মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩


হজ্জ শর্ত সাপেক্ষে একবারই করণীয়
 
আল্লামা মোহাম্মদ সাদেক নূরী ॥ মানুষকে হজ্জের জন্য আহ্বান জানাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং প্রত্যেকটি কৃষকায় উটে চড়ে দূর দূরান্ত থেকে (২২ঃ২৭)। উক্ত আয়াত মর্মে মনে হয় হজ্জ একটি সনাতন আঞ্চলিক পর্ব। সে যাই হোক হজ্জ ইসলামী শরিয়তে অন্যতম বাধ্যতামূলক অনুষ্ঠান। ‘হজ্জ' শব্দের অর্থ কোনো কিছুর ইচ্ছা করা, আলোচনা বা বিতর্কে বিজয়ী হওয়া, কারো নিকট আসা-যাওয়া করা এবং নির্দিষ্ট মৌসুমে কাবা প্রদক্ষিণ করা। শেষোক্ত অর্থেই ‘হজ্জ' ইসলামী শরীয়তের অন্যতম অনুষ্ঠান হিসেবে মুসলিমদের দ্বারা পালিত হচ্ছে। সে সঙ্গে লাব্বায়েক লাব্বায়েক অর্থাৎ হে প্রভূ আমি তোমার সাক্ষাতে হাজির বলে গগনবিদারী আর্তনাদের মধ্যে প্রভূর সাক্ষাতের ইচ্ছা থাকাই সঙ্গত।
হজ্জের ঐতিহাসিক মূল্যায়ন, আরব ঐতিহ্য বৈশিষ্ট্য, আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম, আধ্যাত্মিক তাৎপর্য, আন্তর্জাতিক কার্যকারিতা, পারলৌকিক উপকারিতা অথবা হজ্জ করে হাজী বা আলহাজ্জ লেখার ‘অভিপ্রায়' বা সামাজিক ধ্যান-ধারণা অথবা মর্যাদা নিয়ে আলোচনা করা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি এখানে হজ্জের জন্য অর্থ ব্যয় এবং আর্থিক যোগ্যতা সম্পর্কে ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে দু'একটি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিবেচনা বা মতামতের জন্য কিছু প্রস্তাব রাখার চেষ্টা করবো।
আমরা সকলেই জানি যে, শরিয়ত মোতাবেক উপার্জিত অর্থে সবরকম দেনা পরিশোধ শেষে হজ্জ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের প্রয়োজনীয় ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করে যাওয়া-আসার খরচ বহন করার ক্ষমতা আর্থিক/শারীরিক যার আছে তার জন্য হজ্জ সম্পাদন করা ফরজ। এ প্রসঙ্গে স্পষ্টভাবে বলা দরকার যে, শরিয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ পন্থায় অর্থ সঞ্চয়ীর উপর হজ্জ ফরজ নয়, বরং হজ্জে ব্যয়ীতব্য অর্থ অবশ্যই শরিয়ত সম্মতভাবে উপার্জিত এবং শরিয়তের বিধান মোতাবেক যথানিয়মে যাকাত প্রদান ও অন্যান্য বাধ্যতামূলক খাতে ব্যয়ান্তে পবিত্র হতে হবে। বলাই বাহুল্য যে, যাকাত ছাড়া অন্যান্য বাধ্যতামূলক খাতগুলোর মধ্যে অভাবীর অভাব মোচন এবং অভূক্তকে অন্ন দান প্রধানতম। ‘তুমি অভাবীকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দিও না' (কুরআন) এবং রাসুলুল্লাহ বলেন - ‘যে প্রতিবেশীকে অভূক্ত রেখে পেট ভরে খায় সে আমার উম্মত নয়।'
উল্লেখ্য, যে রাসুলের উম্মত নয়, সে মুসলিমও নয়। তার জন্য হজ্জের প্রশ্ন অবান্তর। অপরদিকে উক্ত শর্তাদি সাপেক্ষে মুসলিমের জন্য হজ্জ কেবল একবারই ফরজ।
এমতাবস্থায় আমরা মনে করি, হজ্জযাত্রী ও হজ্জকর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সকলেরই নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক যে হজ্জে ব্যয়ীতব্য অর্থ পবিত্র  এবং তা ফরজ হজ্জ সম্পাদনে খরচ হচ্ছে। আর তা নিশ্চিত করতে হলে, আমাদের মতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা কর্তব্য যে ঃ
১। হজ্জের জন্য ব্যয়ীতব্য অর্থ বৈধ উপায়ে উপার্জিত কিনা।
২। এ অর্থের যাকাত প্রদান ও অভাবীর পাওনা শোধ করা হয়েছে কিনা।
৩। যিনি প্রায় তিন লক্ষ টাকা খরচ করে হজ্জে যান, তিনি বছরে কত টাকা কর দেন বা এ সঞ্চয়ের কর প্রদান করেছেন কিনা।
৪। তিনি সারা বছর শরিয়ত মোতাবেক চলেন বা অর্থ ব্যয় করেন কিনা এবং
৫। এটা তার প্রথম হজ্জ কিনা ইত্যাদি।
আমাদের মতে শরিয়তের বিচারে উক্ত বিষয়সমূহে ইতিবাচক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলেই কেবল কারো উপর হজ্জ ফরজ; তারই হজ্জ সার্থক এবং এরূপ ব্যক্তির ক্ষেত্রেই কেবল হজ্জ করতে যাওয়ার জন্য কষ্টার্জিত বিদেশি মুদ্রা খরচের অনুমতি শরিয়ত সম্মত। অন্যথায় হজ্জের নামে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ, শরিয়তের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট অপচয় এবং পাপ বলে গণ্য হবে। মনে রাখতে হবে, এর সাথে সমগ্র জাতির অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত এবং ভেবে দেখতে হবে, যারা হজ্জ করতে যান, তাদের ক'জন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন।
মোদ্দা কথা, যে সম্পদ শরিয়ত মোতাবেক বৈধ পন্থায় উপার্জিত নয়, যে সম্পদের যথারীতি যাকাত প্রদান করা হয়নি, যে সঞ্চয়ের কর পরিশোধ করা হয়নি, প্রতিবেশীকে অভূক্ত রেখে সঞ্চিত সম্পদ শরিয়তের দৃষ্টিতে অপবিত্র; সে অর্থে হজ্জ অর্থহীন ও বিফল এবং দ্বিতীয়বার হজ্জে অর্থ ব্যয় করার চেয়ে প্রতিবেশী অভাবী, রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় সেবামূলক ও উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা অতি উত্তম।
অতএব, এসব বিষয়ে বাসিধারণা ও আবেগমুক্ত মনে আন্তরিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেই কষ্টার্জিত এবং জাতীয় স্বার্থে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রা, প্রয়োজনে হজ্জ খাতে খরচ হওয়া বাঞ্ছনীয়। তা যদি করা যায় কেবল তাহলেই হতে পারে, শরিয়ত মোতাবেক ‘হজ্জ' অনুষ্ঠান বৈধ, সার্থক ও সফল; অন্যথায় এতে জাতীয় সম্পদের অপচয় ব্যতীত আর কী হতে পারে, নামের সাথে হাজী বা আল-হাজ্জ সংযোজন ছাড়া!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন