মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৩

নারী দুর্বল নয় -নারীকেই প্রমাণ করতে হবে




নারী দুর্বল নয় -
নারীকেই প্রমাণ করতে হবে

সংলাপ ॥ বাংলাদেশের একজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী পুরো দেশের সমস্ত মানুষের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করলেও সাধারণ নারীর অধিকার আদায়ে তা যথেষ্ট ছিল না। একজন নারীকে শুধু উঁচু পদে বসালেই হবে না, অনেকগুলো নারীকে রাষ্ট্রের বড় বড় পদগুলিতে অধিষ্ঠিত করলেই হবে না' পুরো বিষয়টির সমাধান অন্য জায়গায়। বাংলাদেশের সাধারণ নারীরা জন্মলগ্ন থেকেই মার খাচ্ছে প্রতি পদে পদে। নারী অসহায় তার পারিবারিক জীবনে, তার সামাজিক জীবনে এবং সর্বোপরি তার রাষ্ট্রীয় জীবনে। পরিবারে নারীর অবস্থা বিশ্লেষণ করতে হবে সবার আগে। সাধারণভাবে দেখলে কিন্তু ভিন্ন চিত্র মিলবে। কেননা একটি পরিবারে মায়ের ভূমিকা কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে বিদ্যমান। শিক্ষিত সমাজের একটি পরিবারে গৃহকর্ত্রীর অবস্থান খুব দৃঢ়, অনেক সময় গৃহকর্তার থেকেও শক্তিশালী তার অবস্থান। বাংলাদেশের অনেক পরিবারেই দেখবেন গৃহকর্তার শ্যালক-শ্যালিকাদের আধিপত্য বেশি; সেখানে গৃহকর্তার ভাই-বোনের আধিপত্য অনেক ক্ষেত্রেই কম বা একেবারেই  নেই। এই অবস্থাটা সেই পরিবারেই হয় যেখানে গৃহকর্ত্রীর অবস্থান শক্ত। অপরদিকে পরিবারের সিদ্ধান্তের  ক্ষেত্রেও গৃহকর্ত্রীর ভূমিকা বিশেষ করে সন্তানদের ক্ষেত্রে গৃহকর্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনেক পরিবারেই প্রাধান্য লাভ করে। কিন্তু তারপরও বাস্তব বাংলাদেশ বলছে নারী এখানে অসহায়। এখানে গরীব নারীদের নিরাপত্তা নেই।
সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা নারীদের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। গরিব কাজের মহিলা ধুঁকে ধুঁকে মার খাচ্ছে। অতি অলতেই এবং সামান্য কারণেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই বলৎকারের মতো?পৈশাচিক আচরণের শিকার হচ্ছে। যদি সঠিক পরিসংখ্যান করা দেখা যায় তবে দেখা যাবে, বলৎকার বাদ দিয়ে অন্যান্য সামাজিক অত্যাচারের শিকার হয় যেসব গরীব গৃহ কাজে নিয়োজিত নারী তাদের অধিকাংশের জন্যেই দায়ী সেই পরিবারের গৃহকর্ত্রী। গৃহকর্ত্রীদের হাতেই শারীরিকভাবে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে গরীব, অসহায়, সামান্য বেতনে কর্মজীবী এই সকল গৃহভৃত্য নারী। সামাজিক অন্ধ বিধানের সুযোগে একটি পরিবারের মা'ই অন্যায় অবিচার করছে তার কন্যা সন্তানের উপর। কন্যা সন্তানকে বাইরে যেতে অথবা শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হিসেবে দাঁড় হচ্ছে তার মা'ই। বলৎকারের শিকার কন্যা সন্তানকে বুকে নিয়ে মা সারাক্ষণ কাঁদলেও সমাজে বদনাম হবে এই অজুহাতে মা সেই বলৎকারের সংবাদ বাইরে প্রকাশ করছে না। এমন নানা অঙ্গনে আমাদের দেশের নারীরাই অন্য নারীদের পিছিয়ে রাখতে সাহায্য করছে। ধর্মীয় গোঁড়ামির সুযোগে নারীদের সুযোগ-সুবিধা বর্জিত পরিবেশ সৃষ্টিতে অন্য নারীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিষয়টি একান্তই নারী সমাজের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়। তাই তাকেই এগিয়ে আসতে হবে এর উন্নয়নে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হবে নারী শিক্ষা। নারী এবং পুরুষ উভয়কে আলাদাভাবে না দেখে বরং একসাথে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। এখানে পুরুষ শাসিত সমাজের দোষ দিয়ে লাভ হবে না। এখানে পুরুষকে নারীর অনগ্রসরতার জন্যে দায়ী করলে ভুল হবে।
একটি জাতি অন্য জাতিকে যেমন দাবিয়ে রাখতে পারে না তেমনি নারীর জাগরণ ঘটলে পুরুষ তা ঠেকাতে পারবে না। নারীকে ঘরের চার দেয়ালে আটকে রাখবেন, ধর্মের দোহাই দিয়ে তাকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করবেন, আবার নারীর পশ্চাৎপদের জন্যে পুরুষকে দায়ী করবেন তা হতে পারে না। নারীকে স্বীকার করতে হবে তার পশ্চাৎপদ ভূমিকার জন্যে সেই দায়ী। প্রতিযোগিতা করে তাকে পুরুষের কাছাকাছি আসতে হবে। চাকরির প্রতিযোগিতা করেই তাকে ভাল চাকরি পেতে হবে। নারীর বিশেষ কোটায় নয় বরং তাকে প্রতিযোগিতা করে রাজনীতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সমস্ত কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে নারীকে আলাদা করে দেখলেই নারীর উন্নয়নে বাঁধা দেয়ার শামিল হবে। বিশেষ  কোটায় নয়, নারীকে মূল ধারায় সকলের সাথে সমান প্রতিযোগিতা করেই এগোতে হবে। নারীর জন্যে সংসদে আলাদা আসন বিলুপ্ত হয়ে যেদিন নারী সাধারণ প্রতিযোগিতায় তার যোগ্যতা দিয়েই সংসদে সাংসদ হিসেবে আসতে পারবে সেদিনই নারী তাদের মুক্তির জন্যে সঠিক আইন করার প্রয়াসে মনোনিবেশ করতে পারবে। নারী দুর্বল নয় এটা প্রমাণের দায় নারীর উপরই বর্তায়।
ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ উন্নত দেশের নারীরা এখন দৃঢ় অবস্থানে দাঁড় হয়েছে। তাদের দেশে নারীকে আর আলাদা করে দেখার উপায় নেই। নারীও মানুষ এটা এখন আর কারও বুঝার অপেক্ষা রাখে না সেখানে। এই অবস্থানের জন্যে সেই দেশগুলোর নারী সমাজই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। নারীর প্রতি অবহেলা ও অসম্মান করার কোনো সুযোগ বা আইন সেই দেশগুলোতে বিদ্যমান নেই। বরং আইনের কড়াকড়ি এমন অবস্থায় রূপ নিয়েছে যে সেখানকার আইনকে অনেকেই নারী সমর্থিত আইন বলে প্রচার করে। বলৎকার করা দূরে থাকুক সামান্য অসম্মানজনক আচরণ যদি কোনো পুরুষ কোনো নারীর প্রতি করে তাহলে সেই পুরুষকে সেখানে কঠিন আইনের সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে নারী স্বাধীনতার রূপটি পুরোপুরিভাবে গ্রহণযোগ্য না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের আইন নারীদের পক্ষে যাওয়ার ফলে সেই দেশের নারীরা অনেকাংশেই স্বাধীনতা ভোগ করছে। ভারতের নারীরা ঘরের বাইরে আসার মতো একটি সুস্থ পরিবেশ আদায় করে নিতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এতো কাছের হয়েও সম্পূর্ণভাবে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। এখানে পুরুষ বলৎকার করে সমাজে মুখ উঁচু করে হাঁটছে আর বলাৎকারের শিকার নারী মুখ লুকিয়ে থাকছে। বলাৎকারকারীর বিচার হচ্ছে না আর হলেও কঠিন  শাস্তির বিধান না থাকাতে বলাৎকারকারী পুরুষ বারবার এই জঘণ্য অন্যায় করার সাহস পাচ্ছে। বলাৎকারকারী পুরুষ কোনোভাবেই পুরুষ হতে পারে না - পুরুষ সাজে একটি দানব। আমাদের এই লজ্জা, আমাদের এই গ্লানি কোথায় লুকানো যায় আমি তা জানি না। কিন্তু আমি সমস্ত নারীকে আহবান করতে চাই অগ্রসর হতে। বাংলাদেশের অসহায় নারী সমাজকে জাগরণের বাণী শুনাতে চাই। আপনাদের জাগরণ ব্যতীত আপনাদের মুক্তি নেই। আপনাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা ছাড়া আপনারা আপনাদের অধিকার বুঝে নিতে সমর্থ হবেন না। তাই সকল নারীই শিক্ষা গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করুন। তারপর যেসব আইন ও সামাজিক প্রথা তা বুঝার যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে সকল নারীকেই। সেজন্যে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার দিকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নারীকেই বুঝতে হবে কোন ক্ষেত্রে কিভাবে তাদের ছোট করে দেখানো হচ্ছে। অন্ধ ধর্মের অজুহাতে অথবা প্রচলিত হয়ে আসছে বলে সকল অন্যায় গ্রহণ করার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে নারীকেই সর্বাগ্রে।
বাংলাদেশের নারীদের জাগতেই হবে এবং তাহলেই বাংলাদেশ একদিন জাগবে। বাংলাদেশ একদিন উন্নত  দেশ হিসেবে অন্যান্য উন্নত দেশের পাশাপাশি হাঁটবে। বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী সমাজকে পশ্চাতে ফেলে রেখে কিছুতেই উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয়। তাই নারী জাগরণ শুধু নারীর জন্যেই নয় -  নারী জাগরণ দেশের জাগরণের সাথে জড়িত বিষয়। সময় বহমান নারীর শিক্ষার প্রসার ও মান উন্নত করার। নারীকে সকল কর্মস্থলে সম্মানের সাথে দেখার। নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী দেখতে নারীর জাগরণ আনন্দের সাথে মেনে নিতেই হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন