নেশা নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার সময়ের
দাবি
সাদি
॥ নেশা নিয়ন্ত্রণে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারছে না বলে দেশের চিন্তাবিদ
ও বিবেকবান সম্প্রদায় শঙ্কিত। দেখা যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে নানারকম নেশাদ্রব্য
প্রবেশ করছে এবং এটা কোন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। মাদক বা নেশা জাতীয় দ্রব্য
যারা আনছে বা যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করার পরও দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি
হচ্ছে না এদেশে, যেহেতু তারা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত অথবা সন্ত্রাসী দলের
সদস্য। সেজন্যে এসব মাদক বাংলার আনাচে-কানাচে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং যুব সমাজে ও
স্কুল-মাদ্রাসাগুলোতেও এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবী
শ্রেনীর মধ্যে হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে কোনো না কোনো উপায়ে। ঔষধের দোকানগুলো,
মুদি দোকানগুলো এবং ফেরিওয়ালাদের একাংশ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে অতি দ্রুত পয়সাওয়ালা
হওয়ার জন্য।
বাংলাদেশের
সাথে ভারত ও মিয়ানমারের সুদীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। সেই সীমান্ত পথেই মূলত বেশিরভাগ মাদক
দেশের অভ্যন্তরে ঢুকছে। এছাড়াও আকাশপথে বিশেষ পাসপোর্টধারীদের একাংশ মাদক আমদানিতে
জড়িয়ে আছেন বলে জাতি সন্দেহ পোষণ করেন। বাংলাদেশের এতবড় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর
পক্ষে আটকানো সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি হচ্ছেনা আকাশপথকে স্বচ্ছতার আওতায় আনা। এ ব্যাপারে
সরকারকে আরো সজাগ হওয়া দরকার বলে চিন্তাবিদরা অভিমত প্রকাশ করেন। আমাদের নতুন প্রজন্মকে
এই মাদক বিছানো জাল হতে বাঁচাতে হলে এবং একটা সুস্থ সমাজ গড়তে হলে- আমাদের অনেক বেশি
চিন্তা করতে হবে এবং ঘরে ঘরে অবিভাবকদের আরও সতর্ক হয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী
যা সময়ের দাবী সর্বস্তরের মানুষের জন্য।
রাজনীতিকরা
যুব সমাজকে নষ্ট করে ফেলছে মিথ্যাচারের মধ্যে তাদের অবস্থানকে দৃঢ় করতে তখন কিভাবে
এটা সম্ভব! চিন্তাবিদদের একাংশ অভিমত প্রকাশ করেন এই বলে যে সামাজিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস
করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতিকদের অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে হবে নতুন প্রজন্মের প্রতি।
যুব সমাজ যাতে এ ধরনের সর্বনাশা পথে যেতে না পারে বা এসব পথ থেকে বিরত থাকে সেদিকে
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনীতিকদের সজাগ লক্ষ্য রাখতে হবে। অপরদিকে দেশের নিরাপত্তাবাহিনী
যারা মাদক নিয়ন্ত্রণ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের আরো বেশী কঠোর, সংববেদনশীল এবং আইনের
প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল হলে তবে মাদক বা নেশার বিষয়টি যা প্রকট আকার ধারণ করেছে তা অনেকটা
নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। সেজন্যে এ ব্যাপারে সরকারকে আরো অনেক বেশি দৃষ্টি দিতে হবে, আরো
জোরদার পদেক্ষপ নিতে হবে। যেহেতু চতুর্দিকে
মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে ভবিষ্যতে যাতে এরকম আর কোনো ঘটনা ঘটতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক
থাকতে হবে।
আদর্শ
জীবন গঠনে সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পারিবারিক
জীবনসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে তরুণ সমাজ
বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ তেমন কোনো
কাজ করে না। তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহার করছে, ইন্টারনেট ব্যবহার
করছে। যুব সমাজ আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলোর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হচ্ছে। পরিবার
সন্তানদেরকে ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দিলে, ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে মানুষ করলে এ ধরনের
সংকট তৈরী হয় না। সন্তানদেরকে ভালো মন্দ শিক্ষা দেয়া, কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়
সেটা বোঝানো, কোনটা গ্রহণ করা উচিত আর কোনটা
বাদ দেয়া উচিত এসব শেখানো হলে করুণ পরিণতির শিকার পরিবারের কাউকে হতে হয় না।
আমাদের
সমাজ পাশ্চাত্যের অনেক কিছুই গ্রহণ করছে। তবে পাশ্চাত্যের যেসব জিনিষ আমাদের জন্য ক্ষতিকর
হবে সেটা থেকে সন্তানদেরকে ছোট বেলা থেকেই দূরে রাখতে হবে। বাবা মায়েরা যখন ছেলে-মেয়েদের
সাথে মিশছে এবং তাদেরকে বাড়তি টাকা দিচ্ছে। এসব বাড়তি টাকা পাওয়ার কারণে তারা অন্যায়
পথে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে এবং খেসারত দিতে হচ্ছে ভবিষ্যতে। আগেকার দিনে একান্নবর্তী
বা যৌথ পরিবার প্রথা ছিল। তখন পরিবারের সবাই সন্তানদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে পারত। কিন্তু
এখন তো একক পরিবার। একটি পরিবারে বাবা ও সন্তান ছাড়া এর বাইরে আর কেউ থাকে না। ফলে
সন্তান কি করছে অনেক সময় তা বাবা মা লক্ষ্য
রাখতে পারে না। সন্তানদেরকে সময় দিতে হবে, তাদের সাথে কথা বলতে হবে বন্ধুর মতো করে।
তাছাড়া সারাদিন তারা কোথায় গেল কি করল সেসব খোঁজ খবর নিতে হবে। আমাদের সন্তান একজন বাঙালি- এ বিষয় তার চেতনার মধ্যে ঢুকাতে হবে।
তাকে বোঝাতে হবে জাতীয়তাবোধ এবং একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে নিজেকে তৈরী করার জন্য নৈতিক
শিক্ষা দিতে হবে।
শুধুমাত্র
শাসন করেই সন্তানদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় না। বাবা-মার ভালবাসা কেবল
শাসন নয়। বাবা-মায়েদের দেখে তাদের ছেলেমেয়েরাও শিখবে এবং তাদের জীবনে সেগুলোর চর্চা
করবে। সন্তানদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে
তোলার জন্য অবশ্যই বাবা মাকে আদর্শবান হতে হবে এবং সন্তানদেরকে সুপথ দেখাতে হবে। সন্তানদের অসুবিধাগুলো জানতে হবে সেই
অনুযায়ী তাদের সমস্যার সমাধানে সর্বাত্মকভাবে মনোনিবেশ করতে হবে। সন্তানেরা যদি বাবা-মাকে
বন্ধু ভাবতে পারে তাহলে তাদের কোনো অসুবিধা হলে সেটা বাবা মায়ের সাথে মুক্তভাবে আলোচনা
করবে। তাতে সন্তানদের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। সামাজিকীকরণ ও সাংস্কৃতিকরণের সঠিক পথ অনুসরণ না
করার সমস্যা থেকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আকাশ সংস্কৃতির খারাপ দিকগুলো এখন বেশ জোরে সোরে চেপে বসেছে। নানারকম
অশ্লীল সিনেমা, নাটকসহ এমন সব জিনিষ বাংলাদেশের বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলোতে দেখানো হচ্ছে
যার ফলে তরুণ সমাজ বিপথগামী হচ্ছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিষয়টিকে দেশবাসী ও সরকারকে
অগ্রাধিকার দিতে হবে। চিত্ত বিনোদনের জন্য কি ধরনের মুভি বা প্রোগ্রাম ছেলে-মেয়েরা
দেখছে, ইন্টারনেট এবং ফেসবুকে কি করছে বা কি
দেখছে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খুবই সতর্ক থাকতে হবে। তাদেরকে বোঝাতে হবে কোন জিনিষ
তাদের উপকারি এবং কোনটা ক্ষতিকর। আর সেভাবে তাদেরকে ভালো জিনিষের দিকে আকৃষ্ট করতে
হবে। ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চা পাশাপাশি করতে হবে। আকাশ সংস্কৃতির যে খারাপ দিক রয়েছে
অর্থাৎ অপসংস্কৃতির ব্যাপারে আমাদেরকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে এবং উপদেশের পাশাপাশি তাদের
সাথে আনন্দময় জিনিষ নিয়ে আলাপ করতে হবে। তাদেরকে ভালোভালো বই কিনে দিতে হবে এবং ভালো
ফিল্ম কিনে দিতে হবে। বাচ্চাদের সঙ্গে এমনভাবে এসব বিষয় নিয়ে সময় কাটাতে হবে যাতে তাদের
চিন্তা জগৎ ওইসব বিষয়মুখী হয়ে যায়। তাহলে তারা বাইরে সময় কাটানোর আর সময় পাবে না এবং আনন্দময় কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকবে।
আমাদের
ভবিষ্যত প্রজন্ম যারা আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দেবে তাদেরকে সুন্দর করে আদর্শ মানুষ হিসেবে
গড়ে তুলতে না পারি তাহলে তো আমাদের পরিচয়টাই থাকবে না। সেজন্যে সরকার ও শিক্ষাব্যবস্থা,
আমাদের বাবা-মায়েরা পরিবারের মধ্যে এবং শিক্ষক শিক্ষিকারা যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
রয়েছেন তাদের সবারই দায়িত্ব রয়েছে নতুন প্রজন্মকে ঠিকপথে পরিচালিত করার।
আজকাল
যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তারমধ্যে বর্তমান ড্রাগস সম্পর্কিত অপরাধ বেশি হচ্ছে। এর আগেও
অনেকে গাজা খেত। কিন্তু বর্তমানে গাজাসহ অন্যান্য মাদকের ধরন অনেক বেশি উন্নত, শুধু
তাই নয় মাদকের ভয়াবহতা তরুণ সমাজের মধ্যে এমন আকার ধারণ করেছে যে তারা তাদের নিজেদের
জীবনকে পর্যন্ত ধ্বংস করছে। আর সেজন্যে পরিবার,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ এবং রাষ্ট্র
- সবারই দায়িত্ব আছে এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষার। দেশে কঠোর আইন থাকা
দরকার। পাশাপাশি যারা অন্যায় করছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করা হলে
অন্যরা সুযোগ পাবে এবং অনেকে অন্যায়ের প্রতি উৎসাহিত হবে। মাদক, দুর্নীতি ও অন্যায়ে দেশ ভরে ওঠলে তার পরিণতি
হবে ভয়াবহ। আমাদের কোনো সন্তানকে আমরা রক্ষা করতে পারব না। বিভিন্ন ফল ও খাবারে ফরমালিন
মিশিয়ে বাচ্চাদের যে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে, এদেরকে যে ড্রাগে আসক্ত করছে এবং আমাদের
ভবিষ্যত প্রজন্মকে নষ্ট করছে তারাও কারো না কারো অবিভাবক। তাহলে কি আমাদের বিবেক সঠিকভাবে
কাজ করে না। আর সেজন্য কি আমাদের সামাজিক সমস্যা বেড়ে চলছে। এসব সমস্যা সমাধান করতে
না পারলে আমরা নতুন প্রজন্মকে সুন্দর জীবনাদর্শে গড়ে তুলতে পারব কেমন করে তা নিয়ে দেশের চিন্তাবিদরা চিন্তিত।
আমাদের
দেশের তরুণ সমাজ অনেক বেশি মেধাসম্পন্ন এবং বুদ্ধিমান, অনেক বেশি সৃষ্টিশীল এবং প্রতিভাবান।
আমাদের এই তরুণ সমাজ শুধু সুযোগের অভাবে এগিয়ে যেতে পারছে না। সরকারকে তরুণদের জন্য
নানাবিধ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার সময় এসেছে। দেশের মানুষ দেখছে নানাভাবে দেশের পয়সা
নষ্ট হচ্ছে, রাজনৈতিক কারণে অনেক পয়সা খরচ করা হচ্ছে। ওইসব অর্থ যদি নতুন প্রজন্মের
উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা যায়, খেলাধুলা বা আনন্দময় কাজের মধ্যে তাদেরকে ব্যস্ত রাখা
যায় তাহলে তরুণ সমাজের অন্যায় করার প্রবণতা অনেকাংশে কমে যাবে বলে অনেক সমাজবিজ্ঞানী
মত প্রকাশ করছেন।
তাই
সময় এসেছে আমাদের খুব যত্নের সাথে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের সন্তানরা কার সাথে মিশছে
কে তার বন্ধু। আমরা বাবা-মায়েরা সন্তানের বন্ধু হিসেবে তাদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে
গড়ে তুলবো এই হোক আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন