বুধবার, ৫ জুন, ২০১৩

গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়


গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়

 
দিগন্ত ॥ শাসনপদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্রের চেয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো তন্ত্র এখনো পাওয়া যায়নি। চলমান পৃথিবীর শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য আচরিত শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনী খেলা নয়। গণতন্ত্র হচ্ছে - সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য দেওয়া, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার বাতাবরণ সৃষ্টি করা, নাগরিকদের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু স্বাধীনতার পর গত ৪২ বছরে আমাদের অভিজ্ঞতা কি বলে যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? নাকি উল্টো ঘটনা ঘটেছে? বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র নেই তার বহু প্রমাণ চারদিকে জ্বল জ্বল করছে। এদেশে নাগরিকদের অধিকার ও সুযোগের সাম্য তো আসেইনি, বরং বৈষম্য আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী খেলার অন্তরালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পরিবারতন্ত্র। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী সুকৌশলে গণতন্ত্রকে নির্বাচনের সমার্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এদেশের মানুষ মনে করে নির্বাচনে ভোট দিতে পারলেই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো। বাংলাদেশের গণতন্ত্র আসলে ছদ্মবেশী একনায়কতন্ত্র। এই বিকৃত গণতন্ত্রে শাসকগোষ্ঠী চড়া গলায় মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রতি তাদের আনুগত্য  প্রকাশ করে।

প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের ব্যবস্থায় মানবাধিকার ও সাম্যের ভিত্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই বিকৃত ব্যবস্থা জাতীয়তাবাদ ও পররাষ্ট্রনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে উঠতে দেয় না এবং গড়ে উঠতে থাকলেও তাকে বাধাগ্রস্থ ও ধ্বংস করে। এই দূষিত ব্যবস্থা বহুত্ববাদ বিলুপ্ত করে, এমনকি রাজনৈতিক দলের মধ্যেও গণতান্ত্রিক মতপার্থক্যের অবকাশ রাখে না। এ ব্যবস্থার আওতায় গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান উপাদান, সংবিধানসম্মত বিরোধী দলকেও সুবিন্যস্তভাবে দুর্বল করা হয়। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল কূটকৌশল ও বল প্রয়োগ করে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধী পক্ষকে দমন, পীড়ন ও নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দল আইনসভা, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের স্বাধীনতা ও শক্তি খর্ব করে। তাদের দলীয় নয়, দলবাজি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করে বলহীন ও নির্জীব করে তোলে। এ ধরনের বিকৃত গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার খোসা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মূলে রয়েছে মানুষের সাম্য, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধাসহ অন্যান্য চিরন্তন মূল্যবোধ। মৌলিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে সাধারণ ঐকমত্যের ওপর ভিত্তি করেই গণতন্ত্রের ভুবন তৈরি হয়। এই ঐকমত্যেরও অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক মাত্রা রয়েছে। এ দুই ক্ষেত্রেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করলে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

সামপ্রতিক কালে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে যে প্রতিদ্বনিদ্ধতা চলছে তাতে আদর্শের প্রতিযোগিতার চাইতে ক্ষমতার দ্বনদ্ধ, যাওয়া ও থাকার প্রবণতাই মুখ্য। এই প্রতিদ্বনিদ্ধতা আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষা করবে না, বরং ১৯৭৫ পরবর্তী, কিংবা ২০০১ থেকে ২০০৮ সময়ের ধারায় ঠেলে দিতে পারে। বিএনপি রক্ষণশীল গণতন্ত্রের ভাবাদর্শে হাঁটতে পারে, তবে তা যদি উগ্র ডান, হঠকারী ডানদের জঙ্গীবাদী ধারায় টেনে নিয়ে যায় তা হলে বাংলাদেশের দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিষয়টি আওয়ামী লীগ এবং মহাজোটভুক্ত দলগুলোকে আরো গভীরভাবে বিবেচনায় নিয়ে দেশের গণতন্ত্রকে নিরাপত্তা বিধানে ভূমিকা রাখবে সেটিই এ মুহূর্তের ঐতিহাসিক দায়িত্ব হতে পারে। সেই রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে এখন কারোরই ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন