মঙ্গলবার, ১৮ জুন, ২০১৩

দলবাজদের দাপট ভেঙে দিচ্ছে জাতির মেরুদন্ড


দলবাজদের দাপট ভেঙে দিচ্ছে জাতির মেরুদন্ড

দিগন্ত ॥ দল শব্দের দু’টি অর্থ। দলপতি যখন শক্তিদাতা, সৌন্দর্যদাতা, প্রাণদাতা হন তখন দল অর্থ হচ্ছে সংগঠিত জনতা যারা লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা করে। দলপতি যখন পীড়নদাতা, দোলনদাতা তখন দল অর্থ হচ্ছে  দলন, পেষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন। দলের মধ্যে কে দলপতি হবেন এ নিয়েই শুরু হয় দলাদলি ও দলবাজি। দলবাজির মূল কারণ ব্যক্তিস্বার্থ। ব্যক্তিস্বার্থে দলের ভালো বা মন্দ, যে কোন সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিকভাবে সমর্থন করাই হল দলবাজি। দলবাজরাই দল এবং দেশের ক্ষতি করে। কারণ তারা দলনিরপেক্ষ অবস্থানে দাঁড়িয়ে দলের কোন ভুল সিদ্ধান্তকেও সঠিক বলে প্রচার করতে এমনভাবে ব্যস্ত থাকে যে, তাদের কারণে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের পক্ষে অনেক সময়ই উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না যে,  তাদের সিদ্ধান্তটি আসলে সঠিক নয়। ফলে সরকার সেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েই এগিয়ে যায়, এক সময় যা সরকারের বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত, বড় বা লোভনীয় কোন সরকারি পদ, ব্যবসা, ব্যাংক, বীমা, টিভি চ্যানেল ইত্যাদির অনুমোদনসহ বিভিন্ন সুবিধা বাগিয়ে নেয়ার জন্যই দলবাজরা অন্ধভাবে দলকে সমর্থন দিয়ে থাকে। এমন নজির আছে ভূরি ভূরি। বঙ্গবন্ধু এ ধরনের দলবাজদের নাম দিয়েছিলেন ‘চাটার দল’।
বর্তমান শাসনামলেও প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দলবাজদের প্রবল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এদেশের মানুষ যথেষ্ট রাজনীতিসচেতন। ফলে কে কী উদ্দেশ্যে সরকারের তোষামোদি করছে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, সব সরকারই দলবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। ফলে জনপ্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- প্রতিটি ক্ষেত্রেই শীর্ষ পদেও দেখা যায় দলবাজদের দাপট। প্রশাসনে সরকারি কর্মকর্তাদের দলবাজি করার উদ্দেশ্যও মূলত ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা অর্থাৎ পদোন্নতি, পছন্দের স্থানে পদায়ন, ঘুষ-দুর্নীতির সুযোগ ইত্যাদি বাগিয়ে নেয়া। এক্ষেত্রে সরকারি চাকরির সুবিধা হল, সরকার পরিবর্তনে দলবাজদের চাকরিচ্যুত হওয়ার আশংকা কম। বড়জোর তাদের ওএসডি করে রাখা হয়। তাতে বেতন-ভাতা হারানোর ভয় নেই। বরং আবার সরকার পরিবর্তন হলে নতুন করে দলবাজির মাধ্যমে ক্ষতিটুকু উসুল করে নেয়া যায় কড়ায়-গন্ডায়। ক্ষমতায় আসা দলের নেতৃত্বও ভাবে, দলকে সমর্থন করার জন্য বেচারাকে আগের সরকার ওএসডি করেছিল, কাজেই এবার তাকে পুরস্কৃত করা দরকার! প্রশাসনে এভাবে দলবাজদের উৎসাহিত করার ফলে নিরুৎসাহিত ও বঞ্চিত হন দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তারা। ফলে সরকারি কর্মকান্ড হয়ে পড়ে স্থবির ও দুর্নীতিগ্রস্থ।
সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলবাজির চিত্রটি আরও ব্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলবাজি না করলে পাওয়া যায় না উপাচার্যের পদ। ফলে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সে দলের অনুগত ব্যক্তির উপাচার্য হওয়া প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগেও প্রাধান্য পেয়ে থাকে দলীয় বিবেচনা। তাই আজকাল শিক্ষকদের মধ্যেও দলবাজির প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠেছে। শিক্ষকরাই যদি দলবাজি করেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের আর দোষ কী! তাই শিক্ষাঙ্গনে বন্ধ হয় না লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি। দলবাজদের দাপট ভেঙে দিচ্ছে জাতির মেরুদন্ড। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে কখনও রক্ষা করা যাবে না মেধাবী ও যোগ্যদের মর্যাদা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাড়বে অন্যায়, বৈষম্য ও দুর্নীতি। দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, দলবাজরা কখনও দলের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। বরং ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা কমাতেই ভূমিকা রাখে তারা। যারা দলবাজি করে বেড়ায় তাদেরও বুঝতে হবে, মানুষ কখনও দলবাজদের পছন্দ করে না। বরং ঘৃণা ও করুণাই করে থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন