বুধবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৪

সময়ের সাফ কথা .... 'সুশীল সমাজ' ও 'নাগরিক সমাজ'র সর্বজনীন সংজ্ঞা প্রণয়ন আজ জরুরি



সময়ের সাফ কথা ....
 'সুশীল সমাজ' ও 'নাগরিক সমাজ'র 
সর্বজনীন সংজ্ঞা প্রণয়ন আজ জরুরি

শেখ উল্লাস ॥ বাংলা একাডেমীর সহজ বাংলা অভিধানে 'শীল' শব্দটির অর্থ স্বভাব, চরিত্র (সুশীল), আচার-আচরণ, রীতিনীতি, বৌদ্ধদের অবশ্যপালনীয় নীতি (পঞ্চশীল) ইত্যাদি। আবার, 'সুশীল' শব্দের অর্থ হিসেবে সুবোধ, সচ্চরিত্র, ভদ্র, স্বভাব-চরিত্র ভালো এমন বলে উল্লেখ রয়েছে। আর 'কুশীলব' শব্দের অর্থ নাটকের অভিনেতা অভিনেত্রী। এছাড়া 'নাগরিক' শব্দের অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে, নগরের অধিবাসী, কোনো নির্দিষ্ট দেশের মানুষ, শহুরে ও নগর-সংক্রান্ত। নাগরিক, শীল ও সুশীল-এ তিনটি শব্দ বিশেষণ এবং কুশীলব শব্দটি বিশেষ্য।
বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় এর পক্ষে-বিপক্ষে সুশীল ও নাগরিক সমাজের ব্যানারে বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতি উঠে আসায় উল্লিখিত শব্দগুলোর সর্বজনীন সংজ্ঞা প্রণয়ন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, বাংলা একাডেমীর অভিধানে এই শব্দগুলোর অর্থ দেয়া থাকলেও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজ বলতে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই, সবার কাছে এই সব শব্দের গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা নেই। ফলে সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের ব্যানার থেকে আসা কোনো বক্তব্য যখন দেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তখন সচেতন ও বিবেকবান মহলে প্রশ্ন উঠেছে দেশে সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের ব্যানারে যারা কথা বলছেন তারা কারা? তারা কি পক্ষপাতমুক্ত? নাকি তারাও পক্ষপাতদুষ্ট? তারা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন? এই গুটি কয়েক লোক বাদে যারা এদেশে বসবাস করছেন, যারা নগরে বাস না করে গ্রাম-মফস্বলে বাস করছেন তারা কি সুশীল নয়? তারা কি এদেশের  নাগরিক নয়?
দেশে বর্তমানে নবম জাতীয় সংসদ বহাল রয়েছে। এই সংসদে সদস্য (এমপি) হিসেবে শপথ নেয়ার সময় তারা দেশের সংবিধান ও সকল আইন মেনে চলার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু তারা  সেই অঙ্গীকার কতটুকু পূরণ করেছেন তা আজ বহুলাংশেই প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া, বিরোধী দলের নেতা এবং এমপিরা কেউ এখনো নবম জাতীয়? সংসদ থেকে পদত্যাগ করেননি এবং তারা রাষ্ট্রীয় ও সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। সংবিধানের আওতায় ৫ই জানুয়ারি দেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব প্রক্রিয়া শেষে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তত্তাবধায়ক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করলেও বিরোধী দল এ ক্ষেত্রে কোনো সফলতা লাভ করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশন তার আইনী বাধ্যবাধকতার মধ্যে থেকে মনোনয়ন পত্র বিতরণ, জমা ও প্রার্থীতা প্রত্যাহারের তারিখসহ যাবতীয় কার্যক্রম সবার জন্যই উন্মুক্ত রেখেছিল। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সেখানে অংশ নেয়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত বিরোধী দল ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি'র মত একটি বড় দল কতটুকু ভুল করেছে তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। তবে এ কথা সত্য যে এ নির্বাচন না হলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দেবে এবং একটি অসাংবিধানিক সরকার দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে যা কখনো কারোর জন্য মঙ্গলজনক নয় এবং এ বিষয়টি সম্পর্কে দেশ-বিদেশের সবাই আজ অবগত। বর্তমান বাস্তবতায় একথাটিও এদেশের সচেতন মানুষ ভুলে যায়নি যে, বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যতই আন্দোলন করুক না কেন, এই সরকারের প্রধান কে হলে তিনি নির্বাচনে যাবেন সেটাও তিনি কখনো পরিস্কার করেননি। কারণ, সংবিধানের সংশোধনী অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা ছিল, যার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া প্রথম থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছেন। ফলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কাউকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে প্রধান বিরোধী দলের মেনে নেয়া একটি অলীক বিষয় ছাড়া কিছু নয়। এমনই যখন অবস্থা তখন গত ২৮ ডিসেম্বর শনিবার রাজধানীর গুলশানে এক অভিজাত হোটেলে এক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের 'সুশীল সমাজ' বা 'নাগরিক সমাজ'র বিশিষ্ট কয়েকজন সংঘাত এড়াতে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন পিছিয়ে সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, দুই নেত্রী সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে চাইলে এখনও সমঝোতার সুযোগ আছে। তারা মনে করেন, একতরফা নির্বাচন কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বর্তমান পরিবেশে নির্বাচন হলে সহিংসতা আরও গভীর হবে। বিরোধী দল বর্জন করায় এ নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো সমাধান আসবে না। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার জোরালো দাবি যে কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তি করেছেন তাদের কেউ বিগত 'ওয়ান ইলেভেন' খ্যাত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, কেউ দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক। গোলটেবিলে ইংরেজি দৈনিক ডেইলী স্টার সম্পাদক বলেন, যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী। আইনী প্রক্রিয়ায় এই নির্বাচন স্থগিত করা যায় কি-না সে বিষয়ে উচ্চ আদালতের শরাণাপন্ন হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। সংসদ অধিবেশন ডেকে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব কি-না সে বিষয়টি বিবেচনায় আনতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানান। আবার রাষ্ট্রপতির মধ্যস্থতায় নির্বাচন করার পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৯ ডিসেম্বর রোববার এব্যাপারে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ১/১১'র কুশীলবরা আবারও সক্রিয় হয়েছে। তিনি বলেন, পত্রিকায় দেখেছি, কয়েকজন 'বিশিষ্ট নাগরিক' আমাদের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। আমি তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। তবে তাদের অনেককইে আমরা ১/১১'র পর দেখেছি এবং তারা এখন আবারও সোচ্চার হয়েছেন।'' প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি তাদের একটি কথাই বলতে চাই, তাদের এই চেতনা কেন এত বিলম্বে জাগ্রত হলো? বিএনপি-জামাত চক্র যখন হরতাল দিয়ে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা বন্ধ করে দিল, তখন কেন তাদের এই চেতনা জাগ্রত হয়নি? তখন তারা কেন বিরোধী দলকে শিশুদের পরীক্ষার সময় হরতাল না ডাকার পরামর্শ দেননি? বিএনপি-জামাতের সন্ত্রাসীরা তথাকথিত হরতালের নামে যখন বাসে বোমা মেরে শিশুসহ ঘুমন্ত মানুষ হত্যা করে এবং নির্বিচারে গাছ কাটে ও উপড়ে ফেলে, তখন তারা কেন নীরব থাকেন? শেখ হাসিনা বলেন, আসন্ন নির্বাচন একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়ার পর 'বিশিষ্ট নাগরিক'রা তা বন্ধ করতে চান। এ মুহূর্তে নির্বাচন বন্ধ হলে আমাদের অসাংবিধানিক পথ বেছে নিতে হবে। আমি জানি না, তারা এ ধরনের অসাংবিধানিক ব্যবস্থা চাইছেন কি-না। দেশে যখন  গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব থাকে না এবং অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়, তখন এসব বিশিষ্ট নাগরিক সক্রিয় হন। ওই সময় তাদের কদর বেড়ে যায় এবং তারা পতাকা নিয়ে চলাফেরা করতে পারেন। তিনি আরও বলেন, বিশিষ্ট নাগরিকরা এখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম যখন তা-ব চালিয়েছিল এবং পবিত্র কুরআনের হাজার হাজার কপি পুড়িয়েছিল, তখন তারা কেন নীরব ছিলেন? বিরোধী দলীয় নেতা যখন তার (প্রধানমন্ত্রী) সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন, তখন এসব বিশিষ্ট নাগরিক কিছুই বলেননি। তিনি বলেন, 'তখন তাদের চেতনা কেন জাগ্রত হয়নি? তারা সব সময় এমন একটা পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করেন, যখন তাদের ডাকা হয় এবং কদর বাড়ে।
তবে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন কেবল পেছালেই যে দেশের সকল সংকটের অবসান হয়ে যাবে-এমন কোনো নিশ্চয়তা দেননি বা দিতে পারেননি গোলটেবিলে উপস্থিত  বিশিষ্ট নাগরিকেরা। অবশ্য এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও এর আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মঞ্জুর এলাহীর বক্তব্যটুকু ছিল প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, শুধু নির্বাচন পেছালে সমস্যার সমাধান হবে না। নির্বাচন স্থগিতের ৯০ দিনের মধ্যে সমাধান না হলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দেবে। তাই সংকট মোকাবেলায় তার আগেই সুনির্দিষ্ট প্যাকেজ কর্মসূচি দিতে হবে। জঙ্গিবাদ উত্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রবীণ এই ব্যবসায়ী বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ হলে চলবে না। তাই যদি হয়, তা হলে স্থায়ীভাবে গণতন্ত্র হারাবে বাংলাদেশ। এদেশে এখনো যারা নিজেদের বিবেক ও মর্যাদা নিয়ে চলেন  তারা বলছেন, সুশীল ও নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনদের ব্যানারে যারা টিভির 'টক শো' বা অভিজাত হোটেলে বসে রাজনৈতিক বিষয়ে পরামর্শ চান তারা নিজেরা দেশের রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত হলে জনগণের সুখ-দুঃখের সাথে আরও বেশি সম্পৃক্ত হতে পারতেন। বিশেষ করে যারা সংবাদপত্রের সম্পাদক বা  গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত তাদের বেলায় এ কথাটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ, এদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার মতো সমাজকর্মে যারা এদেশে পথিকৃৎ ছিলেন সেই কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আকরাম খাঁ, কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিনের মতো সম্পাদক-সাংবাদিকরা সবাই ছিলেন জনদরদী, জনগণের নেতা, জনপ্রতিনিধি বা জননেতা। তাঁদের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে বিশিষ্ট জনের মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য আজকের দিনের 'সুশীল সমাজ'র নেতৃবৃন্দকে মানুষের কাতারে আরও গভীরভাবে মিশে যাওয়ার প্রমাণ দেখানো এখন তাই জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ এদেশের অধিকাংশ মানুষের বাস এখনো গ্রামে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে সেই সব গ্রামের মানুষদের সত্যিকারের বন্ধু হওয়া বড়ই কঠিন এবং তার বিপরীতে অনেকটাই সহজ 'টক-শো'তে বসে পরামর্শ প্রদান করা। প্রতিবারের মতো এবারও নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী এদেশের যেকোনো বিশিষ্ট জন জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারতেন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে। কিন্তু এদেশের বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচনে অংশ নিয়ে ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর মতো ধৈর্য এইসব বিশিষ্টজনদের আছে কি? এক্ষেত্রে রাজনীতিজীবীরাই অনেক বেশি ধৈর্যশীল এবং অভিজ্ঞ ও দক্ষ। ফলে প্রচলিত রাজনীতিজীবীদের হাতেই দেশের রাজনীতি করার কাজটি থাকাই বেশি যৌক্তিক। কিন্তু এই সব বিশিষ্টজনেরা এইসব ঝক্কি-ঝামেলার ভাগিদার হলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আরও উন্নত হবে এবং 'সুশীল সমাজ' বা 'নাগরিক সমাজ'র ব্যানার ব্যবহার তাদের পক্ষে তখনই হবে যুক্তিসঙ্গত। আর তা না হলে এসব ব্যানারের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি উঠতেই থাকবে সমাজের বিভিন্ন মহলে এবং এই শব্দগুলোর সর্বজনীন সংজ্ঞা প্রণয়নের দাবি  দিন দিন আরও জোরালো হয়ে দেখা দেবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন