বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর
দায়গ্রস্থতা কমাতে জাতিকে জাগ্রত চিত্ত হতে হবে
শেখ উল্লাস ॥ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘পিএইচডি
ডিগ্রীধারী ডক্টরেট এবং বিশ্বব্যাংকের কেরানীদের দিয়ে দেশ চলতে পারে না। তাদের শাসনামলে
দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে না, দ্রব্যমূল্য কমবে না। মানুষের নিরাপত্তা থাকবে না।
তাই অনতিবিলম্বে নির্বাচন দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো বিকল্প
নেই।’ ১২ এপ্রিল ২০০৮ দলের জরুরি প্রেসিডিয়াম সভার পর গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে তিনি
এসব কথা বলেন। (তথ্যসূত্র ঃ ১৩ এপ্রিলের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক)
প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কারা দেশ চালাবে? দেশটি কার? লাখো
বাঙালির আত্মত্যাগ, আত্মদান এবং বিশ্বের সকল প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী জনগণের অকুন্ঠ
সমর্থন ও সহযোগিতার ফসল আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের জন্মের
সাথে প্রত্যক্ষভাবে যারা জড়িত ছিলেন সেই অগণিত রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সংগঠন, বাঙালি সৈনিক,
কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক সবাই ছিলেন দেশপ্রেমিক। বাংলা ও বাঙালির স্বার্থ, এক কথায়
শত শত বছরের পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালি জাতি একটি রাষ্ট্র গঠন করবে -
এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক মুক্তি পাবে - এই ছিলো সেদিনের সকলের
চিন্তা-চেতনার অগ্রাধিকার। বিশ্ব পুঁজিবাদের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সেবাদাস
কথিত ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সরকার স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা চায়নি।
কেননা, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে এবং এই ভূখন্ডের নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত-বঞ্চিত
মানুষদের উন্নতির পথ খুলে গেলে তাদেরকে ধর্মসহ নানা জুঁজুবুড়ির ভয় দেখিয়ে পিছনে ফেলে
রাখার পথ যে রুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা ছিলো। কিন্তু পাকিস্তান-আমেরিকা-সৌদি সাম্রাজ্যবাদী
আঁতাতের সকল ষড়যন্ত্র ও কৌশলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেয়েছিলো
রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কবি সুকান্তের ভাষা,
‘শাবাস বাংলাদেশ, পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, সব জ্বলেপুড়ে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়’
- সত্যে পরিণত হয়েছিলো।
বাংলাদেশের জন্মলগ্নের চেতনা কী ছিলো? সে চেতনাটি নিশ্চয়ই
ছিলো একটি অসামপ্রদায়িক, উদার মনোভাবাপন্ন, বৈষম্যহীন, শোষণ ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ,
যেখানে বিদেশী শক্তির কোনো প্রভাব থাকার কথা তখন কেউ চিন্তাও করেনি। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ
আমলে বাংলা ও বাঙালির দুর্দশা দেখে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে
হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭২
সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে বলেছিলেন, ‘বাঙালি আজ স্বাধীন
হয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। কবিগুরুর কথা আজ থেকে মিথ্যা হয়ে গেছে।’ কিন্তু
রাজনৈতিকভাবে একটি ভূখন্ডের মালিক হলেই যে একটি জাতি সত্যিকারের স্বাধীনতা পায় না তা
বুঝতে বেশিদিন লাগেনি। বিদেশী কিছু রাষ্ট্রের প্রভাবে ও দলীয় কিছু নেতার প্ররোচনায়
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের জন্মশত্রু পাকিস্তানে গেলেন,
ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিলেন। ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যাওয়ার কিছুদিন পরেই পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো বাংলাদেশে এলেন। ’৭১-এর পরাজিত শক্তি আমেরিকা, পাকিস্তান
ও সৌদি-ওয়াহাবী আদর্শের লোকেরা সেইদিন ভূট্টোকে সম্বর্ধনা দিয়ে আবার নতুন প্রাণ পেলো।
সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হতে থাকলো বঙ্গবন্ধু সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও আমলার নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রমূলক
সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য প্রায়
সকল সদস্যকে এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো পরাজিত
শক্তি আর তাদের দোসরদেরকে বিশ্বাস করা, তাদের সাথে সম্পর্ক করাটাই কত বড় ভুল ছিলো।
’৭১-এ যে রাজাকার ছিলো তারা এবং তাদের দোসররা কখনো বাংলা ও বাঙালির আদর্শিক বন্ধু হতে
পারে না - যদিও তারা বাংলায় কথা বলে। বাঙালিত্ব ভুলে গিয়ে কেউ যতই মুসলমান সাজুক না
কেন তাকে পাকিস্তান-মার্কিন-সৌদি-ইহুদি চক্র
বিশ্বাসঘাতক হিসাবে কাজে লাগাবে কিন্তু কোনোদিনও আপন করে নিতে পারে না। বাঙালি তার
আপন সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সমুন্নত রেখে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক সেটি
কখনোই চায় না সৌদি-এজিদী আদর্শের পাকি-মার্কিনী চক্র। তারা বাঙালিকে তাদের সাদ্দাদ-নমরুদের
আদর্শের নতুন সভ্যতা নির্মাণের শ্রমিক (ক্রীতদাস!) বানিয়ে রাখার মধ্যেই তৃপ্ত রাখতে
চায়। যে কারণে দেখা যাচ্ছে বছরের পর বছর সৌদি নগর-সভ্যতা বিনির্মাণে অক্লান্ত পরিশ্রম
করলেও কোনো বাঙালি সৌদি নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারে না। আর সৌদি নাগরিকত্বের মধ্যে কোনো
বাঙালি কোনোদিন তার বাঙালি সংস্কৃতি (যা তার হাজার বছরের পরিচয়) ধারণ করতে পারবে না।
বড় জোর তাদের সেবাদাস হিসেবেই জীবন কাটাতে পারবে।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর আজও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের
জীবনে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি আসেনি - এ কথা আজ দিবালোকের মতোই স্পষ্ট।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে এ দেশে মার্কিনীসহ বিদেশী অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রভাব ব্যাপকভাবে
বিসতৃত হয়েছে। দেশটির জন্মলগ্নের চেতনা থেকে মোড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সামরিক আর স্বৈরাচারী অপশাসনের কুপ্রভাবে সর্বস্তরে যে অব্যবস্থা, দূরাবস্থা, দুর্নীতি
মাথাচাড়া দিয়েছিলো তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনামলেও তার অবসান হয়নি। বরং গণতন্ত্রের সুযোগ
নিয়ে একটি গণবিরোধী শক্তি দেশের জন্য আরো ভয়াবহ সমস্যা তৈরি করে যাচ্ছে। ’৯৬-এর ১২
জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ দলটি ক্ষমতায়
গিয়ে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে শুভ ও সুন্দর অনেক কিছু দৃষ্টান্ত দেখাতে পারলেও শেষ পর্যন্ত
তা ধরে রাখতে পারেনি আদর্শহীনতা ও স্বার্থান্ধ কিছু নেতার অতি লোভের কারণে। ২০০১ সালের
অক্টোবরে আর এক প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলটি দেশের ভাগ্যে ঘটিয়ে গেছে
চরম সর্বনাশ। এসব সর্বনাশের পরিণতিতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার বিস্তার ঘটেই চলেছে। মাতৃভূমি বাংলাকে আজও সাধারণ শোষিত মানুষ মায়ের মতো ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে নীরবে
নিভৃতে বসে ঠিকই বুঝতে পারে কারা এ দেশের শত্রু, কাদের কারণে বাংলা ও বাঙালির সুখ-শান্তি
বিনষ্ট হয়েছে বা হচ্ছে।
সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার অভাবে একটি জাতি ও রাষ্ট্রের
অবস্থা পঙ্গুত্ব ও প্রতিবন্ধি হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যে জাতি-গোষ্ঠীর রাষ্ট্র সে জাতি-গোষ্ঠী
থেকে সরিয়ে অন্য কোনো ধর্মীয় আমদানীকৃত পরিবেশে ফেলে দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখলে তার
সঠিক বিকাশ ব্যাহত হবেই। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকেও সব মানুষের জন্য সুখ-শান্তিময়
করে তুলতে এর জন্মকালের চেতনার ভিত্তিতেই সম্ভব, আর তার জন্য প্রয়োজন সবার উপরে দেশপ্রেম,
নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ-লালন- পালন করা। শুধু বিদেশী সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে নয়। স্বাধীনতার
পর বিদেশী সাহায্য যত আনা হয়েছে বা এসেছে তার প্রায় সমস্তই ব্যয় হয়েছে একটি ক্ষুদ্র পরিসরের সুবিধাভোগী
গোষ্ঠীর স্বার্থে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে করা হয়েছে দায়গ্রস্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন