আপনি আপনার মনের জান ঠিকানা
পরের অন্তর সে যে সমুদ্দুর, কিসে যাবে জানা।
সংলাপ
॥ উন্মুল স্বদেশ ভাসছে সময়ের স্রোতে। ভুগছে পরিচয়-সঙ্কটে। নদ-নদী বিধৌত এ বঙ্গভূমির
মানচিত্র বার বার শিকার হয়েছে ভাঙ্গা-গড়ার। নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে এর পরিচয় বিভ্রান্তি।
অভিন্ন আকাশ, অভিন্ন মাটি আর জলবায়ুতে হাজার বছরে বেড়ে ওঠা এই জনপদের মানুষগুলো পরস্পর
ভিন্ন হয়ে পড়ে পরিচিতির প্রশ্নে। দু’শ বছরের ইংরেজ শাসন আর ১৯৪৭-এর ঐতিহাসিক প্রতারণা
এই পরিচয় বিভ্রান্তিকে ঠেলে দেয় আরো অতলে। সিকি শতাব্দির লড়াই- সংগ্রাম আর কঠিন ‘ঠেকে
শেখার’ বিনিময়ে ১৯৭১-এ এসে খন্ডিত বাংলার পূর্বাঞ্চলের মানুষ খুঁজে পায় আপনারে। ‘বাংলা
আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা-আমি বাঙালি।’ এই শাশ্বত সত্য ধরা পড়ে উপলব্ধিতে।
তবে
সে উপলব্ধি ধরে রাখা যায়নি স্থায়ীভাবে। মানচিত্রের বিভক্তির মতই বাঙালি জাতি জড়িয়ে
পড়ছে সর্বনাশা মানসিক বিভক্তিতে। টান পড়ছে খোদ জাতিসত্ত্বার মূলে। মানুষে-মানুষে, বাঙালি-বাঙালিতে
ভেদাভেদ আজ বর্তমান। অথচ, সেই মধ্যযুগেই বাঙালি কবি চন্ডিদাস বলেছিলেন-
শোন
হে মানুষ ভাই
সবার
উপর মানুষ সত্য
তাহার
উপর নাই।
গত
শতাব্দীর গোড়ায় সাধক নজরুল ইসলাম বলেছিলেন -
ওরা
হিন্দু না মুসলিম
ঐ
জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী-
বলো ডুবিছে মানুষ
সন্তান
মোর মা’র।
একই
জনপদে একই জলবায়ুতে অভিন্ন ভাষা, অভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব
পরিচিতিটাই বড় এবং প্রথম। সত্যকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে বুঝে বা না বুঝে প্রতিনিয়ত
নিজের সাথে নিজে প্রতারণা করে চলেছি আমরা। আজ প্রয়োজন এই আত্মপ্রতারণার আঁধার থেকে
বেরিয়ে আসা।
সত্যমানুষ
লালন সাঁঈজী ঠিক এক্ষেত্রেই গোটা বাঙালি জাতিকে দেখিয়ে গেছেন আলোর পথ। ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাতের
উর্দ্ধে উঠে গিয়ে গেয়েছেন শাশ্বত মানবতার জয়গান। অকুতোভয়ে উচ্চারণ করেছেন -
এমন
মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন
হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীস্টান
জাতি
গোত্র নাহি রবে।
সাঁঈজীর
এই আদর্শ মানব সমাজ প্রতিষ্ঠা আজ নতুন শতকের দাবি। বাঙালি জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব ও
বিকাশের জন্য তা জরুরীও বটে।
সুপ্রাচীন
কাল থেকেই বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ‘বাউল’ মতের মূল ভাবধারা।
কালক্রমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্ম-দর্শন ও সাধনার সমন্বয়ে এ ধারা আরো সমৃদ্ধ ও ব্যাপকতা
লাভ করেছে। ড. আহমদ শরীফ বলেছেন “বিভিন্ন মতবাদের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাউল মত। হিন্দু-মুসলমানের
মিশ্রনে হয়েছে বাউল সম্প্রদায়, তাই পরমত সহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গ্রহণশীলতা, বোধের
বিচিত্রতা, মনের ব্যাপকতা ও উদার সদাশয়তা এদের বৈশিষ্ট্য। বৈশিষ্ট্যে ও বৈচিত্র্যে
এই বাউল মতধারার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে উনিশ শতকের বাউল সাধক লালন সাঁঈজীর সাধনা ও সৃষ্টির
সম্ভারে।
বাঙালি
সংস্কৃতিতে ‘লালন’ একটি অপরিহার্য নাম। একজন কুঠিবাসী সত্যমানুষ মধ্য যুগের শেষ প্রান্তে
দাঁড়িয়ে যে সত্য-দর্শনের ভেদ উন্মোচন করে দিয়ে জীবনকে সুন্দর করার মহান পথ বাতলে দিয়েছেন
তা বর্তমান আধুনিক যুগেও প্রত্যেক বাঙালিকে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
তথাকথিত
সভ্য সমাজের শহুরে সভ্যতার কৃত্রিম বলয়ে নিজেকে নিপতিত না করে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় নির্জন
গ্রামীণ পরিবেশে আর্তজনের আত্মার আত্মীয় হয়ে স্বকীয় সাংস্কৃতিক আবর্তে লালন হয়ে উঠেছেন
চিরন্তন এক সত্তা ও বোধ। অসাধারণ প্রজ্ঞায় ও ধর্মতত্ত্বের দ্বারা তিনি পথভ্রষ্ট মানুষকে
দিয়েছেন সৎ-সত্য পথের দীক্ষা। ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘বাউল ধর্ম সম্প্রদায়
আর্য-অনার্য, হিন্দু, বৌদ্ধ ও সূফী ভাবধারার সমন্বয়ে গঠিত বাংলার একান্ত নিজস্ব একটি
ধর্ম সম্প্রদায়। এই ধর্ম কোন অভিজাত সম্প্রদায়ের ধর্ম নয়। এটা জনসাধারণের ধর্ম। লৌকিক
ধর্ম। আমরা জানি, ধর্ম সংস্কৃতিরই একটি অঙ্গ। সুতরাং বৃহৎ চিন্তায় আমরা বলতে পারি লালন-সংস্কৃতি
বাংলার একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতি বাঙালিরই সংস্কৃতি।’
সভ্যতার
ক্রমবিকাশে এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, প্রতিটি ধর্মকেই বাঙালি তার সংস্কৃতির সাথে মিশ্রিত
হওয়ার সুযোগ দিয়েছে সাগরের মতো উদার হয়ে। তাই প্রতিটি ধর্ম সম্বন্ধীয় মতবাদ থেকেই বাঙালি
তার জন্য প্রযোজ্য সত্যকে অনুসন্ধান করে নিজেকে করেছে সমৃদ্ধ। ধর্মীয় চেতনাগত সত্যে
বাঙালি গড়ে তুলেছে ঐক্যের বন্ধন। এই চেতনিক ঐক্যে বাঙালি খুঁজে পেয়েছে শান্তির ঠিকানা।
যার জন্য সত্যমানুষ লালন সাঁঈজীর কাছে এসে বাঙালিকে ঋণী হতেই হয়। চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব
শান্তি-ধর্ম এর দিক নির্দেশক হিসেবে তাঁকে অর্পণ করে হৃদয়ের অকৃত্রিম শ্রদ্ধার্ঘ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন