মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন এবং একজন শিক্ষকের উপলব্ধি!



বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন এবং
একজন শিক্ষকের উপলব্ধি!

শেখ বর্ষা ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শিক্ষক ও ছাত্রদের স্বাধীনভাবে পড়ালেখা ও জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে কুখ্যাত ১৯৬১ সালের অর্ডিন্যান্স রদ করে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ জারি করা হয় এবং এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুজ্জীবিত হয়। তাই, নির্দ্বিধায় বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তা বা মুক্তবুদ্ধির জায়গা। মুক্ত চিন্তার মানুষ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশ ও সমাজের কল্যাণে ভূমিকা রাখবেন, বিভিন্নভাবে দিকনির্দেশনা দেবেন-এটাই সকলের প্রত্যাশা। সেই থেকে আমাদের দেশের পাবলিক (সরকারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যে কী ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক অধিকার ও মুক্তচিন্তার সুযোগটির সদ্ব্যবহার এখনকার দিনে কতটকুু হচ্ছে তা নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ঘটনাসমূহকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদেরই একটি অংশের হাতে ৮৪ ঘন্টা অবরুদ্ধ থাকার পর গত ২৪ আগষ্ট শনিবার রাতে মুক্ত হন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে ২১ আগষ্ট বুধবার দুপুর ১২টা থেকে আন্দোলনরত শিক্ষকদের অবরোধের মুখে তিনি নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। এরপরই উপাচার্য আনোয়ার হোসেন মুক্ত হন। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষক ফোরামের সদস্য সচিব বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর সাথে ফলপ্রসু আলোচনা হওয়ায় আন্দোলন ও কর্মসূচি স্থাগিত করেছি। এদিকে, ওই দিন দুপুরে প্রগতিশীল ছাত্রজোট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং ক্লাস পরীক্ষার দাবিতে মিছিল করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা নিরসনে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য আবদুল হামিদের হস্তক্ষেপ কামনা করে শ্লোগান দেয়। পরে একই দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে একটি মৌন মিছিল বের হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে। সরকার-সমর্থিত ছাত্রলীগ সরাসরি এই আন্দোলনে অংশ না নিলেও সংগঠনটির সভাপতি জানান, ক্লাস-পরীক্ষার দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে তাদের সমর্থন রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকদের এই আন্দোলন সংশ্লিষ্ট সচেতন মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আগের দিনে যা করতো এখন তা যেন শিক্ষকদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে! বলতে গেলে ব্যাপারটি যেন উল্টো হয়ে উঠেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ডাকসু, জাকসু, ইউকসু, চাকসু ইত্যাদি না থাকায় ছাত্রছাত্রীদের অনেক বায়না ধরতে ও দাবিদাওয়া এখন শিক্ষকেরাই যেন করতে উদ্যত হয়েছেন।
এই পরিস্থিতিজনিত সমস্যার গভীরে গেলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন মোটামুটিভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত। ১৯৭৩এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে প্রাপ্ত স্বাধীনতা নিয়ে এই শিক্ষকেরা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা বা সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যতটুকু ব্যস্ত থাকার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি তৎপর আওয়ামী লীগ বা বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীকে খুশী করার জন্য রাজনৈতিক কাজে, নন-অ্যাকাডেমিক কাজে। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়ার সুযোগ লাভের ইচ্ছাই সেখানে কাজ করে বেশি। অথচ এইসব শিক্ষকের অনেকে ছাত্রজীবনে কখনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এমন কোনো নজীরও নেই। এক সময় অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরাই প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ গ্রহণসহ দেশ ও জাতিকে বিভিন্নভাবে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অবদানও রেখে গেছেন। গত প্রায় দুই যুগ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেন্দ্রীয় ও হল ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়ায় মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের নির্বাচনে অংশ নিয়ে ছাত্র ও সমাজ জীবনে ভূমিকা রাখার সুযোগও আর তেমনটি নেই। এখন রাজনীতি মানেই হলো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করা এবং দল ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতার ফল ভোগ করা। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, ছাত্র-ছাত্রীদের চাইতে শিক্ষকরাই এখন বেশি আন্দোলন-সংগ্রাম করে এবং তাও কেবল তাদের নিজেদের দাবি-দাওয়া মেটানো বা ‘অধিকার আদায়ের জন্যই। পরিণতিতে ছাত্রসমাজ আজ সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে না, হতাশ ও বিভ্রান্ত হচ্ছে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আদর্শ, দেশপ্রেমিক এবং সমাজসচেতন হিসেবে গড়ে উঠার উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ার কারণে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রেই বিরাজ করছে নেতৃত্ব শূন্যতা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ঘটনা আমাদের সকলের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন আন্দোলন অব্যাহত থাকলে ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠতে বাধ্য ।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদেশের সাধারণ মানুষের সন্তান-সন্ততিদের উচ্চ শিক্ষার জন্য এখনো আশা-ভরসার জায়গা। আর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো অনেক গুণী ও বিবেকবান মানুষ শিক্ষক কর্মরত আছেন বলে আমাদের বিশ্বাস এবং এই গুণী শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার সার্বিক মানের উন্নতিতে এগিয়ে আসবেন বলে জাতি প্রত্যাশা করে। যেমন-গত মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন পরিস্থিতি দেখে আরেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, দেশের জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক জাফর ইকবাল তাঁর ‘সাদাসিধে কথা নামক কলামে ‘এই লজ্জা কোথায় রাখি শীর্ষক শিরোনামে লিখেছেন, ‘কাক কাকের গোশত খায় না; কিন্তু এবার মনে হয় খেতেই হবে। আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে আমি সাধারণত অন্য বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করি না; কিন্তু এবার মনে হয় করতেই হবে। ...............বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া করানোর জন্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখন মনে হয় সেটা কারও মনে নেই। অনেকেরই ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরিটি বুঝি তার নিজের সুখ-সুবিধার জন্য। নিজেদের ‘অধিকার আদায় করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার বিষয়টি যদি পুরোপুরি চাপা পড়ে তাতে কেউ কিছু মনে করে না। ছাত্রছাত্রীদের কারণে ধর্মঘট, মারামারি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ- এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকরা তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া বন্ধ করে রেখেছেন সেরকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। উদাহরণটি খুব ভাল নয়, সারাদেশে আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর খুব বড় একটা গ্লানি নেমে এসেছে। এ গ্লানি থেকে আমরা খুব সহজে বের হয়ে আসতে পারবো বলে মনে হয় না। (দৈনিক সমকাল, ৩০ আগষ্ট, ২০১৩, ১৫ই ভাদ্র, ১৪২০)। অধ্যাপক জাফর ইকবালের মতো আত্মসমালোচনা ও আত্মোপলব্ধির পথ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনায় যত তাড়াতাড়ি এবং যত বেশি মনোযোগী হবেন, দেশবাসীর বিশেষ করে ওই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও এর ছাত্র-ছাত্রীদের ততই মঙ্গল। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন