককেই দিয়েছেন চিন্তা করার ক্ষমতা, সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করার ক্ষমতা। পৃথিবীর অনেক মানুষ মিথ্যা বললেও মিথ্যা বলা বৈধ হয় না। জেনে বা না জেনে অধিকাংশ মানুষ মিথ্যা বলছে তাই বলে আমিও মিথ্যা বলব এটা কোন যুক্তি হতে পারে না। যে কোন বিষয়ে বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা করে সত্যের অন্বেষণ করা প্রত্যেকেরই দায়িত্ব। যে কোন বিষয়ে হাদিসের উদ্বৃতি দেয়ার আগে জেনে নিতে হবে যা বলা হচ্ছে তা কি সঠিক? কারো কথায় প্রভাবিত না হয়ে প্রত্যেককে অনুসন্ধ্যিৎসু হতে হবে এবং প্রয়োজনে গবেষণা করে সত্য আবিষ্কার করতে হবে। নতুবা হাদিস বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেউ যদি জীবনে একটি হাদিসও না বলে তাহলে তার কোন পাপ হবে না কিন্তু রসুল (সা.) এঁর নামে একটি কথাও যদি মিথ্যা বলা হয় তা হলে তা হবে মহাপাপ। মহান আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের এই মহাপাপ থেকে রক্ষা  করেন। আমাদের জীবন আবর্তিত হোক কুরআনকে কেন্দ্র করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন