বুধবার, ২৫ জুন, ২০১৪

লুটেরা শ্রেণীর নয়, সাধারণ মানুষের দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন দেখতে চায় জাতি



লুটেরা শ্রেণীর নয়, সাধারণ মানুষের দল হিসেবে
আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন দেখতে চায় জাতি

শেখ বর্ষা ॥ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন এক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ইতিহাসের বাস্তবতার আলোকে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এর আগে শাহবাগে জেগে ওঠা গণজাগরণ  মঞ্চের শক্তি এবং বিজয় মাস ডিসেম্বরে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায় কার্যকর করতে গিয়ে সরকারের সাহসী পদক্ষেপসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে পারার কারণেই বিএনপি-জামাত-হেফাজত শত চেষ্টা করেও ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বানচাল করতে পারেনি। এদিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৩ জনের এমপি হওয়ার ঘোষণা সংক্রান্ত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১৯ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন গত ১৯ জুন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত রায়ে বলেছেন, সংবিধানের সঙ্গে কোনো আইন বা বিধি সরাসরি সাংঘর্ষিক হলে আদালত তা বাতিল করতে পারেন। কিন্তু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১৯ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক নয়। বর্তমান আইন কাঠামোতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৩ এমপির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। এদিকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এই সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে বিশ্বসংস্থাটির মহাসচিব বান কি মুনের সাথে এক বৈঠকে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের রায় মেনে নিয়েছে এবং তারা উন্নত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলের সাথে সংলাপের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি বলেন, এ ব্যাপারে সরকারের কোনো আপত্তি নেই, তবে তা হবে সরকারের মেয়াদ শেষে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা কয়েকটি দেশ ছাড়া সকল দেশই ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছে। অর্থাৎ, বিএনপি-জামাত-হেফাজত যতই চেষ্টা করুক না কেন যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর, অন্যভাবে বলতে গেলে মিথ্যাচারের পক্ষ নিয়ে এদেশের  রাজনীতিতে টিকে থাকা যে কত কঠিন বা অসম্ভব তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির এখন একূল ওকূল, দুকূলই যাওয়ার অবস্থা দাঁড়িয়েছে। এর নেত্রী খালেদা জিয়া এবার বিরোধী দলের মর্যাদার আসনটিও হারিয়েছেন।
কিন্তু ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে পর পর দুই বার ক্ষমতায় এসে সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগ এখনো আবার যেভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে তা থেকে উত্তরণের পথ বের না করলে এই দলের ভাগ্যেও কি হবে তা এদেশের সচেতন ও বিবেকবান মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। সরকারের খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড এবং মানবসম্পদ উন্নয়নসূচকে যথেষ্ট উন্নতি করেছে, তবে এখানে বড় সমস্যা হলো সুশাসনের অভাব। একটি শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিকের জরিপে দেখানো হয়েছে, এর ৭৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ পাঠক অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন করে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়েছেন। এদিকে, ২৩ জুন ২০১৪ তারিখে আওয়ামী লীগের ৬৫-বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দেশের প্রবীণতম সাংবাদিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী তাঁর ‘কালের আয়নায়' ‘পঁয়ষট্টি বছরের বুড়ো বটগাছে কি নতুন পাতা গজাবে?' শীর্ষক কলামে লিখেছেন, “শেখ হাসিনার একটানা তিন দশকের বেশি সময়ের নেতৃত্ব দলটির ঐক্য রক্ষা করেছে।...কিন্তু শেখ হাসিনা যে কাজটি করতে পারেননি তা হলো, দলটির চরিত্রহীনতা ও ক্রমশ পিছিয়ে যাওয়া ঠেকাতে। আওয়ামী লীগের নাম থেকে কৃষক শ্রমিক কথাটি বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং রাজনীতির সেক্যুলার কালচার থেকে পিছু হটে হটে দলটি নামে না হলেও কাজকর্মে আবার আওয়ামী মুসলিম লীগের চরিত্রে ফিরে গেছে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতির অভিভাবক নব্য লুটেরা শ্রেণী বিএনপিকে তো জন্মলগ্নেই গ্রাস করেছে, এখন তারা অওয়ামী লীগেও অনুপ্রবেশ করে শক্ত মাফিয়া ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। এই মাফিয়া গোষ্ঠীর মধ্যে চলছে লুটের ব্যবসা নিয়ে প্রকাশ্য ও সশস্ত্র যুদ্ধ। ফলে দেশে খুন ও গুমের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়ছে। এই ঘাতকের দল ক্ষমতাসীনদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে এতই শক্তিশালী যে, তাদের দমনে প্রশাসন অক্ষম এবং আইনের শাসন দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না।....আওয়ামী লীগ সংগঠন হিসেবে এখন মহীরুহের মতো বিরাট হতে পারে। কিন্তু তার গোড়ায় ঘুণে ধরেছে। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে এই ঘুণের চিহ্নটিই তার শরীরে বড় বেশি প্রকট ? পারবে কি শরীরে নতুন রক্তের সঞ্চালন দ্বারা নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে; তার অসাম্প্রদায়িক সংগ্রামী চরিত্র ফেরত পেতে? পারবে কি অসাধু আমলা ও লুটেরা ধনীদের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে সময়ের দাবি মেনে নিয়ে নতুন রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে তুলতে?”(২১ জুন, ২০১৪, দৈনিক সমকাল) সারা দেশের প্রতিটি গ্রামে-মফস্বলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আওয়ামী লীগের শত-সহস্র নিবেদিতপ্রাণ, ত্যাগী  কর্মী-সমর্থকরাই দলটিকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে, তারাই বলতে গেলে দলটির প্রাণ ভোমরা। দলটির সভানেত্রী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে তাঁর দেয়া ভাষণ-বক্তৃতায় তাঁর দলের এই বাস্তবতার কথাটি অকপটে স্বীকারও করে থাকেন। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, দলটির নেতৃত্ব বর্তমানে নব্য ধনী, স্বাধীনতা-বিরোধীদের এজেন্ট, অসাধু আমলা ও ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে সেই সাধারণ নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের (যাদের প্রাণে নিরন্তর কাজ করে বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা) কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে কার্যকর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে  না পারলে দলটির জন্য ভবিষ্যতে আরও অন্ধকার অপেক্ষা করছে। তাই সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খা পূরণে দলটিকে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত করে তোলাই এখন সময়ের দাবি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন