মুক্তির যুদ্ধ
আজ বাঙালির দুয়ারে
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যুদ্ধে অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির
ভোগ দখলে কি আজও দিশেহারা হয়ে আছে স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকরা? তাই
বুঝি ৭ মার্চ স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক ঘোষণা সত্ত্বেও বারবার চলে স্বাধীনতার
ইতিহাস লেখা-সংশোধন-পাল্টা সংশোধনের প্রহসন? নাকি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের
বিরুদ্ধে পরিচালিত এক সুপরিকল্পিত সুদূরপ্রসারী গভীর চক্রান্তের প্রকাশ এসব? নইলে
সফল স্বাধীনতা সংগ্রামের দারুন বিজয়ের পরও আজও কেন শেষ হচ্ছে না যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার? কেন নেই যুদ্ধাপরাধীদের কোনো তালিকা? জানা যায়, ১৯৮৮ সালে মুক্তিযুদ্ধ
কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে করা রাজাকারদের একটি প্রাথমিক তালিকা প্রণীত হলেও
রহস্যজনক কারণে সেই তালিকা পরে ভস্মীভূত হয়ে যায়। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ১৯৭১
সালের ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৫৫ হাজার রাজাকার সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ সম্পন্ন
হয়েছিলো। লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১ লাখ। ট্রাস্টের কাছে ৫০ হাজার রাজাকারের তালিকা
ছিলো। ট্রাস্টেরই একজন মাঝারী পর্যায়ের কর্মকর্তার নেতৃত্বে ওই তালিকাটি ভস্মীভূত
করা হয় বলে ট্রাস্টের একটি সূত্রে জানা যায়। (সূত্র - দৈনিক সংবাদ, ৫ ডিসেম্বর
১৯৯২)
গত ৪২ বছরের পূর্বাপর ঘটনাবলী সাদামাটা পর্যবেক্ষণ ও
বিশ্ল্লেষণ থেকেও প্রশ্ন জাগে এই চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের শিকড় কি কেবল ’৭১-এ দৃশ্যত
পরাজিত শক্তির মাঝেই? নাকি তা আরো বিস্তৃত - আরো গভীরে? এই চক্রান্তের শিকার এ
দেশের সাধারণ জনগণ - এমনকি গোটা জাতিসত্তা। এর কারণ খুঁজতে চাইলে ১৯৭১ সালে সংঘটিত
সশস্ত্র যুদ্ধ ও প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রকৃতিটা দেখতে হয়।
ইতিহাসে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ এক জিনিস নয়।
মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির যুদ্ধ, সে শোষণ-নির্যাতন দেশী অথবা
বিদেশী যে শক্তি দ্বারা হোক। আর স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে বিদেশী শোষক-নির্যাতকদের
শাসন থেকে মুক্তি। এই যুদ্ধের লক্ষ্য হচ্ছে বাইরের শাসক উচ্ছেদ করে দেশীয় রাজনীতিক
প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শীদের শাসন স্থাপন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে এটাই
ঘটেছিলো।
১৯৭১ এবং এর আগের রাজনৈতিক ঘটনা ধারা সাক্ষ্য দেয়
পাকস্তানী শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া আকস্মিক এক সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছিলো
নিরস্ত্র অপ্রস্তুত বাংলার মানুষ। ঘটনা ও দলের তরুণ নেতৃত্বের চাপে আর প্রাণ
বাঁচাতে সে যুদ্ধে সামিল হয় ১৯৭০-এর সাধারণ মানুষ এবং?নির্বাচনে বিজয়ী দলটি। সে
যুদ্ধের দ্রুত পরিণতি ঘটে মাত্র ৯ মাসে পাওয়া রাজনৈতিক স্বাধীনতায়। দু’শ বছরের
ইংরেজ শাসন-লুন্ঠনের পর ২৫ বছরের পাকিস্তানী শোষণ-বৈষম্যে অতিষ্ট দিশেহারা মানুষ
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় এক অসম লড়াইয়ে নেমেছিলো ’৭১-এ। যুদ্ধে অংশ নেয়া সাধারণ ঘর
থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সকল শোষণ-বৈষম্য থেকে মুক্তির আকাঙ্খা জেগে ওঠাও
ছিলো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির সে লড়াইটা দানা বেঁধে
উঠতে পারেনি অথবা উঠতে দেয়াই হয়নি আজও। অপরদিকে, বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন
দেশের মর্যাদা পেলেও স্বাধীনতার সুফল আসেনি সাধারণ মানুষের জীবনে। সুফল গিয়ে উঠেছে
সমাজ, প্রশাসনের আমলা ও স্বার্থপর রাজনীতিক স্তরে অবস্থানকারী এবং যুদ্ধোত্তর দেশে
শাসন ক্ষমতায় আসীন সুবিধাভোগী শ্রেণীটির হাতে। শ্রেণীগত এবং স্বার্থগত কারণেই
যুদ্ধের পরাজিত গোষ্ঠীটি ছিলো ওই শাসকগোষ্ঠীরই রক্তিয়, অর্থিয় এবং আত্মীয়ভুক্ত।
ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বন্দ্বটা আর যুদ্ধে বিজয়ী ও পরাজিতদের মধ্যে থাকলো না -
দ্বন্দ্বে গিয়ে ঠেকলো যুদ্ধের ফসল ভোগ দখল আর লুন্ঠনকে ঘিরে। ’৭১ পরবর্তী গত ৪২
বছরের ইতিহাস কেবল তারই প্রতিফলন মাত্র। জাতিকে পরিষ্কার জানতে হবে কেন যুদ্ধোত্তর
সরকার যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে গণক্ষমার পথে গেলো, কেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়া মদদ দিয়ে
যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত করলো, কেন আওয়ামী লীগ যুগপৎ আন্দোলন করে জামাতিদের জাতে
উঠার পথ সুগম করে দিলো, কেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরাও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভের
সুযোগ পেলো, কেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার দল বিএনপি’র ঘাড়ে ভর করে জামাতিরা রাষ্ট্রীয়
ক্ষমতায় বসার সুযোগ পেলো এবং কেন মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি হয়ে
উঠলো রমরমা বাণিজ্যিক উপাদান!
’৭১-এর বিজয় ছিলো কি কেবলই রাজনীতিকদের বিজয়? জনতার বিজয়
কি পরাজিত - প্রবঞ্চিত - প্রতারিত হয়েই যাবে ধারাবাহিকভাবে? দেশের
মানুষের ‘বাঙালি’ জাতীয়তাটুকু কেড়ে নেয়া হয়েছিলো সেই পঁচাত্তরেই। বাকি ছিলো
জাতিসত্তা। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধী-বাণিজ্যে ডুবে থাকা স্বাধীনতার পক্ষের
শক্তিগুলোর, মধ্যে রাজনীতিক ও রাজনীতিজীবীদের
মেরুদন্ডহীনতার সুযোগে ধর্মব্যবসায়ী আর ধর্মান্ধ অপশক্তির দল আজ খোদ জাতিসত্তাকেই
চাইছে গিলে খেতে। ভিনদেশীর খোলস ছিঁড়ে বাঙালির দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ডাকে জেগে
উঠার আজ এখনই সময়। এখনই সময় নতুন প্রজন্মের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গণ জাগরণ মঞ্চ হতে
আবার ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে গণ মানুষের মাঠে নামা এবং বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধটা দ্বিতীয় মুক্তির যুদ্ধের মাধ্যমে শেষ করা। বিজয় হাতছানি
দিচ্ছে, নিয়ে আনতে হবে বাঙালির।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন