মঙ্গলবার, ২৮ মে, ২০১৩

মাদ্রাসা শিক্ষা কি ধর্ম শিক্ষা !


মাদ্রাসা শিক্ষা কি ধর্ম শিক্ষা !

 

সংলাপ ॥ এদেশে মুসলমানের ছেলেদের ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য রয়েছে বিশেষ ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসা শিক্ষা বলে পরিচিত রকমারী এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ত্ব রয়েছে দেশ জুড়ে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে এর সংখ্যা ১৫ হাজার ৫শ ৪১টি। এর মধ্যে এবতেদায়ী মাদ্রাসা (প্রাথমিক, শিক্ষাকাল ৫ বছর) মোট ৯ হাজার ৫শ ৬১টি, দাখিল (মাধ্যমিক, শিক্ষাকাল ৫ বছর) মাদ্রাসা রয়েছে ৪ হাজার ১শ ২১টি, আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক, শিক্ষাকাল ২ বছর) মাদ্রাসার সংখ্যা ৮শ ৮১টি এবং কামিল (স্নাতকোত্তর, শিক্ষাকাল ২ বছর) মাদ্রাসার সংখ্যা ১শ ৭টি। বর্তমানে সব মিলিয়ে প্রায় দুই লক্ষাধিক।

দেশে এই বিপুল পরিমাণ মাদ্রাসার অস্তিত্ব দেখে কারো মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, এই পূণ্য(!) উদ্যোগটি এদেশে কে বা কারা নিয়েছিল? এই বিপুল পরিমাণ মাদ্রাসা সৃষ্টির জাগরণটিই বা কখন হলো? ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি থেকে শুরু করে শত শত বছরে কয়েক'শ মুসলিম নৃপতি, ভূপতি তথা রাজা-বাদশা এই বঙ্গভূমি শাসন করে গেলেও কেউ মুসলমানের সন্তানকে 'জবরদস্ত' মুসলমান বানানোর জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করেননি। ভারতবর্ষ দখলের পর 'খ্রীষ্টান'(!) ইংরেজরাই কেবল মুসলমানদের ইসলাম শিক্ষার জন্য 'মাদ্রাসা' স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো! আর 'ইসলাম দরদী' (?) ইংরেজ শাসক লর্ড হেস্টিংস তাই ১৭৮০ সালে কোলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

ইসলাম শিক্ষা দেয়ার মহান (!) ব্রত নিয়ে এই আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর তার প্রথম অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন একজন ইংরেজ (নও মুসলিম নয় !)। শুধু তাই নয় এর পরিচালনা পরিষদের ঈমানদার (?) ইংরেজদের রাখা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯  সালে ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয় এবং সে বছরই মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালে এই বোর্ডকে নতুন করে গঠন করা হলেও ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন প্রদান করেন এবং জিয়া ১৯৮০ মাদ্রসা শিক্ষকদের জন্য বেতন কাঠামো প্রদান করেন।

এর ফলে সরাসরি রাষ্ট্রীয় অর্থানুকূল্যে দেশ জুড়ে হু হু করে গড়ে উঠতে থাকে রকমারী মাদ্রাসা। এসময়ই মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান জমিয়েতুল মুদাররেছিন রাজাকার মান্নানের নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়ে উঠে। হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে সাধারণ শিক্ষার সমান্তরাল হয়ে ওঠে দেশজুড়ে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরকারী অর্থ আত্মসাৎ আর লুটপাটের তাড়না থেকে ধর্ম ব্যবসায়ী মোল্লারা গড়ে তোলে ভুয়া মাদ্রাসা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর থানার সরকারী মঞ্জুরী প্রাপ্ত মাদ্রাসা রয়েছে ৫৬টি। ১শ ৬৪ বর্গকিলোমিটার এই থানাতে ১৯৯১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী মোট লোকসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬শ ৫৯ জন। ওই থানায় প্রতিটি মাদ্রাসায় গড়ে কমপক্ষে ১শ করে ছাত্র ধরলেও মোট ছাত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১২ হাজার। অনুরূপভাবে, একটি জেলায় ১টি করে কামিল মাদ্রাসা থাকায় নিয়ম থাকলেও উল্লেখিত তদন্তে শুধু চট্টগ্রাম জেলাতেই ১৪টি কামিল মাদ্রাসা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর, দিনাজপুর ও সিলেট জেলায় ৫টি করে এবং নোয়াখালিতে ৭টি ও ঢাকা জেলায় ৪টি কামিল মাদ্রাসা রয়েছে। এমনকি ১৯৯৬ সালেও প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরো ১০টি কামিল মাদ্রাসার অনুমোদন দেয়।

তদন্তে দেখা গেছে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ায় জনৈক ডাঃ শামসুল হকেরই ৪টি এবতেদায়ী মাদ্রাসা রয়েছে। স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকে এসব মাদ্রাসার শিক্ষক দেখিয়ে ডাঃ শামসুল সরকারী অনুদানের টাকা আত্মাসাৎ করে।

ভুয়া মাদ্রাসার মত ভুয়া সার্টিফিকেটধারী মাদ্রাসা শিক্ষকও রয়েছে বিস্তর। রয়েছে একই শিক্ষক একই সঙ্গে একাধিক মাদ্রাসায় কর্মরত দেখিয়ে সরকারী অনুদান আত্মসাৎ এর ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত। ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানার মাকরাইল ছালেহা মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ভুয়া সার্টিফিকেট জমা দিয়ে দীর্ঘদিন অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালনের ঘটনা ধরা পড়ে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা দপ্তরের তদন্তে দেখা যায় উল্লিখিত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা (?) আলতাফ হোসেন ৩য় শ্রেণীতে কামিল পাস করা সত্ত্বেও ২য় বিভাগের ভুয়া সার্টিফিকেট জমা দিয়ে মাদ্রাসাটিতে অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন।

অপরদিকে জনৈক আব্দুল ওয়াদুদ ১৯৮০ সালে একই মাদ্রাসায় যোগ দিয়ে ১৯৮৮ সালে পরিচয় গোপন করে একই সঙ্গে মাগুরা জেলার সদর থানার উত্তর বীরপুর কাদের মুন্সী দাখিল মাদ্রাসার সুপার হিসাবে যোগ দেয় এবং উভয় মাদ্রাসা থেকে সরকারী ভাতা গ্রহণ করতে থাকে।   

দেশের মাদ্রাসা শিক্ষার উল্লিখিত প্রতীকি চিত্রের পাশাপাশি আঁতকে উঠার মতও চিত্র রয়েছে। তা হলো শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের প্রায় এক তৃতীয়াংশ গড়ে প্রতিবছর ব্যয় হচ্ছে মাদ্রাসা খাতে। সরকারী পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ১৯৯৬-৯৭ অর্থ বছরে রাজস্ব বাজেটে বেসরকারী স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষা খাতে ব্যয় হয় মোট ৬শ ৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১১ হাজার ৩শ ৭০টি বেসরকারী সেকেন্ডারী স্কুলের জন্য ব্যয় হয় ৩৫৪ কোটি টাকা অর্থাৎ ৫২.৮২ শতাংশ। এবং ৯৯৬টি বেসরকারী কলেজের জন্য ব্যয় হয় ৮৮কোটি টাকা এবং ১২.৭৭ শতাংশ।

অপরপক্ষে মাত্র ৫ হাজার ৭শ ৮৫টি বেসরকারী মাদ্রাসার পেছনে সরকারী ব্যয় হয় ২শ ২ কোটি টাকা অর্থাৎ ৩২.৯৫ শতাংশ। এতে দেখা যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যার বিচারে বেসরকারী মাদ্রসার ব্যয়ের পরিমাণ বেসরকারী স্কুল ও কলেজের চেয়ে বেশি ছিল।

একইভাবে ছাত্র প্রতি মাথাপিছু ব্যয় সাধারণ শিক্ষার চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষায় বেশি। দেখা গেছে, সরকারী মাদ্রাসায় একজন ছাত্রের মাথাপিছু ব্যয় যেখানে ৭হাজার ৬শ ৩ টাকা সেখানে সরকারী স্কুলের একজন ছাত্রের জন্য ব্যয় হয় ২ হাজার ৮শ ১৩ টাকা এবং সরকারী কলেজে ২ হাজার ৯শ ৫৯ টাকা।

অনুরূপভাবে, বেসরকারী মাদ্রাসায় একজন ছাত্রের পেছনে সরকারের ব্যয় যখন ১ হাজার ২শ ১১ টাকা তখন বেসরকারী স্কুলে তা মাত্র ৬শ ৭৮ টাকা এবং বেসরকারী কলেজে এর পরিমাণ ১ হাজার ৮৯ টাকা।

মাদ্রাসা শিক্ষার উল্লিখিত চিত্র থেকে সঙ্গত কারণেই কিছু প্রশ্ন জাগে। ইংরেজ প্রবর্তিত এই মাদ্রাসা শিক্ষা ইসলাম ধর্ম শিক্ষায় কি নূন্যতম ভূমিকাটুকু রাখছে? প্রতিবছর যে হাজার হাজার কোমলমতি শিক্ষার্থী এসব মাদ্রাসায় ভর্তি হচ্ছে তারা কি আদৌ তাদের জীবনে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারছে? নাকি মতলববাজ ধর্ম ব্যবসায়ী তথাকথিত মোল্লাদের স্বার্থ হাসিলের উপায়-উপকরণ হিসাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে? কষ্টার্জিত এই স্বাধীন দেশে জনগণের ট্যাক্সে কোটি কোটি টাকা কি প্রকৃত মানুষ গড়ায় ব্যয় হবে নাকি ধর্মান্ধ, ধর্মগোড়াঁ একদল ফতোয়াবাজ, কর্মবিমুখ মোল্লা গোষ্ঠী তৈরির পেছনে অপচয় হবে?

ভারতবর্ষকে চিরদিন গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখার ঘৃণ্য মতলব নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে ইংরেজরা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রবর্তন করেছিলো। স্বাধীন জাতি কেন তা বয়ে বেড়াবে? কেন এর পেছনে ব্যয় করবে কোটি কোটি টাকা?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন