ধর্মান্ধতার প্রতিরোধ
সময়ের দাবি
ধর্মান্ধ প্রচলিত প্রথা অন্ধভাবে পালন করে এবং
রীতিনীতিতে কোন পরিবর্তন সহ্য করতে পারে না। অন্ধভাবে প্রথা ও আচার অনুষ্ঠান পালন
করতে করতে এক পর্যায়ে যারা তার মতো আনুষ্ঠানিকতা পালন করে না তাদেরকে সে শত্রু
ভাবতে থাকে এবং সকলের জন্য সে হৃদয়ের দরজা রুদ্ধ করে দেয়। তার নিজস্ব সামপ্রদায়িক
উৎস ব্যতীত অন্য কোন উৎস থেকে জ্ঞান আহরণ করাকে সে মহাপাপ বলে মনে করে। তার চিন্তা
ও জীবনযাপন পদ্ধতিতে ভিন্নমতালম্বীদের প্রবেশাধিকার থাকে না। সংকীর্ণতার বেড়াজালে
আবদ্ধ হয়ে সে ভিন্ন ধর্ম বর্ণ ও জাতির প্রতি অসহনশীল ও বিদ্বেষ পরায়ণ হয়ে ওঠে।
ধর্মান্ধতার উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হচ্ছে,
বড় বড় বিষয়গুলো উপেক্ষা করে ছোটখাট বিষয় নিয়ে মেতে থাকা। 'খোদা হাফেজ' বলতে হবে নাকি আল্লাহ্ হাফেজ এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে
তারা রক্তারক্তি কান্ড বাঁধিয়ে দিতে পিছপা হয় না। দাড়ি রাখা,
গোড়ালির নিচে কাপড় পড়া, তাশাহুদের সময় আঙ্গুল নড়ানো,
দাঁড়িয়ে কিংবা বসে ক্বিয়াম করা, ছবি তোলা,
কুকুর পোষা ইত্যাদি ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে তারা অবিরাম বাড়াবাড়ি করে। তাদের
বাড়াবাড়িতে সমাজের সর্বস্তরে মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধির মতো বিস্তার লাভ করে
ধর্মান্ধতা। এই সংক্রামক ব্যাধির আক্রমনে এখন ইসলাম বিপন্ন। ধর্মান্ধতার আক্রমনে
মুসলিম দেশগুলো ক্রমেই জ্ঞানহীন, বিবেকবুদ্ধিহীন,
বিত্তহীন, ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। ধর্মান্ধদের দাপটে
উপেক্ষিত হচ্ছে ইসলামের মৌলিক ও বিতর্কাতিত বিষয়গুলো এবং কিছু অর্থহীন আচার
অনুষ্ঠান হয়ে উঠছে ইসলামের প্রতিপাদ্য বিষয়।
ধর্মান্ধতা রাষ্ট্র এবং মানবসভ্যতার জন্য
বিপদজ্জনক হয়ে ওঠে যখন ধর্মান্ধদেরকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। ইউরোপ
আমেরিকাতেও ধর্মান্ধ আছে কিন্তু তাদের ধর্মান্ধতা দৃশ্যমান নয় কারণ ঐসব দেশে
তাদেরকে রাজনীতিতে ব্যবহারের প্রবণতা কম। অন্ততপক্ষে বাইবেল ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের
মতো ধর্মান্ধতা খ্রীষ্টধর্ম প্রধান দেশে অনুপস্থিত। তাই ঐসব দেশে ধর্মান্ধতা যতই
বৃদ্ধি পাক না কেন আফগানিস্তানের মতো তালেবানি রাষ্ট্র গঠনের ভীতি তাদের নেই।
পক্ষান্তরে, মুসলিম ধর্মান্ধদের মধ্যে শরিয়াভিত্তিক
রাষ্ট্রগঠনের প্রবণতা প্রবল।
আশার কথা, সকল মুসলিম
ধর্মান্ধ এক দলভুক্ত নয়। এদের মধ্যেও রয়েছে অসংখ্য বিভাজন। ধর্মান্ধদের মধ্যেও
একটা বড় অংশ রয়েছে যারা শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের বিপক্ষে। একেক ধর্মান্ধ দলের
চাওয়া একেক রকম কিন্তু উৎকন্ঠার ব্যাপার হলো, বৈশিষ্ট্যের দিক
থেকে এদের মধ্যে সাজুয্য রয়েছে। কিছু মতভেদ সত্ত্বেও ধর্মান্ধদের ভিত্তি করেই
মুসলিম দেশগুলোতে দারিদ্রতা ও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি দিন দিন প্রবল আকার ধারণ করছে।
রাজনীতিতে টাকা ও ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহারে ধবংস হয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর
নীতি-নৈতিকতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ। ধর্মের রাজনীতিকরণের কারণে মুসলিম অধ্যুষিত
দেশগুলোতে ধর্মান্ধদের উত্থান ঘটছে এবং শক্তি অর্জন করছে। মুসলিম ধর্মান্ধদের
ধবংসাত্মক কর্মকান্ড সম্পর্কে সারা পৃথিবীর মানুষ এখন পরিচিত। এরা চরম অনমনীয়,
বিজ্ঞান ও আধুনিকতা বিমুখ, সংস্কারবিরোধী ও সহিংস।
দুঃখজনক যে বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই এখন ইসলামকে বিচার করছে উগ্র ধর্মান্ধদের
কর্মকান্ডের ভিত্তিতে। স্বল্পসংখ্যক উগ্র ধর্মান্ধের কারণে ইসলাম আজ কলঙ্কিত
হচ্ছে। নাইন ইলেভেন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং
বাংলাদেশের সামপ্রতিক ঘটনাবলী ধর্মান্ধদের উল্লেখযাগ্য তা-বলীলা।
উগ্রধর্মান্ধদের যুক্তি হলো - রসুল (সা.) ১৯ টি
সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন এবং সাহাবীদের ৫৫টিরও বেশি যুদ্ধে পাঠিয়েছেন সে হিসেবে
রাসুলের (সা.) মাদানী জীবনের ১০ বছরে মুসলিমরা ৭০টির বেশি যুদ্ধ করেছে যা বছরে গড়ে
প্রায় ৭টি । প্রতিবছর গড়ে ৭টি করে যুদ্ধ করলে যুদ্ধের পরিকল্পনা,
আয়োজন, যুদ্ধে গমন, অংশগ্রহণ ও প্রত্যাবর্তন আবার নতুন যুদ্ধের
পরিকল্পনা, আয়োজন, যুদ্ধে গমন, অংশগ্রহণ ও প্রত্যাবর্তন এই হলো মুসলমানদের
ইবাদত। উগ্র ধর্মাদ্ধদের মতে সশস্ত্র যুদ্ধ ব্যতীত মুসলমানদের আর কিছু করার নেই।
এরা মনে করে যুদ্ধে যাবার চিন্তা করতে করতে বিছানায় হার্ট এটাকে মৃত্যু হলেও
শহীদের মর্যাদা পাবে। তাই তাদের চিন্তা জগতে সশস্ত্র যুদ্ধ ও রক্তপাত স্থায়ী আসন
গেড়ে নেয়। এ রকম কোন ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যদি
মনে করে যে মাজারে যাওয়া ইসলাম পরিপন্থি তবে সে বোমা মেরে মাজার উড়িয়ে দিতে পারে
কিংবা পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনকে অনৈসলামিক মনে করলে বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারে
ছায়ানটের মঞ্চ। একই কারণে তারা জনসমাবেশে আত্মঘাতি হামলায় হত্যা করতে পারে নিরীহ
মানুষ, রক্তাক্ত করতে পারে লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের, ছিন্ন-ভিন্ন করে
দিতে পারে সভ্যতা ও ঐতিহ্যের প্রতীক। তাই ধর্মান্ধতা উপেক্ষার বিষয় নয়। ওদেরকে
আশ্রয়-প্রশয় দিলে ওরা আরো শক্তিশালী হবে এবং ক্রমে মানবজাতির অস্তিত্ব,
আশা, আকাঙ্খা, পরিবেশ তথা পৃথিবীর অস্তিত্বই বিপন্ন করে দিতে
পারে।
সুতরাং ধর্মান্ধদের প্রতিরোধ করতেই হবে।
ধর্মান্ধতার আশ্রয়ে থেকে ধর্মান্ধদের প্রতিরোধ করা যাবে না। অযৌক্তিকতাকে দূর করতে
চাই যুক্তি, অজ্ঞানতাকে দূর করতে চাই জ্ঞান,
মূর্খতাকে দূর করতে চাই শিক্ষা, অন্ধতাকে দূর
করতে চাই আলো। ধর্মান্ধতা দূর করতে প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন,
শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে উদারতা,
মহানুভবতা, যুক্তিশীলতা, পরমত-সহিষ্ণুতার
চর্চাকে বেগবান করতে হবে এবং কুরআনের উদার ধার্মিক শিক্ষা এবং বিচার-বুদ্ধির
প্রয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার অতি জরুরি। সকল
শিক্ষাই এক হওয়া উচিত। স্কুল পর্যন্ত সকলেই ভাষা, অঙ্ক,
বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস ইত্যাদি
বিষয় পড়বে এবং স্কুলের পরে কেউ ইচ্ছে করলে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে,
যেমনটা অন্য সকল উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে হচ্ছে। বাস্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা
চালু করতে হবে, এখনই। যদি কেউ ধর্মীয় বিষয়ে পা-ত্িয অর্জন করতে
চায় তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগ প্রশস্ত করতে হবে। এটা তো নিশ্চিত যে
ধর্মান্ধগোষ্ঠী এর সাথে একমত হবে না। কারণ একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুহলে
শিশু-কিশোর-তরুণদের ওপর ধর্মান্ধদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এবং নতুন ধর্মান্ধ সৃষ্টির
পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
পাশাপাশি এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে,
মানুষ যেন নিজ ধর্মকে জেনে ধার্মিক হতে পারে। ধার্মিক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি
বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক উপযোজন ও আত্মিক উন্নতির প্রতি গুরুত্ব দেন এবং নিজের
প্রকৃতিকে অনুসন্ধান করে নিজের ধর্মকে সাধনার মাধ্যমে আবিষ্কার করেন। তাই তিনি
উপলব্ধি করতে পারেন যে ধর্ম সামষ্টিক নয় ব্যষ্টিক। যিনি নিজ ধর্মকে জানেন তিনি
এটাও জানেন যে প্রত্যেক মানুষের ধর্ম আছে। ফলে ধার্মিক সম্প্রদায় মুক্ত হয়।
ধার্মিক ব্যতীত প্রত্যেক মানুষই কোন না কোন সমপ্রদায়ভূক্ত। আচার অনুষ্ঠান পালনেও
ধর্মান্ধ ও ধার্মিকের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ধার্মিকের কাছে সালাত হচ্ছে
সনির্বন্ধ আবেদন, আল্লাহর সাথে সংযোগ,
সভা কিন্তু ধর্মান্ধদের কাছে সালাত অর্থ কেবলই নামাজ পড়া। ধার্মিকের কাছে
জেহাদ অর্থ আত্মিক উন্নতি লাভের জন্য চরম প্রচেষ্টা, আত্মশুদ্ধির
সংগ্রাম, সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম কিন্তু ধর্মান্ধদের কাছে জেহাদ হচ্ছে
সশস্ত্র যুদ্ধ ও রক্তপাত।
বাংলাদেশে শান্তিধর্মের ধারক বাহক হচ্ছেন ধার্মিক
সূফী সাধকগণ। তাই এতোকিছুর পরও আশার কথা হলো - এদেশের বেশিরভাগ মানুষ ঐতিহ্যগত
কারণে ধর্মান্ধ নয়। এদেশের মানুষ ধর্মান্ধ হলে এতদিনে ধর্মান্ধগোষ্ঠী কিংবা তাদের
ব্যবহারকারী রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতো। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বজায় রেখে একসঙ্গে শান্তিতে বসবাস করাই আমাদের ঐতিহ্য। আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে
হারিয়ে যেতো দেবো না। সাংস্কৃতিক আন্দোলন, উদারতা,
মহানুভবতা, যুক্তিশীলতা ও পরমত-সহিষ্ণুতা চর্চার মাধ্যমে
আমরা ধর্মান্ধদের প্রতিরোধ করবো এবং পাশাপাশি নিজের ধর্মকে জানার প্রচেষ্টায় রত
থাকবো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন