ধনী-গরীবের বৈষম্য কমাতে হবে
* তার ( আবু লাহাবের)
ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন কাজে আসবে না।-১১১:২
* ধন-সম্পদ বাড়ানোর
প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে।-১০২:১।
* আর অবশ্যই সে (মানুষ)
তো ধন-সম্পদের লালসায় উন্মত্ত।-১০০:৮
* (দুর্ভোগ প্রত্যেকের)
যে অর্থ জমা করে ও তা বারবার গোণে; তার ধারণা,
তার অর্থ তাকে অমর করে রাখবে।-১০৪:২-৩।
* যেদিন ধন-সম্পদ ও
সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না, সেদিন উপকৃত হবে সে যে আল্লাহর
কাছে পবিত্র মন নিয়ে আসবে।-২৬: ৮৮-৮৯।
* তোমাদের ধন-সম্পদ
ও সন্তান-সন্ততি তো তোমাদের জন্য পরীক্ষা, তোমাদের জন্য আল্লাহ্রই
কাছে রয়েছে বড় পুরস্কার।-৬৪:১৫।
আরিফীন হক ॥ বাংলা ও বাঙালির মূল্যবোধ চর্চায় এক সময় বলা হতো,
'তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন' ?
আর বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি,
শিক্ষা-সংস্কৃতি তথা সমাজের সর্বস্তরে যে বৈষম্য আজ ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে তা দেখে
হয়তো ধনীদের বলার ইচছা জাগে, 'তুমি এতো গরীব,
তাই আমি এতো ধনী হইবো না কেন?'। দেশে মুষ্টিমেয় লোক বেশি
ধনী হয়ে গেছে বলেই তার বিপরীতে সৃষ্টি হয়েছে এতো গরীব মানুষ। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর
এসে আজ বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরে একদিকে দেখা যাচ্ছে,
নানা রঙের বিলাস বহুল কত গাড়ি, বাড়ি,
কোটি টাকা, শত কোটি টাকার মালিক তারা হয়েছেন বা হওয়ার স্বপ্ন
দেখে চলেছেন। অপরদিকে রাস্তার দু'ধারে,
বস্তিতে কত মানুষ বাস করে খোলা আকাশের নিচে। অন্ন,
বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা,
স্বাস্থ্য ইত্যাদি কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা তাদের দিতে পারেনি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র।
অপরদিকে রিঙাওয়ালা, ঠেলাগাড়ি চালক, দিনমজুর,
গৃহকর্মী, শ্রমিক যারা দিনভর পরিশ্রম করে যাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে
এতো চিন্তা নেই, প্রতিদিনের সংস্থান যাদের হলেই হল,
কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ভীষণ সুখী। কিন্তু কথিত বিশ্বায়ন ও অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিনির্ভর
সমাজের যে দুষ্টচক্রে তারা আজ আবর্তিত হচ্ছেন, তা থেকে তারা কীভাবে
নিজেদের উত্তরণ ঘটাবেন সে চিন্তাটিও কেউ করছে না। ফলে ধনী আরও ধনী হওয়া,
দরিদ্র আরও দরিদ্র হওয়ার যে ধারা দিন দিন আরও প্রকটতর হচ্ছে। কেউ কেউ ধর্মের নামে,
আবার কেউ রাজনৈতিক ও সরকারি দলের সুবিধা নিয়ে বিগত কয়েক বছরে অঢল অর্থবিত্তের মালিক
বনেছেন। অর্থনীতির বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের
স্বাধনিতা ঘোষণা করা হয়েছিল। এদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলেন জনকল্যাণমুখী একটি রাষ্ট্রের-যে
রাষ্ট্রে অবারিত হবে অর্থনৈতিক সুযোগ, উন্মেষিত হবে সামাজিক
সুবিধাদি, পাওয়া যাবে রাজনৈতিক মুক্তি, থাকবে স্বচ্ছতা ও সুরক্ষার
নিশ্চয়তা, পাওয়া যাবে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ, প্রস্ফুটিত হবে ধর্মরিপেক্ষ
আচরণ। স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান এসবের অঙ্গীকার করে,
প্রকাশ্যে: করে মৌালিক চাহিদা মেটানো থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ,
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমানাধিকারের অঙ্গীকারও। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এ অঙ্গীকার,
আর বাস্তবের ফারাক এতই বেশি যার ভিতরে মৌলবাদের অর্থনীতি ও সংশ্লিষ্ট রাজনীতির
বিস্তৃতি সম্ভব'।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সামন্তবাদী
উৎপাদন সম্পর্ক ক্ষয় হয়েছে, কিন্তু একদিকে যেমন চিরাচরিত মানস কাঠামো বিলুপ্ত
হয়নি, তেমনি অন্যদিকে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কও বিকশিত হয়নি;
বিকশিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের নিকৃষ্ট পুঁজি, যা উৎপাদনশীল বিনিয়োগে
ভূমিকা রাখে না। 'ব্রিফকেশ পুঁজিবাদ'
বিকাশে শিল্পভিত্তিক চিরায়ত পুঁজিবাদের তুলনায় 'শকুন পুঁজিবাদ' (ভালচার কেপিটালিজম) অনেক বেশি অনুকূল। এই পুঁজিবাদ
উৎপাদনশীল শিল্পনির্ভর অর্থনীতির চেয়ে নগর-কেন্দ্রিক ভূমি ব্যবসা এবং দোকানদারি অর্থনীতি
বিকাশে অনেক বেশি উৎসাহী। অর্থাৎ কাঠামোগতভাবেই এই পদ্ধতি উদ্বৃত্ত শ্রমের অর্থনৈতিক
ব্যবস্থায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। হচ্ছে না
দারিদ্র্য বিমোচন। অবশ্য এ ধরনের মুক্তবাজার কখনই দারিদ্র্যবান্ধব নয়। একচেটিয়া পুঁজিবাদী
বিশ্বায়নের মুক্তবাজার এদেশের জাতীয় পুঁজিভিত্তিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার
বদলে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে তাও মৌলবাদ -সাম্প্রদায়িকতা পুষ্টিতে সহায়ক।
শকুন পুঁজিবাদ' আজ এদেশের অর্থনীতিতে
বড় ভূমিকা পালন করছে। এখানে অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিতদের অবস্থা দিনকে দিন অবনতির দিকেই
যাচ্ছে এবং এদের সংখ্যাটিও দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাকিস্তান আমলে বলা হতো ২২ পরিবারের
কথা। আজ বলা হচ্ছে, কয়েক হাজার পরিবারের কাছে দেশের সকল সম্পদ কুক্ষিগত
হয়ে পড়েছে। দারিদ্র্য ও অশিক্ষা-কুশিক্ষার ফসল হিসেবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা যেভাবে
বেড়ে চলেছে তাকে সমাজ ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ উদ্বেগজনক বললে হয়তো কমই বলা হবে। দেশে
বর্তমানে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখ। পথশিশু বৃদ্ধির এ হার বজায় থাকলে ২০১৪ সাল নাগাদ সংখ্যাটি
১২ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে। অথচ ক্রমবর্ধমান এ শিশুদের কল্যাণে নেই কোন নীতিমালা। সরকার
ঘোষিত ভিশন ২০২১ অর্জন করতে হলে এখনই এ শিশুদের কল্যাণে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি
প্রয়োজন। পথশিশুদের প্রায় ৪৪ ভাগ ধুমপান করে এবং রাতে ঘুমানোর জন্য ৪১ ভাগ শিশুর কোন
বিছানা নেই। পথশিশুদের প্রায় ৪০ ভাগ প্রতিদিন গোসল করতে পারে না ও ৩৫ ভাগ শিশু খোলা
জায়গায় পায়খানা করে। কোন মতে খাবার যোগাড়ের জন্য ৮০ ভাগ পথশিশু বিভিন্ন ধরনের কাজ করে।
৮৪ ভাগের কোনও শীত বস্ত্র নেই। অসুস্থ হলে প্রায় ৫৪ ভাগের দেখাশোনার কেউ নেই। অর্থের
অভাবে পথশিশুদের ৭৫ ভাগ ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না। দেশের শিশুদের বিরাট অংশের এই
চরম দুরাবস্থার চিত্র ব্যথিত করে সমাজের যেকোন বিবেকবান মানুষকে। প্রশ্ন করতে হয় তাদেরকে,
যারা দেশের সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন স্বাধীনতার ৪০
বছর ধরে। এর পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ী? এই দূরাবস্থা কী
আমাদের সকলের লজ্জ্বার বিষয় নয়? নাকি যারা স্বাধীনতার পর এ
পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের আমলে নিজেদেরে আখের গুছিয়েছেন তারাই কেবল এ জন্য দায়ী?
কিছু লোকের হাতে অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে পড়ায় স্বাভাবিকভাবেই সমাজের অপর
অংশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র্য এবং এর অনুসঙ্গ হিসেবে অশিক্ষা-কুশিক্ষা ছড়িয়ে
পড়ছে। আসলে, এদেশের মানুষ দরিদ্র নয়,
তাদেরকে দরিদ্র করে রাখা হয়েছে। এ অবস্থার মূলে আছে নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য,
অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতি। সমাজ জীবনের শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য ধনী-গরীবের
বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ আজ জরুরি হয়ে
উঠেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন