বুধবার, ৪ জুন, ২০১৪

কর্ম যেভাবে ধর্ম হয়

কর্ম যেভাবে ধর্ম হয়

সাদিকুল হক ॥ কর্ম হলো সৃষ্টিশীল শক্তি পরিচালনা। যে কর্মের মাধ্যমে কোন কিছু সৃষ্টি হয় না তা কর্ম নয়। কর্মই ধর্ম কিন্তু সকল কর্ম ধর্ম নয়। সৃষ্টিশীল কর্মই ধর্ম। অন্যভাবে বলা যায়, যে কর্মের মধ্যে গুণ বর্তমান তা-ই ধর্মকর্ম। সংকীর্ণ অর্থে কেবল ভাল ও সৎ কর্মকে ধর্মকর্ম বলা হয় আর মন্দ ও অসৎ কর্মকে বলা হয় অধর্ম কর্ম। ব্যাপক অর্থে ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎ সকল কর্মই ধর্ম সম্বন্ধীয় কর্ম, যদি তা ঐচ্ছিক হয়। অনৈচ্ছিক কর্মের জন্য কর্তাকে দায়ী করা যায় না। যে কর্ম মানুষ স্বেচ্ছায় সম্পাদন করে তা ঐচ্ছিক কর্ম। ঐচ্ছিক কর্মের ক্ষেত্রে কর্তা কর্ম সম্পাদনের পূর্বে কর্মফল সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করে এবং কর্মটি সম্পাদনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐচ্ছিক কর্ম সৎ বা অসৎ, ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন তা ধর্ম সম্বন্ধীয়। কর্তা নিজের ইচ্ছায় যে কর্ম করে না তা অনৈচ্ছিক কর্ম। অনৈচ্ছিক কর্ম ভাল বা মন্দ, সৎ বা অসৎ যাই হোক না কেন তা ধর্মকর্ম নয়। কারণ অনৈচ্ছিক কর্মের জন্য কর্তাকে দায়ী করা যায় না। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, খরা ইত্যাদি মানুষের যতই উপকার বা ক্ষতি করুক না কেন তাকে ভাল বা মন্দ বলা চলে না। দৈহিক শক্তির আতিশয্যে বা ভাবাবেগে সে সব ক্রিয়া স্বতঃই সম্পন্ন হয় তাও ধর্মকর্ম নয়। দেহের অভ্যন্তরীণ কর্মও ধর্মকর্ম নয়। কারণ এসব কর্ম কর্তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না এবং কর্তা এসব কর্ম সিদ্ধান্ত মোতাবেক সম্পন্ন করে না। একইভাবে পূর্বধারণা ব্যতীত আত্মরক্ষার জন্য সাহজিক কর্মও ধর্মকর্ম নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনও কখনও কিছু কাজ আমরা করে ফেলি যা কষ্ট ও ক্ষতির কারণ হলেও ধর্মকর্ম নয়। যেমন হাত থেকে পড়ে কোন কিছু ভেঙ্গে যাওয়া।
সুতরাং, যে কর্ম মানুষ স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, উদ্দেশ্য সাধনের উপায় এবং ফল সম্বন্ধে চিন্তা করে সম্পাদন করে তা ধর্মকর্ম। ধর্মকর্মের চারটি স্তর আছে। অনুভূতির স্তর, চিন্তার স্তর, বাস্তবায়ন স্তর এবং সমাপ্তির স্তর। যেমন, প্রথমে আমরা ক্ষুধা অনুভব করি। ক্ষুধার অনুভব থেকে চিন্তা আসে ক্ষুধা নিবারণের উপায় সম্বন্ধে। উপায় সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত তা চিন্তার স্তরেই থাকে। ক্ষুধা নিবারণের লক্ষ্যে খাদ্যের যোগান এবং খাওয়া পর্যন্ত বাস্তবায়ন স্তর এবং খাওয়ার পর ক্ষুধা নিবৃত্তি হলো - এটি পরিসমাপ্তির স্তর।
কর্মের উৎস হলো অনুভূতি। অনুভূতি বাস্তবও হতে পারে আবার কাল্পনিকও হতে পারে। যেমন আমি প্রকৃতই ক্ষুধার্ত হতে পারি আবার এমনও হতে পারে যে আমি ক্ষুধার্ত নই কিন্তু কেউ মজাদার কিছু খাচ্ছে দেখে আমার মধ্যে খাওয়ার ক্ষুধা জেগে ওঠলো। ঠিক একইভাবে এখন আমি ক্ষুধার্ত নই কিন্তু রাতে কি খাব, পরের দিন কি খাব, ১০ বছর পরে কি খাব, আমার সন্তানরা কি খাবে এমন দূর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাও কাল্পনিক অনুভূতির সৃষ্টি করে। যে অনুভূতি থেকে আমরা ভাবতে শুরু করি ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা দূর করার উপায়।
অনুভূতির সীমানা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। কেবল সংস্পর্শ থেকেই অনুভূতি আসে না। মানুষ যা দেখে এবং শোনে তা থেকেও অনুভূতির সৃষ্টি হয়। মানুষ কেবল নিজের ক্ষুধাকেই অনুভব করে না অন্যের ক্ষুধাকে অনুভব করারও আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে মানুষের। তাই মানুষ কেবল নিজের ক্ষুধা নিবারণের নিমিত্তে কর্ম করে না, অন্যের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যও কর্ম করে। একইভাবে অন্যের সম্পত্তি, অর্থ, বিত্ত, যশ-খ্যাতি ইত্যাদিও মানুষের মধ্যে অনুভূতির সৃষ্টি করে এবং এসব অনুভূতি থেকে মানুষের মধ্যে পাওয়ার আকাঙ্খা জাগ্রত হয়।
পাওয়ার আকাঙ্খা যখন জাগ্রত হয় তখন মানুষ এমন কোন কর্মের কথা চিন্তা করে যা সে অতীতে করেছে, যা সে করতে পারে। এই স্তরে মানুষ চিন্তা করে। সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় অর্থাৎ মানুষ তার লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
পাওয়ার আকাঙ্খা থেকে মানুষ কর্ম শুরু করে। কিন্তু পাওয়ার আকাঙ্খাতো এক নয়। তাই এক কর্মের মধ্যে থেকেই তার মধ্যে অন্য বস্তু লাভের আকাঙ্খা দেখা দেয়। যখন আকাঙ্খা অনেকগুলো হয় তখন দেখা দেয় সমস্যা। কারণ সবগুলো আকাঙ্খা পূরণের সাধ্য মানুষের থাকে না। ফলে আকাঙ্খার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। নিজের মধ্যে শুরু হয় গ্রহণ বর্জনের বিচয়ন। কোন্‌টি গ্রহণ করবো আর কোন্‌টি বর্জন করবো এ নিয়ে চিন্তা আসে। যতক্ষণ এই চিন্তা থেকে গ্রহণ বর্জনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় থাকে। এ অবস্থায় খুঁটনাটি বিচার শুরু হয় - কোন্‌ আকাঙ্খাটি পূরণের উপায় ও ফলাফল কি এ নিয়ে তুলনামূলক বিচার বিশ্ল্লেষণ থেকে কোন একটিকে বিশেষভাবে চয়ন করা হয় কিংবা অগ্রাধিকার দেয়া হয়। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমরা কোন একটা আকাঙ্খাকে গ্রহণ করি এবং স্বাভাবিক ভাবেই এই গ্রহণ থেকে অন্যান্য আকাঙ্খার বর্জন হয়। একটি আকাঙ্খাকে গ্রহণ করে অন্যগুলোকে বর্জন করার নির্ণয়ই হলো সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত বিরোধের নিস্পত্তি ঘটায়।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর আসে তা বাস্তবায়নের স্তর। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রধান উপকরণ হলো দেহ। দেহের ইন্দ্রয়গুলোকে কর্মে নিয়োজিত ও পরিচালিত করে আমরা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হই। আকাঙ্খার বস্তু প্রাপ্ত হওয়া আমাদের কর্মফল। প্রাপ্তিতে প্রয়োজন মেটে এবং সুখ লাভ হয়। কর্মফল যদি প্রত্যাশার বিপরীত হয় তবে প্রয়োজন মেটে না এবং আমাদের  অসুখ বা দুঃখ প্রাপ্তি ঘটে।
মানুষ যখন এক বা একাধিক বস্তু লাভের আকাঙ্খা করে তখন চিন্তা করে যে ঐ বস্তু প্রাপ্তির মাধ্যমে তার দুঃখ দূর হবে। বস্তুটি নাই বলে সে দুঃখ সম্পর্কে সচেতন হয় এবং বস্তুটি প্রাপ্তির পর ভবিষ্যতে যে সুখ লাভ হবে তার কল্পনা তার মধ্যে কাল্পনিক সুখানুভূতির সৃষ্টি করে। চিন্তা জগতে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। না থাকার দুঃখ এবং পাওয়ার পর সুখ-কল্পনা তাকে অস্থির করে তোলে।

স্মর্তব্য, কাম্য বস্তু যদি এক হয় তাহলে তা পাওয়ার উপায় সম্বন্ধে আমাদের খুব ভাবতে হয় না, আমাদের ব্যক্তিত্বে দ্ধন্দ্ব থাকে না, আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হই না এবং চিন্তা ও কর্মে সমন্বয় সাধিত হয়, ফলে কাম্য বস্তুটি অতি সহজেই আমরা পেয়ে যাই। সুতরাং কাম্য বস্তু কম হতে হতে যখন 'এক' হয় তখন কর্ম প্রকৃত অর্থে ধর্ম হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন