ধর্ম ও
বিজ্ঞান - সমন্বয়ের ভিত্তি
সিদ্ধার্থ ॥
আমরা এতদিন শুনে এসেছি - ধর্ম ও বিজ্ঞান পরস্পরবিরোধী, কোন ব্যক্তি এ দুটির
যে কোন একটির সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে কিন্তু এক সঙ্গে দুটির সঙ্গে নয়।
কিন্তু সত্য হলো এই যে, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, উভয়ই জীবন ও
জগতকে ব্যাখ্যা করার দুটি দৃষ্টিকোণ। একজন ধার্মিক অবশ্যই বিজ্ঞানী অর্থাৎ
বিশেষ জ্ঞানী। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে যেটুকু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তা
কেবল মাত্রাগত। মাত্রাটি হলো - বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আরাম পাওয়া
যায় আর ধর্ম জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে শান্তি পাওয়া যায়।
বিজ্ঞান যেমন পর্যবেক্ষণজাত আবিষ্কারের প্রচেষ্টা, ধর্মও
তেমনি। তবে ধর্মের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণের বস্তু হচ্ছে পর্যবেক্ষক স্বয়ং।
ধর্মীয় পর্যবেক্ষণ অবশ্যই যুক্তির উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। যুক্তিগুলো হলো
এমন - প্রথমে নিজে কি ধারণ করে আছে তার মধ্য থেকে যে কোন নির্দিষ্ট একটিকে
নিশ্চিতভাবে জানা। এরপর একটির সাথে অন্যটির নিয়মসূত্র উপলব্ধি করা। এই
উপলব্ধি থেকে গবেষক বা উপাসক নিজের আচার-আচরণ ও ধর্ম-অধর্ম সকল কর্ম
সম্বন্ধে সুশৃঙ্খল ধারণা তৈরি করেন। কোন আদর্শ না থাকলে এ ধারণা তৈরি করা
সম্ভব হয় না। কোন কিছুকে ছোট বা বড়, কাছে বা দূরে, ধর্ম বা অধর্ম নির্ণয়
করতে হলে মানদণ্ড অবশ্যই প্রয়োজন। এই মানদণ্ডই ধর্মের ক্ষেত্রে আদর্শ, যার
ভিত্তিতে উপাসক ধর্ম-অধর্ম নির্ণয় করেন।
বিজ্ঞানও কোন একটি তত্ত্ব বা বস্তুকে প্রথমে ধারণ না করে
গবেষণা করতে পারে না। বিজ্ঞানের যেমন ব্যবহারিক মূল্য আছে তেমনি ধর্মেরও
ব্যবহারিক মূল্য আছে। কেবল আদর্শ সম্বন্ধীয় তত্ত্ব চর্চা করাই ধর্মের কাজ
নয়। ধর্মের কাজ - চর্চা ও চর্যা। অর্থাৎ, কিভাবে ধর্মতত্ত্বকে দৈনন্দিন
জীবনে প্রয়োগ করে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি, আদর্শকে কি উপায়ে লাভ করতে
পারি তার চর্যাই হলো ধর্মের প্রধান কাজ। এদিক থেকে ধর্ম হচ্ছে আদর্শনিষ্ঠ
ব্যবহারিক বিজ্ঞান। আদর্শের তাত্ত্বিক আলোচনা ধর্মের মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য
বিষয় হলো - বাস্তব জীবনে আদর্শ প্রয়োগ করার শিক্ষা গ্রহণ। বিজ্ঞান ও ধর্ম
বাস্তব জীবনে প্রয়োগ না হওয়া পর্যন্ত কোন কাজেই আসে না। যে তত্ত্বের কোন
প্রয়োগ নাই তা মূল্যহীন। যে ধর্মবোধের সাথে প্রয়োগের বাধ্যতাবোধ নেই তা
অর্থহীন। তাই ধর্মবিজ্ঞান যেমন ধর্মজীবনের উপাদানগুলো ব্যাখা করে তেমনি
ধর্ম কোন দিকে ধাবিত হওয়া উচিত তারও নির্দেশ দান করে। ধর্মবিজ্ঞান আচরণকে
সুনিয়ন্ত্রিত করার নীতি নির্ধারণ করার পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে
নিজ জীবনে সেই নীতির বাস্তবায়ন করে। তাই ধর্মবিজ্ঞান মানবচেতনার উপাদানগুলো
যথা - অনুভূতি, বোধ, বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, আসক্তি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে।
ইত্যাদি আলোচনার মাধ্যমে ধর্মবিজ্ঞান নিজের বিচার নিজে করার মূল্য নির্ধারণ
করে। ধর্ম এমন একটি জটিল বিষয় যেখানে নিজেই বিচারক আবার নিজেই বিচারের
বিষয়বস্তু।
বিচারের সময় আদর্শকে সবসময় সম্মুখে রাখতে হয়। এই আদর্শটি
কি? আদর্শের স্বরূপ কি - এ নিয়ে ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন মত ও পথের সৃষ্টি
হয়েছে। কেউ বলে শাস্ত্রই সেই আদর্শ, কেউ বলে অবতার বা ধর্মপ্রচারকগণ হচ্ছেন
সেই আদর্শ, কেউ বা বলেন শান্তিই হচ্ছে সেই আদর্শ আবার অনেকের মতে গুরুই
হচ্ছেন সেই আদর্শ। যে কোন মত বা পথে ত্রুটি আবিষ্কার করতে গভীর পাণ্ডিত্যের
প্রয়োজন হয় না। জগতে এমন কোন বিষয় নেই যার বিরুদ্ধে যুক্তি উত্থাপন করা যায়
না। সুতরাং তুলনামূলক আলোচনা করে ধর্মতত্ত্বের নিন্দা কিংবা উৎকর্ষের
প্রমাণ দেয়া যায় না। এতে কেবল বিরোধই সৃষ্টি হয় ঐক্য হয় না। এক্ষেত্রে 'যার
যার আদর্শ তার তার' - নীতি গ্রহণ করাই শ্রেয়।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও
জীববিজ্ঞান যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন রয়েছে ধর্মবিজ্ঞানের। ধর্মকে যখন
বিজ্ঞান বলা হয় তখন অবশ্যই পুরাতন পদ্ধতি সংস্কার করা কর্তব্য।
ধর্মবিজ্ঞানকে স্থাপন করতে হবে অভিজ্ঞতা, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে।
তাহলে পদার্থবিজ্ঞান মানবজাতির জন্য যে কল্যাণ সাধন করেছে ধর্মবিজ্ঞানের
চর্যা মানবজাতির জন্য এর চেয়ে অনেক বেশি কল্যাণ সাধন করবে।
ধর্মবিজ্ঞানে যেহেতু ব্যক্তি নিজেই বিচার্য বিষয় সেহেতু
নিজেকেই পরীক্ষায় স্থাপন করতে হয়। নিজের পরীক্ষাগারে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত
হলেই কেবল আমাদের পক্ষে ধর্ম ও বিজ্ঞানের সমন্বয় তথা ধর্মবিজ্ঞান
প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে এবং কার্যোপযোগিতার দিক থেকে তা হবে সেরা
বিজ্ঞান, যেমনটি ছিল এককালে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন