শনিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৫

বৈশাখী মেলায় বেহিসেবি আয়োজন


বৈশাখী মেলায় বেহিসেবি আয়োজন

সংলাপ ॥ শুভ নববর্ষ, স্বাগত ১৪২২ সাল। এক রাশ আশা আকাঙ্খার স্বপ্ন নিয়ে আসে একটা নতুন বছর। গত বছরের ঘটমান ঘটনাগুলো স্মৃতি হয়ে যায়। পহেলা বৈশাখ আনন্দ উৎফুল্লতার মাঝ পথে খানিকটা সময় নিয়ে আমরা গত বছরের স্মৃতিচারণের বিলাসিতায় মেতে উঠি। চোখের রেটিনায় ভেসে ওঠে পাওয়া, না পাওয়া আর টানাপোড়েনের চড়াই উৎরাই। প্রবীণরা বলেন, ‘যাই বলো বাবা, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ।’ প্রবীণদের নেতিবাচকতা আর খারাপ সময়কে উৎরিয়ে আমরা নবীণরা দেখি সামনে ঝলমলে দিন, ক্যালেন্ডারে নতুন পাতা, সুদিনের ছোঁয়া, মেঘের মাঝখানে আলোর রূপালী রেখা। জীবনবোধে অনীহাকে ঝেড়ে ফেলে, নতুনকে নতুন করে উপভোগের আকাঙ্খা আর নেশা আমাদের পেয়ে বসে। বলি, পুরনো যা গেছে বিদায়, সামনে নতুন দিন স্বাগতম।
নগর জীবনে ব্যস্ততার কাঁথায় মোড়া থাকি উদয়াস্ত। জীবনবোধে, জীবনযুদ্ধে লড়াকু মেজাজ নিয়ে আমরা আবার ক্রিজে ফিরি। মহাকালের বুকে বিলীন হয়ে যাওয়া একটা বছর কিছু না। গত বছরে সংসারে অসুখ-বিসুখ ছিলো, প্রাপ্তির মানচিত্রে ছিলো অঢেল মানহীন চিত্র, আবার গেলো চৈত্রে অষ্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপে আন্তর্জাতিকতায় বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা পত্‌পত্‌ করে উড়েছে, আমরা বাঙালিরা পাওয়ার আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছি। জঙ্গীপনায় সারা দুনিয়ার সংবাদে শিরোনাম হয়েছি, চিন্তা হয়েছে কেন এই মৃত্যু? কেন এই বিভীষিকা? প্রকৃতিতে বর্ষ শুরুর দিন, আর বর্ষ শেষের দিনে তফাৎ খুব একটা নেই। পারিপার্শ্বিকতা ভুলে নিশ্চিন্তপুরের মেঘলা আকাশ দেখি, দেখি বোশেখের রুদ্র ঝড়, বাতাসে এক অন্যরকম গন্ধ, এক অপরূপ অনুভব। ঝরাপাতা পায়ে দলে, নতুন পাতার শিহরণে সবুজ হয়ে ওঠে গাছপালা, চরণে পায়েলা রুমুঝুমু রুমুঝুমু আর মধুপের গুঞ্জরণ শেষে গুনগুন করে আমরা গেয়ে উঠি,
‘এসো এসো হে নতুন উদ্দন্ত বৈশাখ ঋতু রূপী রুদ্রের পিনাক
বসন্ত বিদায় মুখে ধরণীর বুকে জাগিয়াছে তব আহবান।
মর্মরিত শুষ্কপত্রে গাহিয়া চিরন্তর আগমনী গান।’
সাজ সাজ রব শহরে, গ্রামে। শুকনো চৈতী পেছনে ফেলে এসেছে বোশেখের আভা। আমের বোল, সবুজ ধানের পাতায় পাতায় পাক মেরে যায় উদাসী ধুলো, ইরি-বোরোর সমারোহে গ্রামের কচিকচি ছেলেমেয়েরা দৌঁড়ে যায় দল বেধে, বলে - ‘ধানকুড়ালি আইয়্যে’ উতলা ধুলো ঝাপসে দেয় বিস্তীর্ণ সবুজের মধ্যমাঠ। কৃষকের ঘর ভরবে ফসলে আর ছেলেমেয়েরা বায়না ধরবে টাকার মেলায় যাওয়ার জন্য। কোনো কোনো অঞ্চলে বান্মি, কোথাও গাছতলা নামে পরিচিত বৈশাখী মেলা। গেল বছরে আমাদের সাধারণদের জীবিকার পরিসর হয়ে গিয়েছিলো বেহাল। ব্যক্তি হিসেবে, সমাজসভ্য হিসেবে, রাষ্ট্রের একজন সচেতন ও সংবেদনশীল নাগরিক হিসেবে বিশ্ব পল্লীর অন্যসব সদস্যের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছিলাম, চিন্তায় ক্রমশঃ অসুস' হয়ে যাচ্ছিলাম, ঝিম মেরে থাকতো, দিনবদলের পালায় দিন পাল্টেছে। এখনো যা হয়নি সামনের সময়ে তা হবে এমনি একটা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছি সামনের দিকে।

স্টেরিওটাইপড নববর্ষ

প্রতিবছরেই শহরে বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, মাথা মাথারা আশার বাণী শুনান, দেন বড় বড় প্রতিশ্রুতি। বোশেখের দ্বিতীয় দিন থেকে চৈত্রের শেষ দিনতক, আমরা দেখি কিভাবে প্রতিশ্রুতির মালা ছিঁড়ছে। উন্নয়নের চ্যাম্পিয়ন হই, ভাঙ্গা বুকের ভিতর বেজে ওঠে গেল বছরের স্মৃতির সানাই।

সহনীয় জীবন

দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিসহ সামাজিক আচার-আচরণে আমরা সহনীয় জীবন চাই। ঘুম থেকে উঠে পাউরুটি দুধ কিনতে গেলে দোকানী বলে গতকাল দুটো আইটেম, দুই টাকা করে বেড়েছে। রিক্সয় বাচ্চাকে স্কুলে নেয়ার সময় বাস স্টপেজে দেখা যায় ১০টা বাস বাঁকা হয়ে আছে, ডানে বায়ে রিক্স পথ বন্ধ, কায়ক্লেশে স্কুলে পৌঁছলাম। ২০ টাকার নোট থেকে রিক্সওয়ালা দুইটাকা বেশি রেখে দিলো, তারপর কাজের দিন এলাকার মাস্তান মাথা ফাটিয়ে আসলো সাথে ১০-১২ জন শুভাকাঙ্খী, স্টাফ ডাক্তারের সাথে বাজে ব্যবহার করে টাকা না দিয়ে চলে গেলো। নিয়ম নীতির জন্যে পুলিশে খবর দিলে ‘বাঘে ছুলে ১৮ ঘা, পুলিশ আসলে ২০ ঘা’-এর জীবন। বাসকন্ডাক্টর বিশ্রী ভাষায় গাল দিলো ১ টাকার ভাড়ায় ১০ টাকা দিয়েছি বলে। ছোট ছোট কষ্টের ব্যাপারগুলো আজ বড় করে দেখি আমি আজকের মতো কোনো বিশেষ দিন এলোই। নিজের বুকের ভেতরে ভাংচুর হয় যখন দেখি বুড়ো ভদ্রলোককে বাস থেকে নামার সময় না দিয়ে ড্রাইভার টান দিলো। ফসকে পড়লেন মুরুব্বী, ছাল উঠে গেলো পায়ের, ফাটলো মাথা, সবাই নীরব দর্শক। আমরা আর কষ্ট পেতে চাই না। প্রতিদিনই ছুরি পেটে ঢুকার সম্ভাবনা থাকে, গুলি হতে পারে বুকে। স্কুল ফেরত মায়ের সাথে রিক্সয় বাড়ি ফিরতি শিশুটা সিএনজির ধাক্কা খেয়ে হাত ভেঙ্গে আসতে পারে আচমকা। এসব অসহনীয় অবস্থা আমরা উৎরাতে চাই। কিছু কিছু দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক ভালো থাকার, ভালো কিছু করার, নেতির বিপ্রতীপে ইতিকে জেতাবার আর তাই চাই সহনীয় জীবন।

নববর্ষ শহরে

ঢাকার রমনার বটমূলে নতুন সূর্যোদয়ে ছায়ানটের শিল্পীরা ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ডুলিতে দাও’, সুরের মূর্ছনা দিয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। বাংলা একাডেমি থেকে শুরু হয় মঙ্গল শোভা যাত্রা রংবেরং এর পোষাক আর ফুলের অলঙ্কারে বোশাখী সাজে অপরূপা হয়ে ওঠে বাঙালি নারীর চিরায়ত রূপ। গালে উল্কি, খোপায় গাদা আর বকুলের মালা। কবির ভাষায়, ‘চলে নীল শাড়ি নিংয়াড়ি নিংয়াড়ি, পরান সহিত মোর।’
নবীণ প্রবীণের মিলন মেলায় উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি, রমনার বটমূল সহ প্রতিটি বাঙালি ঘর -
‘ভৈরব তুমি কি বেশে এসেছো
ললাটে ফুসিছে নাগিনী।
রুদ্র বীনায় একি বাজিলো সুপ্রভাতের রাগিনী।’

শিল্পকলায় বাউল, লালন, হাসন মাইজভান্ডারী বাতাসে ভাসে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই মেতে ওঠে বছরের পয়লা দিনটিকে বরণ করে নিতে। তাইতো পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন