মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০১৩

মিথ্যা কথার অবসান !


মিথ্যা কথার অবসান !

 

বিমা ॥ এখন আমাদের এই কথিত সোনার বাংলাদেশ দীর্ঘদিন থেকেই যে কাঙ্খিত কোন বলয়ের মধ্যেই আবদ্ধ থাকছে না, এ ধরনের একটি বিশ্বাস সব মানুষের হৃদয়েই বসবাস করতে শুরু করেছে। সর্বক্ষেত্রেই সার্বক্ষণিক একটা দুঃসময় বেগবান গতিতেই প্রবাহিত হয়েই চলেছে সকল উদ্বেগকে সাথে নিয়ে।

দুঃসময়ের অবসান ঘটিয়ে একটি সভ্য সমাজের প্রবর্তনকে বেশীর ভাগ লোকই কায়মনোবাক্যেই প্রার্থনা করে করে এখন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। তথাপি এইসব ক্ষীণকণ্ঠী দুর্বল মানুষ দিনে একবার হলেও তাদের সেই কাঙ্খিত অভাবমুক্ত সমাজের কথা উচ্চারণ করেন আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। হয়ত প্রত্যাশার সেই পরিবেশটি ভবিষ্যত বংশধরদের জন্যে তারা দেখে যেতে পারবেন বলে একটা খেদ নিজের মধ্যে পুষে পুষেই তাদেরকে একদিন বিদায় নিতে হবে এই প্রিয় জন্মভূমি থেকে। বলতে দ্বিধা নেই সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবেই!

আমরা যে সমাজে এখন বসবাস করছি এটা কিন্তু সেরকমটি ছিল না। একটা নিজস্ব শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বলয়ের মধ্যে আমরা আমাদের লোকজন এবং সামাজিক, লৌকিক ও ঐতিহ্যবাহী চেতনাবোধের মধ্যেই সবাই বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়েছিলাম। মানুষকে বিশেষত বয়োঃবৃদ্ধদের সসম্মানে কথাবলা, অনুজদের স্নেহপূর্ণ ভাষায় কথাবলা, অকথ্য উচ্চারণ না করা, অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্ত্র না করা এগুলো পঁচিশ বছর আগেও একজন বাঙালির সহজাত বিষয় ছিল যা সে সযত্নে লালন করত এবং অধস্তন পুরুষকে এই আলোকে শিক্ষা প্রদান করতো।

কিন্তু কোথায় গেল সেসব সুবর্ণ সিঁড়ির ধাপগুলো যা আজকের প্রজন্মের জোয়ানরা খুঁজতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে। এই প্রজন্মের কাছে যেন সন্ত্রাস, রাহাজানী, চাঁদাবাজী, খুন-খারাপী, অশ্রাব্য গালাগাল, আর খিস্তিখেউর করাটাই একটা প্রত্যাশিত 'শিভালরাস' ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিভাবকরাও তাদের এধরনের সন্তানদের নিরস্ত করতে পারছেন না। আবার এক শ্রেণীর অভিভাবকরা পরম উৎসাহে আপন আপন সন্তানদের তথাকথিত 'শিভালরাস' পথটিকেই আঁকড়ে ধরতে উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছে।

বিপদসংকুল হলেও এটিই তাদের কাছে সহজ অর্থনৈতিক লাভালাভের পথ বলেই গণ্য হয় এবং হচ্ছেও। অনেককেই যারা রাস্তার ওপর তরিতরকারী বা মুরগী বেচত অথবা প্রাইভেট বাসের কন্ডাকটরী করতো অথবা নিউমার্কেটে মাছ কেটে সংসার চালাতো তারা গত ২০-২৫ বছরে এখন সমাজে অমুক সাহেব বা তমুক মিয়া বলে পরিচিত। তারা নিদেনপক্ষে ৩/৪ টি আলিশান বাড়ির মালিক। তাদের এক একজন পুত্র মোবাইল ফোন হাতে বিভিন্ন ধরনের দামী-গাড়িতে দৌড়াদৌড়ি করে নানান ব্যস্ততায়। তাদের ছেলেরা এখন মাস্তানদের গডফাদার। বিভিন্ন বাজার, শপিং কমপ্লেক্স, বাস ট্রেন-লঞ্চ টার্মিনাল, দোকান পাট থেকে নিয়মিত সেলামী আসে। কি চমৎকার লাইফ স্টাইল। যেন একটা ইন্ডাস্ট্রি চালু হয়ে গেছে। মাস শেষে পয়সা আসছে। অথচ এরই পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভের পরেও লাখ লাখ ছেলেমেয়ে চাকুরি পাচ্ছে না। বেকার পিতামাতার গলগ্রহ। সমাজে উপেক্ষিত।

এরকম একটা অবস্থার মধ্যে থেকেও আমাদেরকে তথাকথিত হিউম্যান রাইটস, সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের জন্যে মাঝে মধ্যেই কথা বলতে হচ্ছে সেমিনার করতে হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় লিখতে হচ্ছে, এ সম্পর্কে মানুষকে সজাগ হবার জন্যে। কিন্তু কাজের কাজ প্রত্যাশিত যতটুকু হবার ততটুকু হচ্ছে না। আসলে হিউম্যান রাইটসই বলুন আর সুশীল সমাজই বলুন সমস্ত বিষয়টিই সবই 'ইকোনমিক প্যাকেজের' সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে দেশের অর্থনীতিতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সেখানে ওই ধরনের একটা সামগ্রিক অবস্থা আশা করা সামগ্রিকভাবেই বাতুলতা ছাড়া আর কি। অনেক সমাজপতির কাছে মিথ্যে বলাটাই বা মিথ্যের ওপর ভর করে চলাটাই হিউম্যান রাইটস।

চিন্তা করুন যে দেশের মাথা পিছু জিডিপি ও জিএনপির অবস্থা অতি করুণ, এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় সেদেশের জন্যে প্রেসক্রিপশনটাই বা কি? যখন যে দল দেশ শাসনে যাচ্ছে তখন সে দলের লোকেরাই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাংক ফোকলা করছে।  সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আবার বড় গলায় কথা বলতে পারতেন? তার ছেলেরা তার বোনেরা তার মা, তার ভাইদের কাছে এদেশের ব্যাংকগুলো কত হাজার কোটি টাকা পাবে সেটার হিসেব তিনি না দিলেও আমরা ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছি। যেদেশে বেড়ায় ক্ষেত খায় সেদেশে সভ্য সমাজের প্রত্যাশাটা বোধ করি এখনও বেশ দূরে। তবে অনেক দূরে নয়। বেড়াদের ক্ষেত খাওয়ার বিষয়টি যখন বন্ধ হয়ে আসবে তখন তা অনেক সুবিধেজনক অবস্থায় পৌঁছাবে।

বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সামগ্রিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি সার্বভৌম প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা আজও হয়নি। যে ক্ষমতাসীন সরকার এ কাজটি করবেন তার নাম এদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে। কিন্তু কেউই তা করবে না। করলেই তো লুঠপাট বন্ধ হবে ক্ষমতার হম্বিতম্বি কমে যাবে।

এছাড়া আমরা মুখে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার কথা বলি। অনেক বিশ্লেষণ হিসেবে-নিকেশ করলে দেখা যাবে এগুলো শুধু বাতকি বাত। কত সরকারই এলো গেল গণতন্ত্রের দোহাই পেড়ে- কিন্তু কাউকেই এ ব্যাপারে পরে আর কথা বলতে বড় একটা শোনা যায় না। যদিও আইন বিষয়ক একজন করে জাঁদরেল মন্ত্রী নিযুক্ত থাকেন। তিনিও নির্বীর্যের মত পড়ে পড়ে ঝিমোন যেন কার ইশারায়। এভাবেই তানা-নানা করে পার হয়ে যায় মূল্যবান সময়। বিচার বিভাগ যেমন থাকে তেমনি রয়ে যায়। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার প্রতিশ্রুতিটিও আর পূর্ণতা পাচ্ছে না।

রাজনীতিকরা চিরকালই ভোটারদের ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোর টেকনিকটি প্রয়োগ করে ক্ষমতায় গিয়েছে। আর ক্ষমতায় গিয়েই তাৎক্ষণিকভাবে জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ইচ্ছে করেই ভুলে যায়। জনগণের কল্যাণের কথা পেছনে আড়াল করে আপন দল ও কর্মীদের কল্যাণের বিষয়টিই সামনে তুলে আনেন।

বর্তমান পৃথিবী এখন অনেক অনেক ছোট হয়ে এসেছে। আগামীতে কম্পিউটার সুপার হাইওয়ে ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে গোটা পৃথিবী সেকেন্ডের ব্যবধানে সাধারণ মানুষের আঙুলের ডগায় এসে জমা হচ্ছে। মানুষের মবিলিটি রাজনীতিকদের সচলতার চেয়ে অনেক বেশী অগ্রসরমান। আর ফাঁকা কথায় কাউকেও বোকা বানানো সম্ভব হচ্ছে না। সতত তথ্য প্রবাহের কারণে সাধারণ মানুষ আপনা আপনি পাকাপোক্ত হয়ে উঠছে।

এখন যেমন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী নেত্রী, মন্ত্রি, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী যে যেমন করে পারছেন মিথ্যে কথা জনগণকে শোনাচ্ছেন সে পথ বন্ধ হয়ে যাবে, হতেই হবে। এই ছোট হয়ে আসা বিশ্বে অপর দুনিয়ার লোকদের কাছেও অবলীলায় পৌঁছাতে থাকবে এসব ব্যক্তিত্বের মিথ্যেকথনের কাহিনী সামাজিক মাধ্যমগুলোর কল্যাণে। অপর বিশ্বের লোকেরা যে বিষয়টিকে সর্বাপেক্ষা অধিক ঘৃণা করে তা হল মিথ্যে কথা বলা। দেশের নেতা-নেত্রীদের কাছে তাই আমাদের প্রত্যাশা, দোহাই দেশের স্বার্থে মিথ্যাচার বন্ধ করুন। নইলে এদেশের মানুষকে ওইসব দেশে মিথ্যেবাদী দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য হতে হবে। যা আমাদের জন্য কোন সুখকর বিষয় হচ্ছে না এবং ভবিষ্যতেও হবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন