মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৪

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াল গণজাগরণ মঞ্চ ও বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফ



ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াল গণজাগরণ মঞ্চ
ও বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফ

সংলাপ ॥ গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সারাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা এক বিভৎস আকার ধারণ করে। দেশের আনাচে কানাচে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একশ্রেণীর ধর্মান্ধ দুর্বৃত্তদের রাজনৈতিক লক্ষ্যবস'তে পরিণত হয়। যশোর, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁওসহ সারাদেশে অসংখ্য সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের বসতবাড়িতে হামলা, তাদের সহায় সম্পত্তি ধ্বংস ও লুটপাট করা হয়েছে। তাদের সারাজীবনের অর্জিত সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে, তাদের গবাদি পশু ও ফসল লুট করা হয়েছে, নারীদের গায়ের গহনা থেকে শুরু করে মাছ ধরার জাল, বাচ্চাদের পড়ার বই এমনকি রান্না করা খাবার পর্যন্ত কোনো কিছুই ধর্মান্ধ জঙ্গীদের তাণ্ডব থেকে রেহাই পায়নি। তাদের ঘরগুলোকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। প্রাণভয়ে অসংখ্য মানুষ আজ ঘরছাড়া। নিরাপত্তাহীনতার কারণে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতেও তারা ভয় পাচ্ছেন। এমনই এক পরিসি'তিতে ‘ঢাকা-মালোপাড়া রোডমার্চ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় গণজাগরণ মঞ্চ। গণজাগরণ মঞ্চের এই কর্মসূচির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বাংলাদেশে সূফীতত্ত্বের ধারক-বাহক তরুণ প্রজন্মের বাংলাদেশ  হাক্কানী খানকা  শরীফ।
গত ১০ জানুয়ারি শুক্রবার সকাল ১০টায় বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফের সম্মানিত সভাপতি শাহ্‌ সূফী ড. এমদাদুল হক এঁর নেতৃত্বে শাহ্‌ উপাধিধারী আলিম ও সহযোগী সদস্যগণ শীতবস্ত্র, শাড়ি, লুঙ্গি, ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে শাহবাগ থেকে মালোপাড়ার উদ্দেশ্যে রোডমার্চ শুরু করেন। রোডমার্চ চলাকালে প্রথম পথসভাটি হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি গেটে বেলা সাড়ে ১২ টায়। এরপর মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড, ফরিদপুর শহরের জনতা ব্যাংকের মোড়, মধুখালীতে মধুবন মার্কেটের সামনে এবং মাগুড়া খানপাড়া বটতলায় পথসভা শেষে রাত ১১টায় যশোর শহরে পৌঁছে প্রথমদিনের মতো  রোড মার্চ মুলতবি করা হয়।
শনিবার সকাল ৯টায় অভয়নগর উপজেলার সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস কবলিত এলাকা মালোপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। সেখানে পৌঁছে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন, আক্রান্ত মানুষদের সঙ্গে মতবিনিময়, সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস  রোধে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্থানীয় জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধকরণ এবং দুর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ  করে বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফ।
মালোপাড়ায় জনাকীর্ণ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার এবং বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফের সভাপতি শাহ্‌ সূফী ড. এমদাদুল হক। সমাবেশে ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন, জামাত-শিবিরের রাজনীতি বহাল রেখে অসামপ্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না। এখন জামাত শিবির নিষিদ্ধ করে প্রতিশ্রুতি পূরণের সময় হয়েছে।
বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফকে কাছে পেয়ে ধর্মীয় সন্ত্রাসে বিপন্ন যশোরের মালোপাড়া রূপ নেয় হিন্দু-মুসলমানের মিলনমেলায়। মালোপাড়ার সমাবেশে বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফের সভাপতি শাহ্‌ সূফী ড. এমদাদুল হক বলেন, ইসলাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে, নিশ্চয়ই অমুসলমানদের রক্ত আমাদের রক্তের মত। তাদের মাল আমাদের মালের মত এবং তাদের ইজ্জত-আবরু আমাদের ইজ্জত-আবরুর মত। বাংলাদেশে অমুসলিমদের ইজ্জত, জান-মাল মুসলিমদের কাছে আমানতস্বরূপ। তাদের সেই আমানত আমরা রক্ষা করতে পারিনি। তিনি বলেন, অবস্থার প্রেক্ষিতে মনে  হয় বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে সংখ্যালঘু সমপ্রদায় হচ্ছে মুসলমান! কোন মুসলমান অমুসলমানের ইজ্জত ও জান-মালের ক্ষতি করতে পারে না। ক্ষতিগ্রস্ত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, যারা আপনাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়েছে, আপনাদের সম্পদ লুন্ঠন করেছে তারা মুসলমান না। নীল নদের পানি যেমন নীল নয় তেমনি জামাতে ইসলাম, ইসলাম নয়। জ্যৈষ্ঠমধুতে যেমন মধু নাই তেমনি জামাতে ইসলামে ইসলাম নাই। কোন ধর্মই সন্ত্রাসের অনুমোদন দেয় না। সুতরাং সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম নাই। গণজাগরণ মঞ্চের সাথে জামাতমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন - অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের যুগপৎ আন্দোলন চলবে।
সমাবেশ শেষে হাক্কানী খানকা শরীফের নির্বাহী সদস্যবৃন্দ ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কথা বলেন এবং প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখেন। হাক্কানী খানকা শরীফকে কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন মালোপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুরা, অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফ বিপন্ন মানুষের সহায়তায় সবসময় পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপর বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। অবশিষ্ট ত্রাণসামগ্রী মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে হস্তান্তর করা হয় যা ঐদিনই সন্ধ্যার পূর্বে বিতরণের প্রতিশ্রুতি দেন মন্দির ব্যবসস্থাপনা কমিটি।
ঢাকা ফেরার পথে শনিবার সন্ধ্যায় যশোর চিত্রামোড়ে জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। চিত্রা মোড়ে গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশে মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার রোডমার্চের ৩ দফা দাবি তুলে ধরে বলেন, সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস বন্ধে কঠোর আইন করতে হবে, সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে এবং একইসঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রত্যেক পাড়া মহল্লায় সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠনের তাগিদ দেন ইমরান এইচ সরকার। একইসঙ্গে তিনি অভয় নগরের মালোপাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি পরিবার প্রতি ২০ হাজার ও বাকী ১০০ পরিবার প্রতি ১০ হাজার টাকা করে দেয়ার  ঘোষণা দেন। এছাড়াও মণিরামপুরের ধর্ষণের ঘটনার নিন্দা জানান তিনি। গত শনিবার সন্ধ্যার পর যাত্রা করে রোববার ভোর ২টায় শাহবাগে এসে সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধে রোডমার্চ মুলতবি হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন