মানবাধিকার নৈতিকতার অংশ
ফরিদা
॥ সমগ্র বিশ্বজুড়ে আল্লাহর নবীদের আবির্ভাব থেকেই মানবতা বিষয়টি উচ্চারিত হয়ে আসছে।
ইতিহাস থেকে দেখা যায় যুগে যুগে বিশ্ববিবেক এই মানবতাকে কেন্দ্র করেই মানবাধিকারের
মৌলিক নীতিমালার প্রতি ভীষণ গুরুত্ব দিয়ে আসছে মানুষকে বিচিত্র বন্দীত্ব আর দায়বদ্ধতা
থেকে মুক্ত করার জন্যে এবং ব্যক্তি মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে ব্যাপক
চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেইসাথে ব্যক্তিস্বার্থে সমাজে বিদ্যমান জুলুম, নির্যাতন
ও সন্ত্রাস মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় সরকার কখনো সুদৃঢ় হয়েছে আবার
কখনোবা মদদ জুগিয়েছে আধিপত্য বিস্তারের জন্য।
প্রগতিশীল
মানুষ বিংশ শতাব্দি অতিক্রম করে নতুন একটি সহস্রাব্দে পা রেখেছে। নতুন এই সহস্রাব্দে
আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশ ও সরকারগুলো গনতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে অপরাপর
দেশের ওপর অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করেই চলছে। এই সরকারগুলো অন্যান্য দেশকে সকল ক্ষেত্রে
তাদের নির্দ্ধারিত মূল্যবোধসহ সকল আদর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য করতে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ
করছে। কিন্তু পশ্চিমা মানবাধিকার কতটা প্রাচ্যের সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা
তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কার্যক্রম গ্রহণ করছে না বলেই সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে
আজকে প্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ঐতিহ্য এবং মানুষের মৌলিক অধিকারের
ব্যাপারে সন্ধিহান হয়ে উঠছে।
মানবাধিকার
নৈতিক অধিকারেরই একটা দিক যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণভেদে সকল মানুষেরই সমান অধিকারের
বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়। সেইসাথে কে কোন সমাজের বা কোন ধরনের দল ও গোষ্ঠির সদস্য
সে বিষয়টির ওপর দৃষ্টি না দিয়েই অধিকারের ব্যাপারটির প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়। মানবাধিকার
একটি সার্বজনীন নৈতিক বিধান এবং সবারই দায়িত্ব এই বিধানকে মেনে চলা। আধুনিক এই বিশ্বে
মানবাধিকার পরিভাষাটির বয়স খুব বেশি নয়। বিংশ শতাব্দিতে তার উদ্ভব ও বিস্তার, বিশেষ
করে বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণা পর্যন্ত তার বিস্তার বলা যায়, তবে এই সংজ্ঞাটি বেশ পুরানো
যার ফলে ব্যবহারিক প্রয়োগ এর লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। মানবাধিকারকে বিশেষ কোনো
সভ্যতা কিংবা বিশেষ কোনো যুগের বা দেশের সাথে সম্পৃক্ত করা যায় না। সকল ধর্মশাস্ত্র
সকল মতাদর্শ এবং সাহিত্য ও দর্শনের মহান গ্রন্থগুলোতে তার উল্লেখ রয়েছে। বিশ শতকের
মাঝে এবং বিশেষ করে বিশ শতকের শেষের দিকে মানবাধিকার বিষয়ক বহু আন্তর্জাতিক সনদ গৃহীত
হয়েছে, এগুলো মানবাধিকারের উন্নয়ন ও বিকাশে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
মানবাধিকারের
কাঠামোগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গঠিত হয়েছে। বিশ্ব সমাজ হিটলারের নির্মমতা আর
অপরাধযজ্ঞের শিকার হয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা
করার জন্যে একটা কাঠামো বা সংস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুদ্ধে জড়িত দেশ এবং সরকারগুলো
চিন্তাভাবনা শুরু করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধরত দেশগুলোর কর্মকর্তাগণ সিদ্ধান্ত
নেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করবেন। অবশেষে ১৯৪৫ সালের
২৬ জুন জাতিসংঘের ঘোষণা তৈরি হয় এবং সদস্যদের স্বাক্ষর গৃহীত হয়। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক
সমাজ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বরে ‘বিশ্ব মানবাধিকার সনদ’নামক গুরুত্বপূর্ণ এই ঘোষণাটি পাশ করতে সক্ষম হয়।
এই মানবাধিকার ঘোষণাটিতে একটি ভূমিকা এবং জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক
স্বাধীনতা এবং অধিকারের মতো মৌলিক বিষয়গুলোর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই ঘোষণার অন্তর্নিহিত
অর্থ কাজে লাগানোর জন্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো যাতে মানবাধিকার রক্ষা করে চলে সেজন্যে
প্রয়োজনীয় চুক্তি বা স্মারকগুলোও পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে গৃহীত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ
এই সনদগুলোর মধ্যে রয়েছে গণহত্যা নিষিদ্ধকরণ বিষয়ক কনভেনশন, বর্ণ-বৈষম্য নিষিদ্ধ সংক্রান্ত
কনভেনশন, বর্ণবাদ বা বর্ণপূজা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত কনভেনশন, নির্যাতন-নিপীড়ন বিরোধী কনভেনশন,
নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য রোধ সংক্রান্ত কনভেনশন এবং শিশু অধিকার বিষয়ক কনভেনশন ইত্যাদি।
ইতিহাসে দেখা যায়, ধর্মগুলো মানবাধিকারের মূলনীতিগুলোর প্রতি খুবই গুরুত্ব দিয়েছে মানুষকে
বিচিত্র বন্দীত্ব আর দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্যে এবং মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা
অর্জনের জন্যে ব্যাপক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সেইসাথে সমাজে বিদ্যমান জুলুম, নির্যাতন
আর পেশী শক্তির মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে ছিল সুদৃঢ়। কুরআনে মানবাধিকারের মূলনীতিগুলোর
প্রতি ইসলামে পরিপূর্ণ ও সামগ্রিকভাবে বাস্তবতার আলোকেই যথার্থ দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের স্থান অনেক উর্ধ্বে। এতো উর্ধ্বে যে ফেরেশতাদের সেজদা পাবার
যোগ্য এবং আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর এই
সৃষ্টি মূল্যহীন হতে পারে না। পবিত্র কুরআনেও বহুবার মানুষের মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে
কথা বলা হয়েছে আবার অকৃতজ্ঞতার কথাও বলা হয়েছে।
মানবাধিকারের
গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো ব্যক্তি নিজের, পরিবারের, সমাজের তথা রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব
ও কর্তব্য পালনের পর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্ত জীবনযাপন। বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণায় এ
বিষয়টির ওপর পরিপূর্ণ জোর দেয়া হয়নি যথাযথভাবেই। ধর্মীয় চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে পৃথিবীর
প্রতিটি মানুষ স্বাধীন অবস্থায় জন্ম নিয়েছে, তাই তাদের অধিকার রয়েছে স্বাধীন জীবন যাপন।
দুঃখজনকভাবে বর্তমানে ধর্মীয় আধিপত্যবাদীদের দৃষ্টিতে স্বাধীনতার বাস্তব অর্থ হলো নীতি-নৈতিকতা
থেকে দূরে অবস্থানের স্বাধীনতা, লাগামহীনতা এমনকি অন্যদের অবমাননা করার স্বাধীনতা-যার
পরিণতিতে পতন আর বিচ্যুতির কোনো বিকল্প নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন