বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৪

কল্পনা ও সত্য



কল্পনা ও সত্য

আইনুল হাফিজ ॥সারভানতেস- এর ‘ডন কুইক্সোট’ স্পেন সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস। বই পড়তে পড়তে বইগুলোতে ঘটে যাওয়া অসম্ভব ঘটনাগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করেন গ্রামের এক বয়ষ্ক ভদ্রলোক। নিদ্রাহীনতা, ক্ষুধা ও অতিরিক্ত পড়াশুনায় তার মতিবিভ্রম ঘটে। কল্পনাকে তিনি গ্রহণ করতে লাগলেন সত্য হিসেবে। এক পর্যায়ে তিনি তার পুরানো বর্ম, হেলমেট পড়ে নিজেকে ঘোষণা করলেন ডন কুইক্সোট হিসেবে, বেরিয়ে পড়লেন এডভেনচারে। এডভেনচারে বেরিয়ে অতি উৎসাহী, অতি উত্তেজিত ডন কুইক্সোট কান্ড জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। ভেড়ার পালকে তার মনে হলো সৈন্যবাহিনী আর দাসদের মনে হলো অত্যাচারিত ভদ্রলোক। এক ব্যক্তিকে তিনি আক্রমন করে বসলেন অন্যায়কারি দৈত্য মনে করে। এক বালককে মুক্ত করলেন যার মনিব তাকে গাছে বেধে রেখেছিল, পাওনা মজুরি চাইতে গিয়েছিল বলে। ফেরার পথে ডন কুইক্সোট ব্যবসায়ীদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন যারা তার কল্পনার নায়িকাকে অপমান করেছিল। ডন কুইক্সোট তার নিজস্ব কল্পনার জগত গড়ে তুলেছিলেন অতি নিষ্ঠা আর যত্নের সাথে। নিজের গ্রাম লা মনচাতে একসময় ফিরে আসেন এই নায়ক। মানসিকভাবে সুস্থ হওয়ার পর ঐসব বইয়ের সাথে তার সব সম্পর্কের অবসান ঘটে। মৃত্যুশয্যায় তিনি তার অতীত এডভেনচারের নির্বুদ্ধিতা ও পাগলামীর কথা স্বীকার করেন।
ডন কুইক্সোটের মত এমন অনেক মানুষই আছে আমাদের সমাজে যারা কল্পনার অলিক জগতে বিচরণ করেন আর বিভিন্ন কাল্পনিক ঘটনা ও চরিত্র তৈরি করে আক্রমন চালান শব্দের তলোয়ারে। এমন লোকেরও অভাব নেই যারা কল্পনাকে ধরে নেন সত্য।  আমাদের দেশে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও আছে যারা ধ্যানের নামে ‘কল্পনা চিকিৎসা’ শিক্ষা দেয় মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে।
কল্পনা কাকে বলে? পূর্বে যেসব বিষয় প্রত্যক্ষ করা হয়েছে তার প্রতিরূপের নূতন আকার ও অবস্থা সম্বন্ধে চিন্তা করাকে বলা যায় কল্পনা। কল্পনাও এক প্রকারের চিন্তা। স্মরণের সাথে কল্পনার পার্থক্য হলো: স্মরণের ক্ষেত্রে পূর্ব-প্রত্যক্ষ বিষয়ের প্রতিরূপের সম্বন্ধ পূর্বের মতই থাকে কিন্তু কল্পনার ক্ষেত্রে এই সম্বন্ধ নূতন। কল্পনায় অতীত অভিজ্ঞতাকে নূতনভাবে সাজিয়ে নূতন ইন্দ্রিয় ছাপ গঠন করা হয়।
চোখের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষানুভূতি অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষানুভূতির চেয়ে প্রবল। তাই শ্রবণকল্পনা, স্পর্শকল্পনা, ঘ্রাণকল্পনা ও স্বাদকল্পনার চেয়ে দর্শনকল্পনা শক্তিশালী। প্রত্যক্ষণের জন্য চক্ষু আছে, শ্রবণের যেমন কর্ণ, কিন্তু কল্পনা করার জন্য কোন বিশেষ অঙ্গ নেই।
স্মৃতি এবং কল্পনার দিকে প্রথম দৃষ্টিতেই প্রতীয়মান হয় যে, স্মৃতি কল্পনার চেয়ে অধিকতর জীবন্ত। স্মৃতি যতটা স্পষ্টতর রঙে রঞ্জিত, কল্পনা ততটা নয়। কল্পনার প্রত্যক্ষণ ক্ষীণ ও নিস্তেজ। কল্পনাকে প্রয়াস ব্যতীত একইরূপে বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না কিন্তু স্মৃতিতে ডুবে থাকা যায়। স্মৃতি ও কল্পনার মধ্যে আরও স্পষ্ট পার্থক্য হলো: স্মৃতি সীমিত, কল্পনা সীমিত নয়। স্মৃতির ঘটনাক্রম ইচ্ছেমত সাজানোর সুযোগ নেই কিন্তু কল্পনার জগতে সে সুযোগ অবারিত। স্মৃতিকে পরিবর্তন করা যায় না কিন্তু কল্পনাকে যতবার ইচ্ছা পরিবর্তন, পবির্ধন করা যায়। স্মৃতিতে ঘটনার মৌলিক রূপ সংরক্ষিত থাকে। স্মৃতির ত্রুটির কারণে বিষয়বস্তু' স্বরূপ হতে বিচ্যুত হতে পারে, আগের ঘটনা পরে এবং পরের ঘটনা আগে স্মরণে আসতে পারে কিন্তু ঘটনার বিন্যাসের দিকে সচেতন দৃষ্টি দিলে প্রকৃত ঘটনা উদ্ধার করা অসম্ভব নয়। স্মৃতি কেবল বিষয়বস'কে সংরক্ষণই করে না, ঘটনা ক্রম অনুযায়ী সাজিয়েও রাখে। কোনরূপ বিচ্যুতি না ঘটিয়ে একই কল্পনার পুনরাবৃত্তি যদি করা হয় তবে তাকে কল্পনা না বলে কল্পনার স্মৃতি বলাই উত্তম। কল্পনায় ঘটনাসমূহ বিন্যাসের স্বাধীনতা অবাধ।
কল্পনা সত্য কেবল কল্পনার জগতেই। বাস্তব জগতে কল্পনা ও সত্যের মধ্যে পার্থক্য অনেক। সীমিত কিছুকে অসীম হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে। কল্পনা আমাদেরকে সত্য থেকে দূরেও নিয়ে যেতে পারে। নদীর এপারে বসে যদি আমরা কল্পনা করতে থাকি যে ওপার আরও অনেক বেশি সুন্দর তাহলে এ পাড়ের উপর আমাদের বিতৃষ্ণা জন্মাতে পারে। অবস্থার আরও অবনতি ঘটার সম্ভাবনা থাকে যদি কল্পনায় প্রভাবিত হয়ে নৌকা নিয়ে আমরা ওপাড়ের দিকে যাত্রা শুরু করে দেই। ওপাড়ে গিয়ে যদি আমরা এপাড়ের চেয়ে খারাপ অবস্থা দেখি তাহলে হতাশাগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক।
তবে, কল্পনা সত্য উপলব্ধিতেও সহায়ক হতে পারে আবার সত্যও কল্পনাকে আশ্রয় করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিকগণ কল্পনার মাধ্যমে সত্যকে আবিষ্কার করেন। চিত্রশিল্পীদের জন্য কল্পনা একান্ত আবশ্যক। যার কল্পনা শক্তি যত বেশি তার ছবি তত বেশি সৃজনশীল হয়। একজন কবি যখন কবিতা লেখেন তখন তিনি কল্পনার আলোতে সত্যকে দেখেন। শব্দের ছন্দে যখন তিনি কল্পনাকে প্রকাশ করেন তখন তা সত্য ও সুন্দর। অর্থাৎ কল্পনা আমাদেরকে সত্য-মিথ্যা দু’টো দিকেই নিয়ে যেতে পারে।
সত্যের আধার কল্পনা নয়- আত্মা। আত্মা কল্পনা করে না। আত্মায় যখন সত্য উন্মোচিত হয়, সত্যে বসবাস করে তখন কল্পনার কোন প্রয়োজনীয়তাই থাকে না। প্রেমিকের চোখের সামনে যখন প্রেমাস্পদ বসে থাকে তখন প্রেমিক প্রেমাস্পদের কথা কল্পনা করে না। সত্য জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয়কে একাকার করে। তাই সত্যের কল্পনার প্রয়োজন নেই। একত্বের উপলব্ধি কল্পনা নয়- সত্য। সীমাকে অসীম রূপে কল্পনা করা আর অসীমকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করা এক নয়।
আত্মায় যখন সত্য উন্মোচিত হতে থাকে, মিথ্যার আবরণগুলো যখন উড়ে যেতে থাকে তখন কল্পনা বিশেষ শক্তি সঞ্চার করে সত্যের উন্মোচনকে তরান্বিত করতে পারে।
আত্মা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে, দেখতে পারে, সনাক্ত করতে পারে কিন্তু আত্মা নিজে থেকেই সত্যকে দেখে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না দেহের সব শক্তি এ কাজে নিয়োজিত হয়। কল্পনায় সত্যকে দেখা হবে অলীক প্রত্যক্ষণ। কিন্তু কল্পনার শক্তি দিয়ে মিথ্যার আবরণগুলো উন্মোচনের প্রচেষ্টা অলীক প্রতক্ষণ নয়, আত্মাকে সত্য দেখার জন্য সহায়তা করা।
সফলতার কল্পনা যেমন আমরা করতে পারি তেমনি করতে পারি ব্যর্থতার কল্পনা। আমরা প্রেমের কল্পনা যেমন করতে পারি তেমনি পারি ঘৃণার কল্পনা করতে। ঘৃণার কল্পনা যদিও কল্পনাই কিন্তু কীভাবে আমাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা ও অস্থিরতার সৃষ্টি করে তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি।
কিন্তু কল্পনা-বিলাসিতা মানুষকে অলস করে দেয়। কেবল কল্পনা দ্বারা সত্য- মিথ্যা হয় না কিংবা মিথ্যা- সত্য হয় না। সিন্দাবাদের ভূত, সাদ্দাদের বেহেশত, হনুমানের পর্বত বহন, দৈত্যের বাড়ি, পঙ্খীরাজ ঘোড়া, মধুর নহর, দশ মাথা তাল গাছ আমরা কল্পনা করতেই পারি। এমনকি এসব কল্পনায় দেখা ছবি আমরা এঁকেও দেখাতে পারি। কিন্তু পঙ্খীরাজ ঘোড়ার ছবির পিঠে বসে আকাশে উড্ডয়ন করা যায় না। কল্পনার সাথে বিশ্বাস যুক্ত না হলে কল্পনা সহায়ক শক্তি হয় না। চোখ বন্ধ করে কল্পনায় এখনই আমরা চাঁদে চলে যেতে পারি। কল্পনায় যেহেতু চাঁদে চলে গেছি বাস্তবে আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই এমন সিদ্ধান্ত নিলে আমরা আর অগ্রসর হতে পারবো না। কল্পনার সাথে যদি বিশ্বাস থাকে যে, হ্যাঁ বাস্তবেও আমি চাঁদে যেতে পারবো এবং যাবো তাহলেই কেবল কল্পনা সৃজনশীল হয়। নিজের শক্তির উপর বিশ্বাস থেকেই আসে চলার গতি। যদি চাঁদ সত্যিই থাকে এবং আমার বিশ্বাসও থাকে যে চাঁদে আমি যেতে পারবো তাহলে চাঁদে যাওয়ার কল্পনা আমার দৈনন্দিন কর্মতৎপরতায় তন্ময়তা সৃষ্টি করবে। বিশ্বাস কল্পনাকে থামতে দেয় না, দিক্‌ পরিবর্তন করতে দেয় না। যদি আমাদের উপলব্ধিতে আসে যে, কল্পনার সাথে বিশ্বাসের সংযোগ নাই তাহলে কল্পনা আমাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে।
বিশ্বাস স্বতঃস্ফূর্ত। কল্পনা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। যখন বিশ্বাস কল্পনার সাথে যুক্ত হয় তখন তা বুঝা যায়। কারণ বিশ্বাসের সাথে আত্মায় প্রবেশ করে সত্যের কিরণ। বিশ্বাসের মধ্যে সত্য বেড়ে ওঠে। কারণ বিশ্বাস সত্যের বেষ্টনী, সত্যের আবরণ উন্মোচনকারী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন