মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সময়ের সাফ কথা .... আত্মশুদ্ধির পথে জীবন উৎসর্গ

সময়ের সাফ কথা ....
আত্মশুদ্ধির পথে জীবন উৎসর্গ

আরিফিন হক ॥ ফতোয়া বিশ্বাসী মুসলমানগণ দাবি করেন  যে, পশু জবাই প্রথা ইব্রাহিম (আ.) থেকে এসেছে ফতোয়ার পক্ষে সুরা সাফফাতে বর্ণিত পিতা ইব্রাহিম কর্তৃক পুত্র ইসমাঈলকে জবাই করার কাহিনী উদ্বৃত হয়।  কুরআন মতে - ইব্রাহীম (আ.) একজন সৎসঙ্গীর জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তার প্রার্থনা পূরণ করেন এবং তাকে সৎসঙ্গী হিসেবে পুত্র সন্তান দান করেন।
সকল নবীর ন্যায় ইব্রাহিমও প্রথমে তার কওমকে ‘একত্ব দর্শনের পথে আহ্বান জানান। কিন্তু তার কওম তাকে প্রত্যাখ্যান করে। তার পিতাও তাকে প্রত্যাখ্যান ও বিতারিত করে। শাসকগোষ্ঠী তার উপর নির্যাতন করে এবং তাকে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে। তিনি দেশত্যাগ করেন। চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হন। একমাত্র ভক্ত লূতকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ‘একত্ব দর্শন প্রচারে প্রেরণ করেন। আজীবন চেষ্টা করেও তিনি বৈরী পরিবেশে ‘একত্ব দর্শন প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। এমন কোন ভক্তকে তিনি পান নি যে একত্বের পতাকা বহন করে নিয়ে যেতে পারে। এমতাবস্থায় একজন নবী তাঁর প্রতিপালকের কাছে সন্তান প্রার্থনা করতে পারেন না। তিনি প্রার্থনা করেছিলেন একজন শিষ্য। যে শিষ্য তার আদর্শকে বহন করবে এবং প্রতিষ্ঠিত করবে ‘একত্ব দর্শন। প্রার্থনার ফলস্বরূপ আল্লাহ তায়ালা তাকে সন্তান দান করলেন যেন শিশু কাল থেকে তিনি নিজ পুত্রকে শিষ্যরূপে আত্মশুদ্ধির শিক্ষা দিতে পারেন। পুত্রও পিতাকে গ্রহণ করলেন গুরু হিসেবে এবং গুরুর সাধন পদ্ধতি অনুযায়ী আত্মিক উৎকর্ষের লক্ষ্যে প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরম জ্যোতি অর্জনের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠলেন। তাই আসে পরীক্ষার সময়। এই পরীক্ষা শিষ্য ইসমাঈলের। গুরু ইব্রাহিম আল্লাহর হুকুমে শিষ্য ইসমাঈলকে উৎসর্গ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। শিষ্য পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত তাই গুরুর ইচ্ছাতে নিজের ইচ্ছাকে সমর্পণ করে বললেন - ‘হে গুরু! আপনি যে হুকুম প্রাপ্ত তাই হোক। আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। উভয়ে যখন উৎসর্গ পর্বের শেষ মুহুর্তে উপনীত হলেন তখন পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হলো - ‘হে ইব্রাহিম তোমার প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছে, তুমি ‘একত্ব দর্শনকে বহন করার জন্য যোগ্য শিষ্য পেয়ে গেছো। নিশ্চয়ই আমরা এইভাবেই সত্যান্বেষীদের পুরস্কৃত করি।
ভক্তের যা কিছু আছে তার সবই গুরুর। গুরুর নির্দেশে জীবন উৎসর্গ করতেও ভক্ত দ্বিধা করে  না, ভীত হয় না। গুরুর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, আত্মসমর্পণ ও প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গের নামই হলো ঈমান, ইসলাম, ও ইহসান। ইসমাঈল (আ.) গুরুর প্রতি আনুগত্যের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তার শিক্ষা হলো ভক্ত যেন দেহমনে গুরুর হয়ে যায়। গুরুর নির্দেশে নিজ প্রাণকেও যেন তুচ্ছ মনে করে। রসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের ভক্তগণও তার প্রতি এমনই নিবেদিত ছিলেন। রসূলের নির্দেশে ভক্ত পিতা তার নিজ পুত্রকে এবং ভক্ত পুত্র তার নিজ পিতাকে উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করেন নি। কিন্তু এখন ইব্রাহিম ও ইসমাঈলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে যে পশুজবাই চলছে তাতে হাসি-খুশী, খেল-তামাশা ব্যতীত  ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতার কিছু নেই, কিছু নেই।
ইব্রাহিমের আদর্শ হলো গুরুর নির্দেশে পুত্রস্নেহ ত্যাগ, ইসমাঈলের আদর্শ হলো গুরুর নির্দেশে  জীবন বিসর্জন। ইব্রাহিম ত্যাগ করেছিলেন স্নেহ, ইসমাঈল জীবন। কুরআন এবং নবী মোহাম্মদ (সা.) এঁর শিক্ষার সারমর্ম হলো - গুরুর নির্দেশে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুতি ও শক্তি অর্জন করা। ইসমাঈল (আ.) গুরুর ছুরির নিচে যেভাবে মাথা পেতে দিয়েছিলেন সেভাবে গুরুর নির্দেশে ছুরির নিচে মাথা পেতে দেওয়ার প্রস্তুতি।
পশু কখনও ছুরির নিচে মাথা পেতে দেয় না। হাত হাত পা বেঁধে বলপূর্বক পশু জবাই করা হয়। সতুরাং পশু জবাইয়ের মধ্যে শিক্ষণীয় বলতে কিছু নেই, আদর্শ বলতেও কিছু নেই।
গুরু শিষ্যকে উৎসর্গ করবেন। শিষ্য নির্ভয়ে গুরুকে দেবেন গলা কাটার সম্মতি। গুরু-শিষ্যের প্রেমের কোন তুলনা নেই। গুরুর আদেশে প্রসন্ন চিত্তে ছুরির নিচে মাথা পেতে দিতে কতটুকু মনোবলের দরকার তা উপলব্ধির বিষয়। নিজ জীবনের উপরে যে গুরুর স্থান ইসমাঈল আলাইহিস্‌ সালামের জীবনে তা সত্য হয়ে ফুটে উঠেছে। গুরুপ্রেমের কাছে পার্থিব ভালবাসা, জীবন এমনকি দুনিয়ার সবকিছুই তুচ্ছ। উৎসর্গ এমনই হয়। (২ পৃষ্ঠা ৩ কলাম)
উৎসর্গ তখনই করা যায় যখন পশু গলা পেতে দেয় জবাই করার জন্য। একটি পশুও যদি গলা পেতে দেয় তাহলে কি তাকে আর জবাই করা যাবে? পশু যদি সেই যোগ্যতা অর্জন করে তবে তাকে জবাই করতে লজ্জা কি মানুষ পাবে না! কোন মানুষ কি পারবে প্রসন্ন চিত্তে জবাই হতে সম্মত একটা পশুকে জবাই করতে? পারবে না। দয়া ও করুণা এসে থামিয়ে দেবে ছুরি। পশুটি বেঁচে যাবে, উৎসর্গও কবুল হবে। যোগ্য শিষ্য ব্যতীত গুরু কোথায় পাবেন তেমন উৎসর্গ!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন