অর্থনৈতিক গণতন্ত্র
সংলাপ
॥ দেশের রাজনীতিকরা স্বতঃসিদ্ধ বলে হয়তো ধরে নিয়েছেন যে, সমাজে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য
থাকবেই। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের চলমান অমিল বোধহয় এখান থেকেই শুরু। প্রকৃতি তার উন্মুক্ত
আকাশ, বিশুদ্ধ বাতাস এবং অপরিমিত জলসম্পদ দিয়ে আমাদের সবাইকে ধনী করে রেখেছে। আমরা
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে প্রকৃতির অকৃপণ দান পাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রেণীবৈষম্য তৈরি করে
চলেছি। সামাজিক ধনসম্পদের বৃহৎ অংশ কতিপয়ের গুদামে ঢুকবে আর গণমানুষের অধিকাংশ ক্ষেত্রে
আমের শাঁসটুকু নিংড়ানো আঁটিটি ভাগ্যে জুটবে এটাই ভবিতব্য।
অবিভক্ত
বাংলার রাজনৈতিক নেতা ফজলুল হক একটা বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, ‘দুটো বোকা লোক তালগাছের
তলা দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ধুপ করে তাদের সামনে একটা তাল ভূমিতে পড়লো। দু’জনাই দৌড়ে তালটার
মালিকানা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করল এবং প্রায় একই সঙ্গে তালটাকে ছুঁয়ে ফেলল। তারপরে শুরু
হল কাইজা। এ বলে আমি ধরেছি ও বলে আমি। কাইজা চরম স্তরে পৌঁছল। পাশ দিয়ে এক ধূর্ত যাচ্ছিলেন।
তিনি এগিয়ে এসে বললেন, তোমাদের কলহের কারণটা কী? দুজনেই চিৎকার করে তালটির মালিকানা
দাবি করতে থাকল। ধূর্ত লোকটি তাদের বোঝালেন, এসো তোমাদের কলহের মীমাংসা করে দিচ্ছি।
তার নির্দেশমতো তালটিকে খুলে ফেলা হল। দেখা গেল ভেতরে তিনটা কোয়া। দাবিদার দুজনের মধ্যে
সেটা সমান ভাগ করা সম্ভব নয়। তখন ধূর্ত লোকটি বললেন, এক কাজ কর, তোমরা দুজনাই একটা
করে কোয়া নাও আর একটা আমার কাছে থাকুক। যে যখন আমার পেছনে ঘুরঘুর করবে তার জিহ্বায়
একটু ঠেকিয়ে দেব। এই সূত্রেই মীমাংসা চিরকালীন রূপ পেল। সমাজের উৎপাদিত ধনসম্পদ সমভাবে
বণ্টন অসম্ভব। তাই ধূর্ত পণ্ডিত, শাসক, এবং তাদের শক্তির আধার ব্যবসায়ীরা এক একটা করে
ফাউ কোয়া নিয়ে সম্পদ সৃষ্টি ও সঞ্চয় করে চলেন এবং তা গুদামে ভরে রাখেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
বায়ান্ন সালের পর ভারতবর্ষের প্রয়াত পন্ডিত জওহরলাল নেহরু জেল থেকে বেরিয়ে এসে শুনলেন
দুর্ভিক্ষের তাড়নায় হাজারে হাজারে দরিদ্র মানুষ, বৃদ্ধ, শিশু অনাহারে প্রাণ দিয়েছে।
আর ব্যবসায়ীরা লক্ষ লক্ষ মানুষের খাবার গুদামজাত করে রেখেছেন। তিনি প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ
হয়ে বলেছিলেন যে, এরা না মরে লুঠ করে খেতে পারল না! আমার ক্ষমতা থাকলে এই সমস্ত কালোবাজারি
মজুতদারদের পাশের ল্যাম্প পোস্টে ঝুলিয়ে দিতাম। কিন্তু তিনি একজন কালোবাজারিকে বা অসাধু
ব্যবসায়ীকে ল্যাম্প পোস্টে টাঙাতে পারেননি। তারপরে একবার নির্বাচনের সময় দেখা গেলো
হাজার হাজার নেহরু ল্যাম্প পোস্টে ছবি হয়ে ঝুলছেন। গোটা বিশ্বের মনুষ্য সমাজে এটাই
রীতি। এ দেশে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, লালন সাঁইজী ও বিবেকানন্দের মতো কিছু মানুষ জন্মেছিলেন।
তাবত বিশ্বের ক্ষেত্রেও এই কথাটা বলা যায়। তাঁরা যুগ যুগ ধরে দরিদ্র, বুভুক্ষু, অন্নহীন,
বস্ত্রহীন, শিক্ষাহীন, স্বাস্থ্যহীন মানুষদের পক্ষ হয়ে কথা বলেছেন। তাঁরা এর থেকে মুক্তির
জন্য নানা পথের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁরা এতছত্রে ও সর্ব অর্থে বলবান। কতিপয় রাজনীতিক
ব্যবসায়ী ধর্মের নামে, সংস্কৃতির নামে, রাজনীতির নামে, দেশপ্রেমের নামে, জনসেবার নামে
সে পথগুলো অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে চলার রাস্তা খুঁজে বের করে নিয়েছেন। বেহুলার বাসরঘরে
একটি ছিদ্র বিষধরের প্রবেশকে নিশ্চিত করতে পারে। এ তো শতছিদ্রের কাহিনী। গোটা দুনিয়ায়
লক্ষ লক্ষ শিশুর শৈশব কেড়ে নেয়া হচ্ছে। যৌবন দুঃসহ ভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। আর বার্ধক্যের
মসজিদ বা মন্দির সে তো নরকবাস। পশ্চিমের উন্নত সভ্য জাতগুলো চীনের মতো এত বড় দেশকে
আফিমের বিষ দিয়ে নির্জীব করে রাখতে পেরেছিল।
অবস্থার
পরিবর্তন এবং এক ধরনের একটা উন্নয়ন প্রচেষ্টার চেষ্টাও যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। দুটো
শিল বিপ্লবের পর উন্নয়নের ধন সৃষ্টি ও সম্পদ বৃদ্ধির জোয়ার এসেছে। পৃথিবী প্রথম, দ্বিতীয়,
তৃতীয় বিশ্বে ভাগ হয়ে গেছে। বিদেশীরা আমাদেরকে তৃতীয় বিশ্বের লোক বলে। কেউ জোর গলায়
বলেনি বা বলছেনা, পৃথিবী একটাই, সেটা প্রকৃতিসৃষ্ট। আর প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ব্যাপারটা
কিছু মানুষের চতুরতা। এই যে পৃথিবীব্যাপী ধনবৈষম্য, অর্থনৈতিক দিক থেকে শ্রেণী বিভাজন,
উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেটা নতুন রূপ নিয়ে চলমান। সমাজের মূল ভিত অর্থনৈতিক
ব্যবস্থা এবং তার ওপর নির্ভর করেই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো
গড়ে উঠেছে এবং উঠছে। শেষ পর্যন্ত অর্থব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে তারাই প্রকৃত
অর্থে দেশের মালিক সেজে বসে আছেন। তাদের ব্যবস্থাটাকে
কায়েম রাখার জন্য ধনকুবেররা নানান ধরনের ছাতা মাথার ওপর ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছেন।
এই ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক এবং স্থায়ীকরণের জন্য এক ধরনের সামাজিক পরিকাঠামো জন্ম নিচ্ছে।
ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জাতিতে জাতিতে, বর্ণে বর্ণে ভেদাভেদ এবং সর্বোপরি
সামরিক ক্ষমতা এই ব্যবস্থাকে প্রতিবাদী উত্তাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
যুগে যুগে এই প্রতিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে এবং শক্তিধররা মূল চরিত্র বজায়
রেখে কিছু কিছু সমঝোতা করার চেষ্টা করে চলেছেন। ফ্রান্সের বিপ্লব গোটা পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক
শোষণের সুযোগ শেষ পর্যন্ত সালিশি করে হয়ত অর্জন করেছে কিন্তু অর্থনৈতিক গণতন্ত্র কোথাও
স্বীকৃত হয়নি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন