সময়ের
সাফ কথা ....
আমি যে তোমার
সাদিকুল হক ॥ ‘কুল, ইন্না সালাতি অ নুসুকী অ
মাহইয়া ইয়া অ মামাতী লিল্লা-হি রাব্বিল আ-লামীন।' অনুবাদ - বল, আমার উপাসনা এবং অর্ঘ এবং জীবন এবং মৃত্যু জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধার
একমাত্র প্রভুর জন্য। (কুরআন ৬:১৬২)।
আরবি
‘নুসুক' শব্দের অর্থ অর্ঘ। অর্ঘ শব্দের অর্থ - “কাম্যবস্তু পাওয়ার জন্য কাজ করা”। অর্ঘ শব্দের এই অর্থটি ধরে রেখেছে গ্রীক শব্দ ergon=work। আভিধানিক অর্থে অর্ঘ হলো - “যাহার
দ্বারা ক্রয় সাধিত হয়। পরম দাতার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনার্থে শ্রদ্ধা, ভক্তি, ফুল-ফলাদি,
শস্য, বা অন্য কোন উপহার নিবেদন করে ভক্ত কাম্য বস্তুর প্রার্থনা করে। তাই উপাসনা বা
প্রার্থনার সাথে অর্ঘ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এই অর্থে - যে কোন ধরনের উপাসনা, কর্ম বা
উপহার স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিবেদন করাকে বলা হয় অর্ঘ। আরবি ‘নুসুক' শব্দের
অর্থও ঠিক তাই। উক্ত আয়াতে ‘নুসুক' শব্দের যথার্থ বাংলা নিশ্চয়ই অর্ঘ।
অথচ,
কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি উক্ত আয়াতে ব্যবহৃত ‘নুসুক' শব্দের বাংলা অনুবাদে আরবি
শব্দ ‘কোরবান' লিখেন এবং উক্ত আয়াতটিকে প্রচলিত রীতিতে জিলহজ মাসে পশু জবাইর পক্ষে
একটি দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন। এই হলো নামসর্বস্ব ওলামাদের নিয়ে সমস্যা। রাজনৈতিক
ইসলামের প্রভাবে মুসলমান জাতিরই ঔরসে এমন এক গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে যারা নিজেদেরকে আলেম
হিসেবেই পরিচয় দেয় কিন্তু তারা কুরআনের মর্ম বুঝতে চেষ্টাও করে না। রাজনৈতিক ইসলাম
কুরআনকে যেভাবে অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করছে কুরআন আসলে তা নয়।
কুরআন
মানুষকে আলোর পথ দেখায়, কল্যাণের পথ দেখায়। কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে কিন্তু
কেবল আরব জাতির জন্য নয় - মানবজাতির কল্যাণের জন্য। কুরআন নবী মোহাম্মদ (সা.) এঁর মাধ্যমে
অবতীর্ণ হয়েছে কিন্তু কুরআনের লক্ষ্য কেবল মোহাম্মদ (সা.) নন, সমগ্র মানবজাতি। তাই
উক্ত আয়াতে ‘কুল' অর্থাৎ ‘বল' হুকুম কেবল মোহাম্মদ (সা.) এঁর প্রতি নয়, সমগ্র মানবজাতির
প্রতি। অথচ প্রচলিত অনুবাদকরা ‘কুল' শব্দের অনুবাদে ব্রাকেটে হে মোহাম্মদ লিখে পাঠককে
বিভ্রান্ত করছেন, কেউ না জেনে কেউ বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে। কুরআন সত্য ও মিথ্যার সুস্পষ্ট
পার্থক্যকারী, জীবন যাপনের ব্যবস্থাপত্র। ডাক্তারের ব্যবস্থা পত্র যেমন পড়লে, ছুলে
কিংবা চুমু খেলে রোগ সারে না তেমনি কুরআন পড়লে, চুমু খেলে নফসের রোগ সারে না। কুরআনের
পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের মাধ্যমেই রয়েছে নফসের রোগমুক্তি। কুরআনের প্রতি আমাদের প্রধান দায়িত্ব
হচ্ছে তা নিজের জীবনে উপলব্ধি করা এবং কুরআনের আদেশ-নিষেধ নিজ জীবনে বাস্তবায়িত করা।
জীবন চলার পথে কুরআন বাস্তবায়নের অব্যাহত প্রচেষ্টাই কেবল তাকওয়া জাগিয়ে তুলতে পারে।
‘ইন্না সালাতি অ নুসুকী অ মাহইয়া
ইয়া অ মামাতী লিল্লা-হি রাব্বিল আ-লামীন'
- এই আয়াতটি সত্যের সাথে একাত্মতার সর্বাত্মক ও পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা, আল্লাহ প্রেমের চূড়ান্ত
অঙ্গীকারনামা। এতে আল্লাহর প্রতি ভক্তের এমনভাবে আত্মসমর্পণের অঙ্গীকার রয়েছে যে -
আমার বলতে আর কিছু নেই, যা কিছু আছে সবই তোমার। আমি শুধুই তোমার, আমার জীবন-মৃত্যুতে
আর কারো এক চিলতে অধিকার নেই। যে সব বস্তু, সহায় সম্পত্তি আমার অধিকারে রয়েছে সব তোমার।
আমি শুধু তোমাকেই চাই, তোমার সাথেই প্রেম করি। আমি আর কারো আনুগত্য বা সন্তুষ্টি প্রত্যাশা
করি না। আমার প্রতিটি ইচ্ছা, আমার অঙ্গ-প্রতঙ্গের প্রতিটি কর্ম কেবল তোমারই জন্য। তুমি
ব্যতীত আমার জীবনে আর কেউ নেই, কিছু নেই, কিছু নেই। নেই, নেই, নেই। আছো কেবল তুমি।
তুমি ব্যতীত আর কারো কাছে আমি সাহায্যপ্রার্থী হই না। তুমি ব্যতীত আর কেউ আমার কোন
ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না। আমার জীবনে যা কিছু ঘটছে, যা কিছু আমি পাচ্ছি বা হারাচ্ছি
তা কেবল তোমার ইচ্ছানুযায়ীই হচ্ছে। যা করার অনুমতি তুমি দাও না, আমি তা করি না। যা
ঘটবার অনুমতি তুমি দাও না, তা আমার জীবনে ঘটে না। তাই আমি কাতর হয়ে কেবল তোমাকেই ডাকি,
কেবল তোমারই কাছে নিরংকুশভাবে আনুগত্য প্রকাশ করি।
যাদের
সাথে চলাফেরা করলে কিংবা যে পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাবে আমি তোমাকে ভুলে যাই তাদের
সাথে আমি চলাফেরা করি না, কথা বলি না, সেসব পরিবেশে আমি যাই না, সেসব পরিস্থিতিতে আমি
পতিত হই না। আমি শুধু তাকিয়ে থাকি তোমার জ্যোতির দিকে। তোমার জ্যোতি আমার প্রাণকে উজ্জীবিত
করে, আমার চোখ ধাঁধিয়ে যায়, তোমার জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ে আমার দেহ মনে। তোমার প্রাণসঞ্জীবনী
আলোর প্রভায় জেগে ওঠে আমার ঘুমন্ত সত্ত্বা, নাড়া দেয় অস্তিত্বের গভীরে। তোমার আলো থেকে
মুহুর্তের জন্য চোখ ফিরিয়ে নিলে আমি বিভ্রান্ত, বিপর্যস্ত, দিশাহারা হয়ে যাই। তুমি
ব্যতীত আর যেদিকেই তাকাই সবই ভুল, মিথ্যা মরিচীকা। আমার জীবনে কেবল তুমিই একমাত্র সত্য। আমি যা গ্রহণ-বর্জন করি, যা দেখি, যা অনুভব ও চিন্তা
করি তা নিয়ে যে জগতসমূহ তৈরি হয়েছে তুমিই তার অধিপতি। তোমার স্বার্বভৌমত্বের প্রভাবে
সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ বিষয়সমূহ ধরা দিচ্ছে আমার দৃষ্টিতে, চিন্তার জগতে সৃষ্টি হচ্ছে অভিনব
স্পন্দন, আমি পূর্ণ হয়ে উঠছি। দুনিয়ার কোন দুঃখ, দৈন্য ও সংকট আর আমাকে স্পর্শ করে
না। আমার আকাশে নেই কোন দুর্যোগের ঘনঘটা, তোমার জ্যোতির উজ্জ্বলতায় কেটে গেছে সব অন্ধকার,
রহস্যাবৃত সত্য হয়েছে উন্মোচিত - তাই আমি কৃতজ্ঞতা জানাই কেবল তোমারই প্রতি। তুমি সত্য,
তুমি প্রকৃত, তুমি চিরন্তন। জীবনে তুমি ছাড়া কিছু নেই। তোমার কারণেই আমার বেঁচে থাকা।
তোমার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যই আমার সকল ব্যকুলতা। ধন-রত্ন, জাতি, বর্ণ, যশ-খ্যাতি কিছুই
চাই না আমি। আমি চাই শুধু তোমাকে। আমি শুধুই তোমার। তোমার করুণা থেকে আমাকে বঞ্চিত
করো না।
হে
প্রভু, আমার সকল অপরাধ তুমি ক্ষমা করে দাও।
তুমি ব্যতীত তো আমার অপরাধ ক্ষমা করার কেউ নেই। হে প্রভু, আমাকে সর্বোত্তম চরিত্র
অর্জনের পথ দেখাও, তুমি ব্যতীত তো এ পথ দেখাবার আর কেউ নেই। হে প্রভু! আমার আচরণে যা
কিছু দোষত্রুটি আছে, তুমি তা দূর করে দাও তুমি ব্যতীত তো তা দূর করার আর কেউ নেই। হে
প্রভু! ক্ষমা করে দাও আমার সকল পাপ - সামনের ও পেছনের, প্রথম ও শেষের, প্রকাশ্য ও গোপনের।
ক্ষমা করো আমার ভ্রান্তি, বাড়াবাড়ি, অজ্ঞতা, আমার সীমালঙ্ঘন, অক্ষমতা, অনিচ্ছা ও ইচ্ছাকৃত
ভুল। ক্ষমা করো আমার সেসব অপরাধ যা তুমি আমার চেয়ে ভালো জান। তুমিই তো আমার ত্রাণকর্তা,
তুমি ছাড়া তো আর কোনো ত্রাণকর্তা নেই। তুমি না দিলে তো দেবার সাধ্য কারো নেই। সকল কল্যাণই
তোমার হাতে। আমার জন্য তুমিই যথেষ্ট। তুমিই সর্বোত্তম নির্ভরস্থল। হে প্রভু! তুমি তো
সবকিছুর ক্ষমতা রাখো, আর আমার তো কোনো ক্ষমতা নেই। তুমি তো সবকিছু জানো, আর আমি তো
জানি না। আমাকে জানিয়ে দাও, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করো। হে প্রভু! শান্তি, কল্যাণ আর প্রাচুর্যের মালিক
তুমি। আমাকে দয়া করো। আমাকে তোমারই পথে পরিচালিত করো। তুমিই তো জীবন ও মৃত্যু দাতা। হে প্রভু! যতদিন আমাকে
বাঁচিয়ে রাখো আমাকে বিপথগামী করো না। হে প্রভু! যতক্ষণ জীবন আছে আমি যেন তোমার সাথে
সার্বক্ষণিক সংযোগ রক্ষা করে চলতে পারি। তোমার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের আনন্দ যেন আমি
পেতে পারি। হে প্রভু! আমাকে বিশ্বাস ও ভক্তির সৌন্দর্যে সৌন্দর্যমন্ডিত করো এবং তোমার
সান্নিধ্য দাও। হে আমার স্রষ্টা, হে মহান ও সম্মানিত, হে চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী! আমাকে
তোমার ছায়াতলে আশ্রয় দাও।
হে
প্রভু! আমার নফসকে পরিশুদ্ধ করো। আমি যেন সত্য বলতে পারি ও সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে
পারি। আমার দৃষ্টি যেন সর্বদা তোমাতে নিবদ্ধ থাকে। হে প্রভু! শক্তির উৎস তুমি! তোমার
সাথে সংযোগ থেকেই আসে আমার শান্তি। আমাকে শক্তি দাও যেন মঙ্গলকর্ম করতে পারি। আমি যেন
আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারি। আমার চিন্তা স্বচ্ছ ও শান্ত করো। অন্যের কাজ ও ভুলভ্রান্তির
প্রতি সহনশীল করো। নিজের বিচার নিজে করার শক্তি ও ধৈর্য দাও। আমার অন্তর থেকে ক্ষোভ
ও ঘৃণা দূর করো। দেহ ও চিন্তার উপর আমার নিয়ন্ত্রণ দাও। হে প্রভু! জ্ঞানবিজ্ঞানের আধার
তুমি। আমাকে শক্তি ও জ্ঞান দাও যেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মানব সেবা করতে
পারি।
কুরআন
এক রহস্যময় গ্রন্থ। কীভাবে ছোট একটি বাক্য দিয়ে প্রেমের সর্বোচ্চ ঘোষণা দেয়া যায় তার
যে উদাহরণ উক্ত আয়াতে রয়েছে তাও রহস্যময়তার প্রমাণ বটে। যে এই সত্য উপলব্ধি করে কেবল সেই বলতে পারে - ‘ইন্না সালাতি অ নুসুকী
অ মাহইয়া ইয়া অ মামাতী লিল্লা-হি রাব্বিল আ-লামীন।' বাকীরা পশুজবাই করে মজা করে গোশত
খাচ্ছে, খাক না, ওটাওতো তোমারই!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন