স্বভাবে
প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিই
শান্ত হয় এবং
শান্তি প্রাপ্ত হয়
সাদিকুল হক ॥
স্বভাব বলতে - স্বরূপ, আত্মভাব, স্বপ্রকৃতি, প্রকৃতিগত ধর্ম বা গুণকে
বুঝায়। স্বভাব ব্যক্তির আচরণ, কর্ম, চিন্তা, অনুভূতি, আকর্ষণ ইত্যাদির উপর
প্রভাব ফেলে। জীবনের তথ্যে স্বভাব সুপ্ত থাকে। মানুষ জীবন প্রাপ্তির সাথে
সাথে কতগুলো সহজাত প্রবৃত্তিও প্রাপ্ত হয়। গ্রহণ-বর্জন, আত্মরক্ষা,
বংশরক্ষা ইত্যাদি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সহজাত প্রবৃত্তি স্বভাব নয় -
জীবভাব, কিন্তু সহজাত প্রকৃতি স্বভাব। 'স্বভাব ভাল না' বলতে আমরা 'অভ্যাস
ভাল না' বুঝাই। অভ্যাসকে স্বভাবে রূপান্তরিত করা যায়, কিংবা অভ্যাসের
মাধ্যমে স্বভাবকে প্রকট করা যায়। কিন্তু অভ্যাস স্বভাব নয়। অভ্যাসের মতো
চরিত্র শব্দটিও স্বভাব অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে স্বভাব এবং চরিত্রের
মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক। চরিত্র প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-রীতির সাপেক্ষে আচরণ।
চরিত্র অর্জিত হয় সঙ্গী সাথীদের কাছ থেকে এবং সামাজিক রীতি-নীতির সাথে
নিজেকে মানিয়ে নেয়ার মাধ্যমে। পরিবেশ বদল হলে চরিত্রও বদলে যায়। অভ্যাস ও
চরিত্র তা যত দীর্ঘদিনেরই হোক বদলানো যায় কিন্তু স্বভাব বদলানো যায় না।
কথায় বলে - 'স্বভাব যায় না মরলে ইল্লত যায় না ধুলে'।
পৃথিবীতে এক স্বভাবের দু'জন মানুষ পাওয়া যাবে না। জমজ
দেখতে প্রায় এক রকম হলেও এক স্বভাবের হয় না। মাতৃগর্ভে উপযুক্ত পরিবেশ না
পেলে যেমন মানুষের জন্ম হয় না ঠিক তেমনি উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে স্বভাব
বিকশিত হয় না। উপযুক্ত পরিবেশ সম্পর্কে কেবল এটুকুই বলা যায় যে, 'বন্যেরা
বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে'।
মানুষের স্বভাব বা প্রকৃতিই মানুষের ধর্ম। ইসলাম,
হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান - এগুলো শাস্ত্র ভিত্তিক সমপ্রদায়, ধর্ম নয়। বস্তুর
স্বভাবকে না জানা পর্যন্ত মানুষ কোন বস্তুকে তার নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার
করতে পারে না। আগুনের স্বভাবকে মানুষ জানতে পেরেছে বলেই আগুনকে ব্যবহার
করতে পারছে নিজের প্রয়োজনে। একই ভাবে মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের স্বভাবকে
জানতে না পারে ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে না।
অবশ্য, স্বভাব না জেনেও জৈবিক তাড়নায় মানুষ জীবন যাপন করতে পারে,
আত্মরক্ষার চেষ্টা ও বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
স্বভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত মানুষকে স্বাভাবিক বলা চলে।
জগতের বেশিরভাগ মানুষ স্বভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় অর্থাৎ স্বাভাবিক নয়।
কদাচিৎ, কোন মানুষ স্বভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত হলে অস্বাভাবিক মানুষেরা এই
স্বাভাবিক মানুষকে অস্বাভাবিক আখ্যা দেয়।
স্বভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায়
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা। দেশে দেশে এখন শুধু জীবিকা অর্জনের শিক্ষা আছে
স্বভাব জানার শিক্ষা নেই। অথচ একই সাথে দুটি বিষয়ই শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে
পারতো। শিক্ষার্থীর স্বভাব নির্ণয়ে শিক্ষকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে
পারতেন। কিন্তু শিক্ষকগণ এখন শুধু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় পাসের দিকেই
মনোযোগী। তারা অধ্যয়ন সম্পর্কিত বিষয়ে শিক্ষার্থীর উপর কর্তৃত্ব করেন
কিন্তু শিক্ষার্থীর কোন্ বিষয়ের প্রতি আগ্রহ রয়েছে এবং তার স্বভাব কি
সেদিকে নজর দেন না। তাই শিক্ষার্থী তার স্বভাবের উপর গড়ে উঠে না। শিক্ষাকে
আমরা আলোর সাথে তুলনা করি। নিজ স্বভাবকে জানাই হচ্ছে সেই আলো। বি.এ, এম.এ.
পাস ব্যক্তি নয়, স্বভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিই আলোকিত ব্যক্তি।
এক রাজা
শান্তির তাৎপর্য নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে উঠলেন। শান্তি কি? কিভাবে এবং কোথায়
শান্তি পাওয়া যায়? শান্তি দিয়ে কি করা যায়? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন তাকে
অস্থির করে তুলল। রাজা ঘোষণা করলেন - 'যে ব্যক্তি এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক
উত্তর দিতে পারবে তাকে পুরষ্কৃত করা হবে'। রাজ্যের সকল বুদ্ধিজীবি জড়ো হলো
রাজ দরবারে। রাজা সবার উত্তর শুনলেন কিন্তু কারোর উত্তরেই সন্তুষ্ট হতে
পারলেন না। সবশেষে এক বুদ্ধিজীবি রাজাকে তার চেনা এক সাধকের কাছে যেতে
বললেন। রাজা সাধকের স্মরণাপন্ন হলেন। সাধক সরাসরি প্রশ্নের কোন উত্তর না
দিয়ে রাজার হাতে একটা ধান তুলে দিয়ে বললেন, 'অনুসন্ধিৎসু হলে এই ধানটির
মধ্যেই আপনি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।' রাজা ধানটি নিয়ে
প্রাসাদে ফিরে এলেন। একটি ছোট সোনার বাক্সে ধানটিকে যতনে রেখে দিলেন।
প্রতিদিন সকালে একবার সোনার বাক্সটি খুলে ধানটির দিকে তাকিয়ে তার
প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেন কিন্তু কোন উত্তরই উদ্ধার করতে পারেন না। কিছুদিন
পর রাজা অন্য একজন সাধককে পেয়ে রহস্য উন্মোচনের জন্য সহযোগিতা চাইলেন। সাধক
ধানটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, 'এটা তো খুবই সহজ। এই ধানটি আমাদের
দেহের খাদ্যের প্রতীক আর শান্তি হচ্ছে আত্মার খাদ্যের প্রতীক। এখন, এই
ধানটিকে এইভাবে সোনার বাক্সে বন্দী করে রাখলে তো এর মধ্যে সুপ্ত
সম্ভাবনাগুলোর মৃত্যু ঘটবে। সে তার স্বভাবকে বাস্তবায়িত করতে পারবে না,
নিজেকে বিকশিত করে অনেক ধানে পরিণত হতে পারবে না এবং আপনার খাদ্যে পরিণত
হতে পারবে না।' এই ধানটিকে আলো, বাতাস, মাটি, পানির সাথে মিথষ্ক্রিয়া করতে
দিন, পরিবেশ তৈরি করে দিন, তাহলে দেখবেন সে স্বভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে,
নিজেকে বিকশিত করবে এবং আপনার এবং অন্য মানুষের খাদ্যে পরিণত হবে।'
স্বভাবকে বিকশিত করাই শান্তি কথাটার তাৎপর্য। স্বভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিই
শান্ত হয় এবং শান্তি প্রাপ্ত হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন