শনিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৫

বাংলা দিনপঞ্জি আজোও সুপ্রতিষ্ঠিত হলো না!

বাংলা দিনপঞ্জি আজোও সুপ্রতিষ্ঠিত হলো না!

সংলাপ ॥ বাংলা দিনপঞ্জি নিজ দেশেই পরবাসী। এর কোন ব্যবহার প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই পরিত্যাজ্য। পত্র-পত্রিকাগুলোতে হিজরী ও খৃষ্টীয় সন-তারিখের পাশাপাশি বাংলা মাস ও তারিখের নাম লেখা না থাকলে শহরের মানুষ হয়তো ভুলেও এর অস্তিত্ব স্মরণ করতে পারতো না। অথচ ইংরেজ আমলে তাদের শাসন-শোষণের মধ্যে থেকেও বাঙালি তাদের স্বকীয় অস্তিত্ব বিস্মৃত হয়নি। ইংরেজি সনের নামে প্রচলিত খৃষ্টীয় সন বা রোমান বর্ষপঞ্জি বাঙালি সমাজ গ্রহণ করেনি। অথচ তখনও মঘী, হিজরী, শকাব্দ এবং খৃষ্টীয় সনের প্রচলন ছিল।
শকাব্দ প্রচলন কে করেন সে সম্পর্কে কোন স্থির সিদ্ধান্ত নেই। অনেকের মতে শকরাজা শালিবাহনের মৃত্যুর পর থেকে শকাব্দের সূচনা হয়।
সন গণনার মধ্যে ধর্মীয় ভাবাবেগ, গোঁড়ামি, কুসংস্কার অথবা সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন থাকতে পারে না। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষ তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই দিন, ক্ষণ, মাস ঘটনার প্রচলন ঘটায়। বর্ষ গণনার তথ্যপুঞ্জির নির্দিষ্ট তারিখ বলা দুরূহ হলে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় যে, প্রাচীন রোম, মিশরীয় সভ্যতা, সুমেরু সভ্যতা এবং ব্যাবিলয়ন সভ্যতাই প্রথম এর উদ্ভব এবং ব্যবহার শুরু করে। সেই শুরু চিন্তা ও গবেষণার বিভিন্ন ধাপ ও পর্যায় অতিক্রম করে আজকের আধুনিক পঞ্জিকা এবং ক্যালেন্ডারের উজ্জ্বল অস্তিত্ব।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, প্রাচীনকাল থেকেই এই গণনা দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে। একটি সূর্য, অপরটি চন্দ্র। সৌরবর্ষ এবং চন্দ্রবর্ষ। সৌর গণনাই আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত। প্রকৃতির সাথেও এর অপূর্ব মিল রয়েছে। সৌর গণনার এই হিসাবটি প্রথম চালু করে মিশরীয়রা। পরবর্তীতে রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার মিশরীয় পঞ্জিকার সংস্কার সাধন করে রোমে চালু করেন। তিনি সবগুলো মাসেরদৈর্ঘ্য পরিবর্তন করেন এবং প্রতি চার বছর অন্তর একদিন যুক্ত করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন অর্থাৎ লিপ-ইয়ার চালু করেন। তার নাম অনুসারে একটি মাসের নামকরণ হয় জুলাই। জুলিয়াস সিজার কর্তৃক প্রবর্তিত পঞ্জিকার নামকরণ হয় জুলিয়াস পঞ্জিকা। মিশরীয়রা ৩৬৫ দিনে বছর ধরতো আর জুলিয়াস পঞ্জিকার বছর ছিল সাড়ে ৩৬৫ দিনে।
আজকের প্রচলিত ইংরেজি সন আসলে খৃষ্টীয় সনও নয় এবং ইংরেজি সনও নয়। এটা ইংরেজ জাতির প্রবর্তিত অথবা তাদের স্বকীয়তার প্রতীক নয় কিছুতেই। অপরদিকে নবী হযরত ঈসা (আঃ)-এঁর জন্মের বহু পূর্ব থেকে সন গণনা শুরু হয় এবং তিনি কোনো সনের প্রবর্তকও নন। এমনকি তিনি খৃষ্টান সমপ্রদায়েরও জনক নন যে, তাঁকে খৃষ্টানদের নবী বলা হবে। যারা এ ধরনের প্রচারণায় অংশ নেয়, তারা নিঃসন্দেহে ভ্রান্তির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে অথবা প্রতারণায় নিমজ্জিত হয়ে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের আশ্রয় নিচ্ছে।
মানবতার মুক্তিদূত মহামানব হযরত ঈসা (আঃ)-এঁর মৃত্যুর ৫৩২ বছর পর ডাইওনিসিয়াম এক্সিওয়াম নামক এক পাদ্রী ঈসা নবীর জন্ম বছরের হিসেবে বর্ষ গণনা পদ্ধতি সংস্কার করেন। তখন থেকেই এটা খৃষ্টীয় সন নামে সামপ্রদায়িক পরিচিতি লাভ করে যেমন পরিচিত খৃষ্টান সমপ্রদায়। অনুরূপভাবে রহমাতাল্লিল আল্‌-আমীন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)ও কোন সনের প্রবর্তক নন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবনের ‘হিজরত’ নামক অধ্যায়টিকে সুযোগ-সন্ধানী স্বার্থান্বেষী সাহাবারা লজ্জাকর ও কলঙ্কজনকভাবে স্মরণীয় করে রাখতে অভিশপ্ত কুরায়েশদের মদদে হযরত ওমরের মাধ্যমে এবং তার পরামর্শক্রমে চন্দ্র গণনার সংস্কার করে হিজরী সনের উদ্ভব ঘটায়। এটাই এখন সামপ্রদায়িক মুসলমানী সন হিসেবে হিজরী সনের পরিচিতি নিয়ে মুসলমান সমপ্রদায়কে চাঁদের ফাঁদে আটকিয়ে রেখেছে।
৬টি ঘটনাকে স্মরণ করে ৬টি প্রস্তাব এসেছিলো মুসলমানদের নিজস্ব একটি সাল এবং বর্ষপঞ্জিকা তৈরি করতে -
১। মুহাম্মদ (সঃ)-এর ওফাত দিবস
২। মুহাম্মদ (সঃ)-এর জন্ম দিবস
৩। নব্যুয়ত প্রকাশ বা ‘এলানে নবুওত’ এর দিন
৪। বদর যুদ্ধের বিজয় দিবস
৫। মক্কা বিজয় দিবস এবং
৬। হিজরত।
হিজরতের দিনটি কুরায়েশদের কাছে বিজয়ের প্রতীক হিসেবে সদা হাস্যোজ্জ্বল আনন্দঘন একটি ঘটনা!
উপরের ৫টি প্রস্তাব একে একে নাকচ করে ৬ নম্বর প্রস্তাবটি গ্রহণ করে হযরত ওমর (রাঃ) হিজরত দিবস স্মরণে রাখার জন্য হিজরী সনের প্রবর্তন করেন।
অথচ সময়ের নিখুঁত ও সুঠাম ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টার অন্ত নেই। ১৫৮২ খৃষ্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী জ্যোতির্বিদদের পরামর্শ এবং এক্সিওয়ামের সংস্কার সমান্তরালে দাঁড় করিয়ে বর্ষপঞ্জির সংস্কার করেন। তারা ১৫৮২ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাস থেকে দশ দিন বাদ দেয়ার নির্দেশ দেন। ফলে ঐ বছর অক্টোবরের ৫ তারিখকে ১৫ তারিখ ধরা হয়। রোমের পোপ গ্রেগরী ঘোষণা দেন যে সব শতবর্ষীয় সন ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য হবে সে সব শতবর্ষই লিপইয়ার বলে গণ্য হবে। গ্রেগরীয়ান সংস্কারকৃত বর্ষপঞ্জিই অদ্যাবধি সারা পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচলিত। বিভিন্ন দেশ এই পঞ্জিকাকে কেন্দ্র করেই দিন, ক্ষণ, মাস, ঋতু গণনা করে থাকে তাদের দেশের আবহাওয়া-জলবায়ু অনুসারে। এই সৌর পঞ্জিকাটি অত্যন্ত সহজসাধ্য, মোটামুটি নির্ভুল এবং প্রকৃতির সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বঙ্গাব্দ গণনা করা হয় সৌরবর্ষ অনুসারে। সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দে ১০ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন।
ন্যায় বিচারের প্রবক্তা মানবতাবাদী সম্রাট আকবর মানবতার কল্যাণের জন্য এ উপমহাদেশে সার্বজনীন ধর্ম দ্বীন-ই-ইলাহী প্রবর্তনকালে ইলাহী সনও চালু করেছিলেন। নতুন ধান ওঠার সময়কাল অগ্রহায়ণ মাস থেকেই এ সনের গণনারীতি চালু ছিল। গ্রাম বাংলার প্রতিটি মানুষই জাতি-ধর্ম এবং ধনী-গরীব নির্বিশেষে নবান্নের উৎসব পালন করতো ঘরে ঘরে। এই সার্বজনীন সংস্কৃতি কিছুদিন আগ পর্যন্তও চালু ছিল বাংলার আনাচে-কানাচে নতুন ধান কাটার লগ্নে, যা আজ বিস্মৃত প্রায়।
ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও ফতোয়াবাজির কালো ছায়ায় দ্বীন-ই-ইলাহী’র আলোক ছটা ঝাপসা হয়ে গেলেও আকবরের প্রবর্তিত সৌর গণনার রীতি মেনে খাজনা তোলা ও হিসাব-নিকাশ ঠিক ঠিক রাখতে বাংলা সন কিন্তু বাঙালি জাতির স্বাতন্ত্র অস্তিত্বের প্রতীক ছিল এবং এখনো আছে যদিও তা আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে আরো অনেক কিছুর মতই। হিন্দু সমপ্রদায় তাদের ধর্মীয় পর্বগুলো বাংলা সনের নিরিখে পালন করে থাকে। মুসলমান সমপ্রদায়ের সূফী মতবাদের বিশ্বাসীরাও তাদের ধর্মানুষ্ঠান বাংলা সন অনুসারে করে থাকে। সামপ্রদায়িক উগ্র ধর্মান্ধরা একে হিন্দু কালচার বলে উপেক্ষা করেছে এতদিন। কিন্তু প্রগতিশীল দাবিদার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ যখন নববর্ষের সকালে পান্তা আর ইলিশ ভোজনের প্রতিযোগিতা সেরে বিচিত্র সব মুখোশ পরে মিছিলের সমারোহ করেন এবং বিকালে রমনা বটমূলে ছায়ানটের গীতি অনুষ্ঠান ভোগ-উপভোগের মাধ্যমে নববর্ষের চেতনা বিকাশের মহড়া পর্বের সমাপ্তি টানার রেওয়াজ চালু করেছেন তখন এই ধর্মান্ধ কূপমন্ডুকরাও নববর্ষের ইতিহাস চর্চা শুরু করে দেয় এবং একে মুসলমানদের ঐতিহ্য বলে জাহির করতে কসুর করে না মোটেই। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের কোথাও এর সামান্যতম প্রভাব চোখে পড়ে না। সামপ্রদায়িক বাগাড়ম্বর এবং ছায়ার সাথে কায়ার যুদ্ধ শেষ হলেই সবকিছু আগের মতই। কোনো পরিবর্তন নেই।

এভাবে সমাজ ও জাতির মগজ পচনের প্রতিকার কি? কে দেবে এর সমাধান? সবই কি এভাবে অনুষ্ঠান সর্বস্বতায় পর্যবসিত হতে থাকবে? 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন