সংস্কারের
পথ ধরে হোক যাত্রা শুরু
সংলাপ ॥
সংস্কার করতেই হবে।
এটাই আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ওই ছাত্র রাজনীতির, যারা বিবেকের চর্চা করে দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা প্রেম শ্রদ্ধা নিয়ে, যারা যুদ্ধ করে যৌবনের সাহস নিয়ে।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ না হলে রগকাটা রাজনীতিতে বিভ্রান্ত
যৌবনের উৎসাহ কখনো কমবে না।
ছাত্র রাজনীতি আমাদের
ঐতিহ্য,
ইতিহাস, গর্ব ও সংস্কৃতি। বলা যায়, আমাদের অস্তিত্বের
স্পন্দন। দেশ জাতি ইতিহাস ভাষার যখনই প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তখনই হিমালয়ের মতো বুক পেতে
দাঁড়িয়েছে ছাত্র রাজনীতি। কারো ইচ্ছায় যেমন নয় কারো অনুগ্রহে তা নয়। সমাজের অগ্রগামী
যৌবনের প্রকাশ। যৌবনের ধর্মই সবকিছু ভেঙ্গেচুরে আবার নতুন করে সৃষ্টি। বৃটিশদের তৈরি
ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পাকিস্তান বানাতে ছাত্র রাজনীতির যৌবনের প্রবল উচ্ছ্বাস-উদ্যম
আর ত্যাগের যেমন প্রয়োজন ছিলো। তেমনই পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ বানাতেও সেই যৌবনের
অগ্রগামী অংশই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সবার আগে। বায়ান্ন, বাষট্টি,
উনসত্তর কিংবা একাত্তরের সর্বাত্মক যুদ্ধের রণ দামামা বাজিয়ে
ঝাঁপিয়ে পড়ার ইতিহাস আমাদের এই ছাত্র রাজনীতিরই।
কিন্তু এসব ইতিহাসের
স্বর্ণোজ্জ্বল দিন আজ আর নেই। সময়ের পথ ধরে তা আজ অবক্ষয়, ঘৃণা,
নিগ্রহে অস্তিত্বহীনতায়, করুণায়, মিথ্যা কলঙ্কে, ব্যর্থতার উন্মাদনায়, স্বার্থপরতায় এবং প্রতিহিংসার
প্রতিশোধের লোলুপতায় ডুবছে জাতি। প্রায় তিন দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি স্বৈর মনোবৃত্তিরই
প্রকাশ মাত্র। দায়টি যেখানে সমগ্র রাজনৈতিক অঙ্গনের রাজনীতিকদের সেখানে স্বাধীনতা উত্তর
মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকরা ছাত্র রাজনীতিকে প্রলুব্ধকরণ আর নৈতিকতাহীনতার মাঝে ঠেলে দিয়ে
আসছে, পরিণত করছে তাদেরই সেবাদাসে, সেই ধর্মের রাজনীতিকে অক্ষুন্ন রেখে মাদ্রাসার রাজনীতির বন্ধের
প্রস্তাবনা,
উদ্যোগ কিংবা প্রচেষ্টা - কোনটার মধ্যেই রাজনৈতিক চেতনাবোধ যে কাজ করবে না এটাই বাস্তব।
বাংলাদেশে সত্যের পথে
জাতির জন্য রাজনীতি কেউ করায় না, কেউ করেও না। সময় অবস্থা আর তার প্রয়োজনই প্রধান নিয়ামক। যৌবনের
ধর্মই প্রতিরোধ করা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হওয়া। সকল
পরাধীনতাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে নতুন সৃষ্টির জাগরণ তোলা। আজ যারা দেশ নিয়ন্ত্রক পরিচালক
তাদের বেশিরভাগই ষাট-সত্তর দশকের ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়েই আসা। তাদের স্মৃতিতে আয়ুব-মোনেম
কিংবা নূরুল আমিনের তৈরি করা পরিবেশ আর পরিস্থিতির কথা এখনো ম্লান হয়ে যায়নি। সেদিন
অতি সুবোধ মেধাবী ছাত্রটিও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ওই দুঃশাসন প্রতিরোধ করতে। সেদিন কাউকে
বলে দিতে হয়নি ছাত্র রাজনীতি করো আন্দোলন করো। সচেতনতাই তার দেশপ্রেম জাতিপ্রেম ভাষাপ্রেমকে
উস্কে দিয়ে রাজনীতিতে টেনে এনেছিলো। আবার স্বাধীনতা উত্তর নতুন করে তথাকথিত ধর্মরাজনীতি
রাজপথ উত্তপ্ত করছে, আজও সে ‘ইসলাম’কে পণ্য করা হচ্ছে।
ধর্ম নিয়ে রাজনীতি
শুরু কিংবা বন্ধের উপর গণতন্ত্র যে আর নির্ভর করে না, এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের চেয়ে আর কার বেশি আছে? গণতন্ত্রের মূল এবং
মৌলিক কাঠামোতে নিয়ন্ত্রণ ভূমিকা কোথায়? বরং যারা গণতন্ত্রকে
সুনিশ্চিত জবাবদিহিতা, মানব কল্যাণমুখী, স্বার্থহীন ন্যায় বিচারে
প্রতিষ্ঠিত করবে,
সেই রাজনীতিকরাই এতদিন পর্যন্ত ওই ধর্ম নিয়ে রাজনীতিকে বিভ্রান্তির
মধ্যে ঠেলে দিয়ে তার সমস্ত পবিত্রতা হরণ এবং অন্তঃসারশূন্য করে ওই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির
অংশ করে নিয়েছে।
এই নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে
তাদের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির প্রসার এবং ব্যাপ্তি সম্ভব নয়। এই নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে
মাদ্রাসার ছাত্র রাজনীতির হাতে অর্থ-অস্ত্র অনৈতিকতাকে তুলে দিয়েছে তারা। এরা কেউ আমাদের
অপরিচিত নয়। কোনো ভিন দেশ থেকে এসে এদেশে উপনিবেশ গড়েনি। এদের শিকড় এই মাটিতেই। কিন্তু
চরিত্রে এরা বাঙালি নয়। চরিত্রে এরা ধর্মের নামে লুটেরা। মানবিকতা শূন্য। দুরন্ত ভোগ
আর লালসার স্তূপের আবর্জনা। এরা চূড়ান্ত পশুত্বের বিকশিত রাজনীতিতে ক্ষমতার উঠানামায়
এখন মাসীর ভূমিকায়। তথাকথিত মোসলমান হয়ে দেশজুড়ে গলা ফাটিয়ে বেড়াচ্ছে।
তারা ধর্মীয় উগ্রবাদী
ও সন্ত্রাসী তারপরও তাদেরকেই আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির উত্তরাধিকার সৃষ্টিতে অপরিহার্য
মনে করে ধর্মের কথা বলে তথাকথিত সংস্কারের হাওয়া বেশ মৃদুমন্দ ভাবেই লাগতে দিচ্ছি।
সমস্ত আবর্জনার বস্তাটা ধর্মের নামে রাজনীতির কাঁধে। ৪২ বৎসর ধরে যারা গণতন্ত্রের কবর
রচনা করে আসছে তাদের নেতৃত্বে যে খালেদা-এরশাদ-নিজামী এটা যাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট
হয়, তারা প্রকারান্তে রাজাকারদেরই দোসর এবং নব্য রাজাকার। যাদের রাজনীতির কারণে হাজার হাজার দুর্বৃত্তের হাতে দেশের কোটি কোটি
মানুষের আশা-স্বপ্ন-ভবিষ্যৎ জীবন এবং যৌবনের কর্ম ও ধর্ম ভেঙ্গেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে মাটিতে
মিশিয়ে দিয়েছে,
সেই রাজনীতির প্রতিটি সদস্যকেই আজ আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে
হবে; তবেই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জাগরণ।
ধর্মের নামে রাজনীতির
সমস্ত পবিত্রতা হরণের পিছনে এরাই দায়ী। তাদেরকে চিহ্নিত না করে, মাথা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত ঘুমন্ত ভল্কানো উস্কে দেয়ারই নামান্তর। কাজেই আজ সময়
এসেছে জাতীয় ঐক্যের-বিবেকের-দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার। আবেগে নয় আজ বড় বেশি
প্রয়োজন বিবেকি কাজের। অপরাধীদের বিচার প্রয়োজন। এদেরকে চিহ্নিত করে বিচার করতে হবে। ন্যায়বিচার না থাকলে গণতন্ত্র থাকে না।
বর্বরদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
সংস্কার করতেই হবে।
এটাই হোক বাংলার দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের শুরু। এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যারা বিবেকের চর্চা করে দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা
প্রেম শ্রদ্ধা নিয়ে, যারা যুদ্ধ করে যৌবনের সাহস নিয়ে। যাদের প্রেরণা আস্থা বিশ্বাস
প্রতি মুহূর্তের সৃষ্টির আনন্দে টগবগ করে ফুটছে তারা যেন আর ওই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির
রসদের রসাতলে পড়তে না পারে তার উৎসই বন্ধ করে দিতে। শিক্ষকদেরকেও বেছে বেছে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
থেকে বের করে দিতে হবে, যারা রাজনীতির দালালী করে শিক্ষকতার পেশায় এসেছে। ধর্মভিত্তিক
রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ না হলে রগকাটা রাজনীতিতে বিভ্রান্ত যৌবনের উৎসাহ কখনো কমবে
না। সুতরাং সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তেই তা করতে হবে। শিক্ষক রাজনীতিতে লেজুড়বৃত্তির প্রধান
কারণই পিছনের দরজা দিয়ে আসা অযোগ্য মেধাহীন রাজনৈতিক দাসরা আর তাদেরই কারণে ছাত্র রাজনীতি
চূড়ান্তভাবে কলুষিত। তাকে পরিচ্ছন্ন করার দায় এই সময়ের। এই সময়ে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন
তাদের।
চাঁদাবাজির উৎস কোথায় দেশের মানুষ সকলেই জানে। সুতরাং তা বন্ধ
করতে হবে। প্রতিটি স্তরের শিক্ষার মান, উপকরণ সহজলভ্যতা সুযোগ সকলের
জন্যই উন্মুক্ত রাখতে হবে। শিক্ষাকে বেপারীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে নাকে তেল
দিয়ে ঘুমাবার সময় নেই। দলবাজী বা ধর্মের নাম করে কোনো ছাত্র তার সুন্দর জীবন ও স্বপ্নকে
ধ্বংস করতে ছাত্রত্ব গ্রহণ করে না। পরিবেশ তাকে বাধ্য করে একসময় সেই হয়ে ওঠে প্রতিরোধ্য।
সেটা এত কাল আমাদের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কারণেই ঘটে আসছে, তাকে পরিচ্ছন্ন
করতে সময় লাগতে পারে, তাতে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। লক্ষ্যের দিকে একরৈখিক কর্মের কার্যকর
ইতিবাচকতাই জনআস্থা বাড়াবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন