মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৪

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে



ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

বিমা ॥ নির্বাচনের পরপরই দিনাজপুর, যশোর, সাতক্ষীরা ও ঠাকুরগাঁওয়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলা শুরু করে জামাত-শিবির ক্যাডাররা। গত রবিবার রাত থেকে এসব জেলায় হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। অনেকে প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মন্দিরে। কেউ কেউ পালিয়ে রয়েছেন অন্য গ্রামে। প্রশাসনের লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গিয়ে হিন্দু লোকজনদের নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে যেতে বললেও তারা বাড়ি ফিরতে চাচ্ছেন না। এদিকে, নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও দোকান পাটেও হামলা করছে দুর্বৃত্তরা।
শুধু এবারই নয়, অতীতেও নির্বাচন এলেই আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। তবে এবার তাদের ওপর হামলা, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ইত্যাদির ব্যাপকতা অত্যন্ত বেশি। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা জঙ্গিদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো ভরসা পাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে সার্বক্ষণিকভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে জঙ্গিরা নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী সৃষ্টি করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের চলাফেরা ও কর্মকা-ের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রেখে যাচ্ছে। তাতে শান্তিকামী সাধঅরণ মানুষের ভীতসন্ত্রস্ততা মোটেও কাটছে না। তাই তারা গ্রাম ছেড়ে কিছুটা নিরাপদ শহরে গিয়ে বসবাস শুরু করছে। অত্যাচারিত হয়ে হয়ে সবারই মন ভেঙে গেছে। ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে সবাই চরম উদ্বিগ্ন এবং তারা যে কোনো সময় যেখানেই নিরাপদ বলে মনে করবেন ও সুযোগ পাবেন সেখানেই চলে যাবেন বলে মনস্থির করেছেন। তাদের সবার বিনিদ্র রজনী কাটে, ঘরে-বাইরে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।
এই ভূ-অঞ্চলে সভ্যতা বিকাশের গোড়াপত্তনকারী এবং হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসকারী উন্নত বিশাল এক জনগোষ্ঠী দিনদিন বিপন্ন থেকে বিপন্নতর হচ্ছে। মূলত বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভাজনকে কেন্দ্র করে তাদের এই বিপন্নতার সূত্রপাত ঘটে। ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন রাজনীতিবিদদের ধর্মীয়, আঞ্চলিক, সমপ্রদায় ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, কূটচাল ও ক্ষমতালিপ্সার মদমত্ততায় ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্তের বলি বর্তমান বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু এই জনগোষ্ঠী- যাদের মধ্যে প্রায় ৯৯% হিন্দু ধর্মাবলম্বী, বাকিরা বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।  দুঃখজনক হলেও সত্য, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের নেৃতত্বে সরকার পরিচালিত হলেও সংখ্যালঘুরা হামলা থেকে রেহাই পাননি। দেশের সকল প্রান্তে রয়ে-রয়ে হামলা পরিচালিত হতে থাকে। তবে গেলো বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি অন্যতম যুদ্ধাপরাধী কুখ্যাত দেইল্যা রাজাকারের ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার পর সংখ্যালঘুদের ওপর দেশব্যাপী একযোগে সবচেয়ে বড় হামলা পরিচালিত হয়। সেই থেকে অদ্যাবধি প্রতিনিয়ত দেশের কোনো না কোনো স্থানে তাদের ওপর হামলা চলে আসছে।
বিগত ২৫ নভেম্বর দশম নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জঙ্গি বাহিনী কর্তৃক সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে জামাত-শিবির দেশের সর্বত্র সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা পরিচালনা করতে থাকে। বিগত ১২ ডিসেম্বর অন্যতম যুদ্ধাপরাধী মিরপুরের কসাই নামে পরিচিত কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হলে জঙ্গিদের হামলার মাত্রা তীব্রতর হয়। ১৬ ডিসেম্বর থেকে দেশের বিভিন্নস্থানে যৌথবাহিনীর অভিযান সত্ত্বেও এসব হামলা অব্যাহত থাকে।
প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা পড়ে-পড়ে মার খাচ্ছেন, তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত ও বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই জনগোষ্ঠীকে দেশের সৃষ্ট প্রতিটি সংঘাতময় ঘটনায় মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। তাদের সংখ্যা কম করে হলেও দেড় কোটি। অথচ বিশাল এই জনগোষ্ঠীর বিপন্নতা নিয়ে দেশ-বিদেশের সংশ্লিষ্ট কোনো মহল থেকে কোনো প্রকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে, বা তেমন কোনো আলাপ-আলোচনা করছে বা ভূমিকা রাখছে বলে দৃশ্যমান নয়। এসব মহল যা নিয়ে ব্যস্ত তা হচ্ছে- নির্বাচন আর নির্বাচন। নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপার নিয়ে সবাইকে উচ্চকিত হতে দেখা গেলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তাদের মুখ থেকে টুঁ শব্দটি পর্যন্তে শোনা যায় না।
বর্তমান সরকারকে দেশের দেড় কোটিরও অধিক ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।  বাংলাদেশের দেড় কোটি সংখ্যালঘু মানুষ আর যেন কোনো প্রকার হামলা, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার না হন তা নিশ্চিত করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন