মঙ্গলবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৩

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাই ধর্মদ্রোহীতা

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাই ধর্মদ্রোহীতা

সংলাপ ॥ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পৃথিবীতে যখনই কোনো সম্প্রদায় ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে তখনই তাদের পতন হয়েছে। ধর্মের ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন করে অনেক জাতি-গোষ্ঠী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ধর্মের নামে অনাচার, ধর্মকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার, ধর্মের মর্মবাণীর বিকৃতি, ধর্মের বিধানকে এড়িয়ে চলা, ধর্মের নামে অন্ধত্ব, ধর্মের সহজ-সরল সাবলীল রূপকে রুক্ষ-শুষ্কভাবে উপস্থাপন, ধর্ম পালনের আড়ালে ধর্মব্যবসা ও ধর্মের আশ্রয়ে অমানবিকতা ও অধর্ম চর্চার মাধ্যমে বিশ্বসমাজ থেকে বহু ধর্মের বিলুপ্তি ঘটেছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি হলে ধর্ম তার শাশ্বত ও চিরন্তন অবস্থানকে হারিয়ে ফেলে এবং মানব সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা ও উপযোগিতা হ্রাস পায়। ধর্ম নিয়ে ইতিহাসের এই শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হচ্ছে যা কোনো ধর্মপ্রাণ মানুষের কাজ হতে পারে না।
ধর্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুগে যুগে ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি হয়েছে। হজরত মুসা (আ.)-এর সময়ে তাঁর অনুসারীদের মধ্য থেকে একটি অংশ চরম ধর্মীয় বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়েছিল। কুরআনে তাদের কার্যক্রম ও পরিণতির বর্ণনা রয়েছে। একইভাবে হজরত ঈসা (আ.)-এর সময়ও ধর্মীয় বাড়াবাড়ি ছিল। তাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল সমসাময়িক আদালত। মুহাম্মদ (সা.)-এঁর সময়েও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়েছে। এসব বাড়াবাড়িকে উপেক্ষা করে মহানবী (সা.) আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে পরিষ্কারভাবে  জানিয়ে দিয়েছেন - ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন অর্থাৎ তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য আর আমাদের ধর্ম আমাদের জন্য। রাসুল (সা.) অবিশ্বাসীদের সঙ্গে কোনো প্রকার বাদানুবাদে লিপ্ত হননি; তিনি কৌশলে ধর্মীয় উস্কানি ও সংঘাতকে এড়িয়ে গেছেন। ধর্মের ব্যাপারে অন্যরা বাড়াবাড়ি করলেও মহানবী (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। আর সে জন্যই আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ করেছেন - ‘লা ইক্রাহা ফিদ্দিন অর্থাৎ ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। ধর্ম তার উদার, নৈতিক ও চিরন্তন বিধিবিধান নিয়ে সত্য-ন্যায় ও ইনসাফের যাত্রায় এক চলমান শান্তিময় প্রত্যয়; পরম করুণাময়ের কৃপাধন্য অভিযাত্রীরাই তাতে পথ চলে সমস্যাসংকুল জীবনের কণ্টকাকীর্ণ যাত্রায় উত্তীর্ণ হয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে নিজেকে প্রশান্ত করেন। আল্লাহপাক বলেন, ‘ফাদ্‌খুলি ফি ইবাদি ওয়াদ্‌খুলি জান্নাতি অর্থাৎ আমার অনুগত বান্দাদের দলে প্রবিষ্ট হও আর আমার শান্তিরজগতে প্রবেশ কর। সুতরাং প্রত্যেকেই তার নিজস্ব প্রয়োজনে ধর্মের প্রতি আনুগত্যশীল হবে অথবা হবে না কিন্তু কাউকে ধর্ম পালনের জন্য জোরজবরদস্তি করা কোনোমতেই কুরআন সমর্থন করে না।
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কুফল সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অবগত ছিলেন আমাদের প্রিয় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। আর তাই তিনি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন - ‘সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। এ বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্বে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।
ধর্ম মানুষকে পুণ্যবান ও ধার্মিক করে, উদারতা ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। ধর্মের মূল বাণীসমূহ পবিত্র, উন্নত ও মানবিক জীবন-যাপনে মানুষকে সহায়তা করে। সমাজ-সভ্যতা ও পরিবেশ থেকে যাবতীয় অন্ধকার, কুসংস্কার ও অজ্ঞতা দূরীভূত করে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত করে ধর্ম। সব ধর্মই এসেছে এমন এক মহান সত্তার পক্ষ থেকে, যিনি পৃথিবী ও এর মধ্যকার সব কিছুরই স্রষ্টা। সৃষ্টি কিসের মাধ্যমে ভালো থাকবে, কিভাবে সমৃদ্ধ হবে, কোন পন্থায় জীবনযাপন করলে শান্তি আসবে, মুক্তি মিলবে, সে সম্পর্কে তিনি সম্যক অবহিত। তাই তো পৃথিবীতে ধর্মের আগমন; ধর্মের মাধ্যমেই ভালো-মন্দের, পাপ-পুণ্যের বিচার-বিবেচনা নিহিত রয়েছে। মানুষ ও মানবতার প্রকৃত শান্তি ও সার্বিক মুক্তি ধর্মের মাধ্যমেই অর্জিত হয়।
পবিত্র ধর্ম ইসলামের নির্দেশ হলো - ‘উদ্‌উ ইলা সাবিলি রাব্বিকা বিল হিকমাতি ওয়াল মাউইযাতিল হাসানা অর্থাৎ ‘তোমরা মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্‌বান কর হেকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে এবং উত্তম উপদেশ সহকারে। এ নির্দেশে দুটি বিষয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমটি হলো, মানুষকে ইসলামের পথে আহ্‌বান করতে হলে প্রয়োজন হেকমতের। হেকমত অর্থ - জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কৌশল। সুতরাং ইসলামের কথা বলতে হলে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কৌশল প্রয়োজন। আর দ্বিতীয়টি হলো উত্তম উপদেশ। ইসলামকে যারা ধারণ করবেন তাদের মধ্যে মানুষকে উত্তম উপদেশ বা সৎ পরামর্শ দানের যোগ্যতা থাকতে হবে। যাদের মধ্যে প্রজ্ঞার অভাব থাকবে আর যারা উত্তম উপদেশ দানের অযোগ্য তারা যখন ইসলাম হেফাজতের দায়িত্ব নিবেন তখন সেটি ইসলামের হেফাজত না হয়ে তা ধর্মের নামে বাড়াবাড়ির রূপ পরিগ্রহ করবে। তাতে ধর্মের কোনো কল্যাণ হবে না, বরং মানুষ বিভ্রান্ত হবে এবং সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মভীরু। ধর্মীয় আবেগ এ অঞ্চলের জনমানুষকে আপ্লুত করে। এ দেশের সব ধর্মাবলম্বী মানুষ আবহমান কাল থেকে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছেন। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান - এ দেশের প্রধান চারটি ধর্ম। জনসংখ্যার অনুপাতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা নব্বই ভাগ। ইসলামের উদার নীতি ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শের কারণেই হাজার বছর ধরে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এখানে সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিদ্যমান। যেহেতু এদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেহেতু অন্য ধর্মাবলম্বীরা যেন কোনো অবস্থাতেই তাদের ন্যায্য, ন্যায়সঙ্গত, ধর্মীয় ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সে বিষয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকেই নিশ্চিত করতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন বা নির্যাতনের কোনো নজির তো নেই-ই বরং তাদের সব মৌলিক ও মানবিক অধিকার প্রাপ্তির বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে স্বীকৃত রয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক মহানবী (সা.) বলেছেন- ‘কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকায় যদি সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর কোনো ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন হয় তাহলে কেয়ামতের ময়দানে আমি সেই এলাকার অমুসলিম সংখ্যালঘুদের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে মামলা দায়ের করব। রাসূল (সা.)-এর এমন কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণের পরও যদি কোন মুসলমান ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তাহলে সে আর যাই হোক, মুসলমান থাকে না। সে হয়ে যায় অবাধ্য তথা সীমালঙ্ঘনকারী আর তার পরিণতিতে সে হয় আল্লাহ-রাসূলের ক্রোধের পাত্র; যা থেকে কেউ তাকে হেফাজত করতে পারবে না।
বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনঅধ্যুষিত দেশ। হজরত শাহজালাল ইয়ামেনি, হজরত শাহ সুলতান রুমি, হজরত শাহ পরাণ, হজরত খানজাহান আলী, হজরত শাহ মাখদুমসহ অসংখ্য অলি-আউলিয়া, সুফি-সাধক ও গাউস-কুতুবের পদভারে আজ পর্যন্ত ধন্য এই দেশ। সুফি-সাধকদের নির্মোহ চরিত্র, নির্লোভ চিত্ত আর তপস্যাময় জীবনের স্পর্শে এ দেশের জনমানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় ইসলাম এক মানবতাবাদী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের প্রচার-প্রসারে সাধকদের অবর্ণনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্ট-যাতনা ও দুর্ভোগের কাহিনী আমাদের জাতীয় ও ধর্মীয় ইতিহাসের এক অনবদ্য দলিল হয়ে আছে। এ মহান ধর্মের মৌলিকত্ব ও পবিত্রতা রক্ষা করা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। আমাদের আচরণে-ব্যবহারে, বক্তৃতা-বিবৃতিতে, কার্য সম্পাদনে বা কর্মসূচি প্রণয়নে এ ধর্ম যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, বিতর্কিত বা অবমাননার শিকার না হয়। ধর্ম পালন হৃদয়ের ব্যাপার, বিশ্বাস ও ভক্তির বিষয়; এতে যেন জোর-জবরদস্তি না থাকে এটাই কাম্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন