মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কথা ও কাজে এক হলেই দেশের মঙ্গল


কথা ও কাজে এক হলেই দেশের মঙ্গল

 

সংলাপ ॥ একজন রাজনীতিক ও একজন রাজনীতিজীবীর মধ্যে পার্থক্য কোথায় ? -স্বাধীনতার ৪২ বছর পর আজ বাংলার সচেতন ও বিবেকবান মানুষের মনে এ প্রশ্ন আজ নিত্যই জেগে উঠে। কারণ, আজকের দিনে রাজনীতিতে ত্যাগের চাইতে প্রাপ্তি অনেক বেশি। অথচ আজকের বাংলাদেশ যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, সাধক কাজী নজরুল ইসলাম, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণিসিং, অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, শামসুল হক (টাঙ্গাইল), বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদ এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো নিবেদিতপ্রাণ অসংখ্য রাজনীতিবিদদের মেধা, চিন্তা-চেতনা ও সারাজীবনের ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল তা বলাই বাহুল্য। এঁরা ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি করেননি, এঁরা রাজনীতিক বা রাজনীতিজীবীও ছিলেন না, এঁরা  ছিলেন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ। দেশ ও জনগণকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করে একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এই রাজনীতিবিদগণ  তাঁদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টুকু ব্যয় করেছিলেন।

একটি পশ্চাদপদ জনপদ ও তার জনগণকে ভালবাসলে এবং শুধুমাত্র তাদের কল্যাণে রাজনীতি করলে একজন রাজনীতিবিদ হতে যে কী রকম ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্রমাণ করতে হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট ভোর বেলায়। এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষকদের চোখে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তিনি এদেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দিয়েছিলেন। এদেশের সবাইকে নিয়ে একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনের উদ্দেশে তিনি বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে স্বপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তাঁর সেই কর্মসূচিকে কবর দেয়া হয়। দেশ ধীরে ধীরে চলে গেল ব্যবসায়ী লুটেরা রাজনীতিকদের হাতে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণে সৃষ্ট সুযোগ ও সুবিধাভোগী হিসেবে যে বা যারা পরবর্তীকালে এদেশের রাজনীতি তথা ক্ষমতার মঞ্চে আরোহণ করলো তারা এদেশে কায়েম করেছিলেন তথাকথিত গণতন্ত্র। বর্তমানে দেশে যে গণতন্ত্র কায়েম রয়েছে তা বলতে গেলে সেই  তথাকথিত গণতন্ত্রেরই ধারাবাহিকতা। আপামর জনগণের মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এই  গণতন্ত্রে  যে কী রকম সমস্যা ও  সংকীর্ণতা রয়েছে তা আজ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সহজেই অনুমেয়। তথাকথিত গণতন্ত্রের দাবীদার দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের স্বার্থে কেউ কাউকে কোন রকম ছাড় দিতে রাজী নয়। যদিও ব্যক্তি ও সামাজিকভাবে এ দুই দলের বহু নেতাকে পারষ্পরিক ব্যবসায়িক সুসম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যাচ্ছে। অথচ দেশ ও জনগণের স্বার্থে তারা এক হলে এবং তাদের কথা ও কাজের মধ্যে সঙ্গতি থাকলে দেশ আরও বহুদুর এগিয়ে যেত। শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু লোক ও পরিবার নয়, সমগ্র দেশবাসীই এ গণতন্ত্রের স্বাদ উপলব্ধি করতে পারতো। দেশ এখন দুটি রাজনৈতিক দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে-এমন কথা দেশবাসীকে শুনতে হতো না। রাজনীতিতে স্বার্থান্ধতা, আঞ্চলিকতা, নিছক ব্যবসায়ী,  দুর্নীতিবাজ ও অবসরপ্রাপ্ত সুবিধাভোগী সামরিক কর্মকর্তা ও আমলাদের প্রভাব এতটা প্রকট হয়ে উঠছে, যা আমাদের ঐতিহ্যবাহী ও নিবেদিতপ্রাণ সেই রাজনীতিবিদদের এইদেশে দুভার্গ্যজনক বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়। দেশে রাজনীতিবিদ বা জননেতা এখন ক'জন ?     

দেশে এখন রাজনীতিবিদ বা জননেতা ক'জন আছেন? এ-প্রশ্নের যথার্থ উত্তর খুঁজতে আজ বেগ পেতে হবে এদেশের যে-কোনো গবেষক, চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র-শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষ সকলকেই। কিন্তু দেশে এখন রাজনীতিক এবং রাজনীতিজীবী ক'জন আছেন?-এমন প্রশের উত্তর দিতে কাউকেই হয়ত তেমন অসুবিধায় পড়তে হবে না। কারণ, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দেশের কেউই এখন রাজনীতির বাইরে নয়। তথাকথিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ থাকায় সে সুবিধাটি আরও বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে রাজনীতিজীবীদের কাছে। রাজনীতিজীবীদের ও রাজনীতিকদের হাতেই এখন দেশের সকল ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা অর্পিত থাকে। আর তাদের সহযোগী ও সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করে আমলাতন্ত্র। কখনও এরা এক অপরের সম্পূরক আবারও কখনও বা একে অপরের পরিপূরক। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে দেশে যে পরিবেশ তৈরি হয় তাতে সাধারণ মানুষ ভেবেছিল এদেশের রাজনীতির অঙ্গনের ধর্মভীরু মানুষেরা ধর্মপ্রাণ হয়ে রাজনীতিক বা রাজনীতিজীবীরা আর কখনও মিথ্যাচার করবে না। রাজনীতিজীবিরা তাদের কথায় ও কাজে মিল রাখবেন। কিন্তু সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে তাদের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল কেউ তা রাখতে পারেননি। আজও তারা  সংসদকে কার্যকর করতে পারেননি। প্রশ্ন জনমনে দানা বাঁধছে তারা কেমন মুসলমান? তাদের এই ব্যর্থতার জন্য জাতির সামনে তারা লজ্জ্বিতও নন। জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা তারা নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু জনগণের কাছে যে অঙ্গীকার করে ভোট চেয়েছিলেন সে অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দিকে তাদের খেয়াল বলতে গেলে খুবই কম যা ইসলামের দৃষ্টিতে মুনাফেকী। রাজনীতির অঙ্গনে বিচরণের সুবিধা হিসেবে সর্বস্তরের রাজনীতিজীবিদের মধ্যেই এখন সুবিধাবাদিতার মনোভাব ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলেছে। রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে এখন অনেক অযোগ্য, অদক্ষ ব্যক্তি সমাজের  বিভিন্ন  স্তরে  প্রভাব বিস্তার

করে চলেছে। জনগণের সার্বিক কল্যাণ ও স্বার্থের দিকটি উপেক্ষিত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে আগামী সাধারণ নির্বাচন নিয়ে কয়েকটি দল এখনই যেভাবে মিথ্যাচার দিয়ে মাঠ গরম করে চলেছে তাতে দেশের সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে দেশ আবারও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যেতে পারে বলে আশংকা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রবীণতম রাজনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর  আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা রাজনীতিতে সমঝোতা বা কথা বলার কোনো সুযোগ রাখিনি। অতীত থেকে শিক্ষাও নিচ্ছি না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। রাজনীতিতে রেষারেষি ও পরষ্পরবিরোধী মনোভাবের ফলে দেশে আবারও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশংকা আছে'। (তথ্যসূত্র: কালের কন্ঠ ২ অক্টোবর, ২০১১)। এ অবস্থায় সরকার বিগত সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংসদকে কার্যকর করে রাখবেন-এমনটাই এখন জনগণ প্রত্যাশা করছে। দেশ ও জনগণের সার্বিক কল্যাণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আজকের দিনের রাজনীতিক ও রাজনীতজীবীরা তাদের সকল কর্মকান্ড মিথ্যাচারের পথে?না পরিচালনা করলেই দেশের মঙ্গল। শুধুমাত্র সভা-সমাবেশে ও বাণিজ্যিক মিডিয়াগুলোতে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে জনগণের স্বার্থ আদায় হবে না- সে কথা যে আজ দেশের জনগণ ঠিকই বুঝে গেছে। আজকের দিনের রাজনীতিক ও রাজনীতিজীবীরা কথা ও কাজে এক হতে পারলেই দেশ ও সমাজের মঙ্গল সম্ভব এবং তারাও একসময়ে সত্যের পথ ধরে রাজনীতিবিদ হয়ে উঠবেন। তখনই তাদের হাতে রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম' যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা পাবে এবং  রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় হবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন