নজরুলের সূফী চেতনা
সালাহউদ্দিন আহমদ
॥ সূফী মতানুসারে
মানুষ হলো আল্লাহ'র প্রতিফলিত রূপ বা আল্লাহ'র প্রতিনিধি। আল্লাহ সিন্ধু হলে প্রতি
মানুষ হলো এক একটা জলবিন্দু। সূফী চেতনার খাঁটি প্রকাশ নজরুলের কালামে এভাবে বর্ণিত
হয়-
'সিন্ধু হতে বিচ্ছেদেরই দুঃখে কাঁদে
বিন্দুজল,
সত্য শুধু পূর্ণ, বাকী অন্য যা
তা নাস্তি সব,
ঘূর্ণ্যমান ঐ এক সে বিন্দু বহুররূপে
করছে ছল।'
সত্যিকারের সূফী চেতনা নজরুল তাঁর রুবাইতে বিশদ ব্যাখ্যা
করেন এভাবে-
'আকাশ পানে হতাশ আমি চেয়ে থাকি
নির্ণিমিষ
'লওহ' 'কলম' বেহেশত-দোজখ কোঁথায়
থাকে কোন সে দিক।
অন্ধকারে পেলাম আলো, দরবেশ এক কইল
শেষ-
'লওহ' 'কলম' বেহেশত দোজখ তোরি মাঝে-নয়
অলীক।'
অর্থাৎ 'সৃষ্টিকালে সৃষ্টি হলে আমি কলম ও ফলক চেয়ে নিলাম,
বেহেশত ও দোজখও চেয়ে নিলাম। কিন্তু আমার মুর্শিদ দূরদর্শিতার সঙ্গে বললেন, কি করছিস,
কলম ও ফলক, বেহেশত ও দোজখ তো তোর নিজের কাছে'।
সূফীদের মত হলো 'ওয়াজাত আল অজুদ' - 'আল্লাহ সর্বত্র বিরাজিত'
প্রত্যেক মানুষের ভেতর আল্লাহ আছেন। মহাগ্রন্থ কুরআনে আছে 'তুমি যে দিকে ফের না কেন,
আমার মুখ তোমার দিকে রয়েছে, আলাস্তু বেরাব্বিকুম, মায়ের পেটের শিশু পর্যন্ত এর আওতাধীন।
সূফী নজরুলের সমস্ত কালামে সতর্কীকরণ ও দিক নির্দেশনায় ভরপুর যা মানব মুক্তির সহায়ক।
জগতের সব গুরুই এক-সবাই আলোর সন্তান। সবার দর্শনই এক ও অভিন্ন, যার মূল কথা হলো বন্দীদশার
অবসান বা মুক্তির আন্দোলন। এই দর্শনকেই সামনে রেখে সবাই যার যার শিষ্যদের তালিমের কাজ
তথা মানুষকে দুনিয়ামুক্ত তথা শিরকমুক্ত করে মুক্তির দেশের সন্ধান দেন। গুণগত দিক থেকে
এরা এক, যদিও ভিন্ন ভিন্ন দেখায়। নজরুল তার কালামের মাঝে সাধকগণের যাতে বিভক্তি না
আসে তার জন্য বলেন :
'প্রেম এক, প্রেমিকা
যে বহু,
বহু পাত্রে ঢেলে
পিব সেই প্রেম
সে শরাব লোহু।
তোমারে করিব পান,
অনামিকা, শতকামনায়
ভৃঙ্গারে, গেলাসে
কভু, কভু পেয়ালায়।'
এখানে প্রেম হলো নূর বা আলো বা ফয়েজ বা যা সকল গুরু থেকেই
সাধকরা প্রাপ্ত হন। অনামিকাও এরই প্রতীক। এই অনামিকার নাম আনতে না পেরেই মানুষ জন্ম-জন্মান্তরে
ঘুরতে থাকে। তাই দানপাত্রও বহু যেমন ভৃঙ্গার, গেলাস, পেয়ালা। এসব মানব দেহ এবং গুরুদেরই
প্রতীক। গুরুরা তাঁদের যে অংশটা সাধকের মাঝে অনামিকারূপে বিরাজ করে তা নামে আনার শিক্ষা
দেন। শিষ্যের কাছে যা অনামিকা তাই গুরুর মাধ্যমে নামে আসে এবং প্রেম ও শরাব নাম ধারণ
করে। আসলে এটা গুরুরই বা গুরুদের অংশ। যেমন প্রতি সৃষ্টিতেই মোহাম্মদী নূর বিদ্যমান।
মহানবীর বাণী 'কুলুবুন মোমেনীনা আরশাল্লাহ'। মোমেনের ক্বল্ব আল্লাহর আরশ। সূফী নজরুলও
বলেন :
'সকল শাস্ত্র খুঁজে
পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ,
হাসিতেছেন তিনি অমৃত-হিয়ার
নিভৃত অন্তরালে!
এই হৃদয়ই সে নীলাচল,
কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম
এ-মদীনা কাবা-ভবন,
মসজিদ এই , মন্দির
এই, গির্জা এই হৃদয়,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়
কোন মন্দির কাবা নেই।'
মহানবী বলেছেন, 'ক্বল্ব' আর নজরুল বলেছেন প্রাণ, হৃদয়,
হিয়া কন্দর - ঐ একই কথা। কী অপূর্ব মিল ! আবার এই অনুসারে নজরুল যে মোমেন ছিলেন তার
প্রমাণ মেলে এভাবে :
'মোর বুকে অহরহ জাগিছেন
সত্য ভগবান।'
নজরুলের মাঝে আল্লাহ চির জাগ্রত ছিলেন এটা স্পষ্ট এবং সে
জাগ্রত অবস্থাটিকে বলা হয়েছে অহরহ অর্থাৎ সব সময়। আবার যাদের ক্বলব-এ বসা আল্লাহ জাগ্রত
নয়, সেটাকে কিভাবে জাগাতে হবে, বিদ্রোহটা নফস্-এর সাথে কিভাবে করতে হবে, দেহ নামক
মিথ্যাপূরী বা মিথ্যা জগত কিভাবে বিচূর্ণ করতে হবে, মরার আগে মরে কিভাবে অমৃতে যেতে
হবে, দেহে যা আছে তা কুটি কুটি করে বা অনু অনু করে ভেঙ্গে - আত্ম জাগ্রত না হলে,
সাহেব না জেগে উঠলে তখন বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশটা কি হবে এবং তার স্বরূপটা কি তা নীচের
আয়াতে দেখা যায় :
'জ্বলে ওঠ্ এইবার
বাজা ! জ্বালা তোর বিদ্রোহের রক্ত শিখা অনন্ত পাবক।
আন তোর বহ্নিরথ,
বাজা তোর সর্বনাশা তুরী !
হান তোন পরশু ত্রিশুল।
ধ্বংস কর এই মিথ্যাপূরী !
রক্ত সূধা বিষ আনো
মরনের ধর টিপে টুটী।
এ মিথ্যা জগত তোর
অভিশপ্ত, জগদ্দল চাপে হোক কুটি কুটি।'
এখানে বিদ্রোহের ভাবটার সাথে জেহাদীর মনোভাবটা ফুটে উঠেছে
এবং এই জেহাদ তারই নফসের বিরুদ্ধে। তাই মিথ্যা জগত, মিথ্যাপূরী দেহ ও মনের বন্ধন ধ্বংস
করে, মরার আগে মরে অর্থাৎ মরণের টুটী চেপে ধরে অমৃতের সন্তান হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
অমৃতের সন্তান হয়ে চির অমর হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে এখানে এবং নজরুলের সূফী চেতনার
আত্মপ্রকাশ/আত্ম-দর্শনও হয়েছে। নজরুলের কালামে বিদ্যমান যেমন :
'আমি মুক্ত জীবনান্দ।'
নজরুল শুধুমাত্র মুসলমান চেতনায় কাব্য রচনা করেননি, অন্য
ধর্মীয় বা সম্প্রদায়ের ধর্ম ও আচার/চিন্তাকে অতিশয় উচ্চমূল্যে কাব্যে স্থান দিয়েছেন।
নজরুলের কবি জীবনের চতুর্থ স্তরে ধর্মাশ্রয়ী কবিতা ও মরমীয় গান এক বিশেষ স্থান ও মহিমা
লাভ করেছে। এ সময়ের একটি কবিতায় -
'আল্লাহ পরম প্রিয়
মোর, আল্লাহতো দূরে নয়
নিত্য আমাকে জড়াইয়া
থাকে পরম সে প্রেমময়।'
আধ্যাতিকতা বা সূফী চেতনার সে স্তরে উত্তীর্ণ হয়ে নজরুল
এ সকল কথা বলেছেন তার গূঢ় রহস্য পৃথিবীর একমাত্র সূফী সাধকেরাই উপলব্ধি করতে সমর্থ
হবেন। নজরুলের রুবাই প্রকৃতগতভাবে ইসলামি ঘরানা। ইসলামকে জানার জন্য শাস্ত্র কিংবা
প্রাতিষ্ঠানিকতায় না গিয়ে গভীর আন্তরিকতা নিয়ে সূফী নজরুলকে পড়লে সম্পূর্ণ ইসলাম ধর্মকে
ও পরিবেশকে আয়ত্ত করতে কষ্ট হবে না।
দেহ ও মনে যা উদয় ও বিলয় হয় তার প্রতি সজাগ থাকার নাম সালাত।
এই সালাতের মাধ্যমেই রবের জাগরণ তথা আত্মদর্শন বা সূফী চেতনার উন্মেষ ঘটে। এই রবের
ঘরটিই যে দেহ তা নজরুলের বানীতে পাওয়া যায় এভাবে -
' হেথা স্রষ্টার
ভজনালয় এই দেহ ও মন,
হেথা মানুষের বেদনায়
তার দুঃখের সিংহাসন।
সাড়া দেন তিনি এখানে,
যে নামে তাহারে যে কেহ ডাকে,
যেমন ডাকিয়া সাড়া
পায় শিশু যে নামে ডাকে সে মাকে।'
রবের সিংহাসন তথা আরশ এই মানব দেহেই অবস্থিত 'কুলুবুন মোমেনিনা
আরশাল্লাহ' ইঙ্গিতটুকু এখানেও বিদ্যমান। এখানে যে নামে যে কেউ ডাকে অর্থাৎ মানবদেহে
খোঁজে, তাকে রব সাড়া দেন। কুরআনের এই তাত্ত্বিক আয়াতটির প্রায়োগিক দিকটাই বা ব্যাখ্যাই
হলো নজরুল আয়াত যা নজরুল জীবনে মূর্ত হয়ে উঠেছিলো। নজরুলের এসব পংক্তি-ছন্দ থেকেই তার
সূফী চেতনায় স্বরূপ বোঝা যায় তিনি কত উচ্চমার্গের সূফী বা আলোর সন্তান ছিলেন।
আমিত্বের উপসর্গের নাম যাকাত। এই যাকাতের কাজটিও নজরুল পূর্ণভাবেই
করেছেন - যা তাঁর আয়াতে পাওয়া যায় এভাবে - 'আজ আমার সকল সাধনা, কমনা-বাসনা, চাওয়া-পাওয়া,
জীবন মরণ তাঁর পায়ে - অঞ্জলি দিয়ে আমি আমিত্বের বোঝা বওয়ার দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়েছি।'
আত্মদর্শন/সূফীচেতনা হলো হজ্বে আকবর এবং যাদের
তা হয়ে গেছে তাঁরা আলোর সন্তান বা আলে মোহাম্মদ। তাঁরা নিজেরাই তোয়াফ করেন, নিজেকেই
কুর্ণিশ করেন। তাইতো নজরুলের কণ্ঠে বিঘোষিত হয়েছে :
'আমি আপনারে ছাড়া
করিনা কাহারেও কুর্ণিশ।'
' আমি চিনেছি আমারে,
আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।'
এই দেহ ও মনোজগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বিদ্রোহী হয়ে যিনি
সূফী চেতনায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, চিরবিজয়ী হয়েছেন তিনি হলেন আমাদের নজরুল, সাধক নজরুল।
নজরুল কাব্য-দর্শন নজরুল সূফী চেতনারই প্রকাশ মাত্র।
চমৎকার
উত্তরমুছুন