বিচিন্তক
মানস নজরুল
সালাহউদ্দিন আহমদ ॥ কবিতার
বাইরেও নজরুলের বিরাট বিচিত্রতাও নিশ্চয় অবিস্মরণ দ্যুতিময়। তাঁর গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ চর্চা, পত্রিকা সম্পাদনা
ও পরিচালনা; অভিনয় চলচ্চিত্র পরিচালনা, গীতিকার, সুরকার, আবৃত্তিকার, গায়ক ও বক্তা হিসেবে দক্ষতা -সমস্ত
মিলেই নজরুল। বিশেষ করে তাঁর গানের কথা বলবো যে - গানের অনেকগুলো কবিতা হিসেবেই বিবেচ্য
এবং যে গানের বিষয় ও সুরের বিচিত্রতা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গীতিকারদের তুল্য। না মেনে উপায়
নেই, রবীন্দ্রনাথের পরে আর কোনো লেখকের মধ্যে এতো বিচিত্র বিষয়ে এতো বিপুল সাফল্য অর্জিত
হতে দেখা যায় নি।
নজরুল চিন্তাশীল, ভাবুক। দর্শনের
ওপর কোনো রচনা না করলেও কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধে তার দার্শনিক চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে। আর
সার্থক দর্শন মানেই জীবন দর্শন। নজরুলের চিন্তা-চেতনা, জগত ও জীব
ভাবনার সমষ্টিই তাঁর দর্শন। দর্শনের জীবন অর্থ ও ব্যঞ্জনার নিরিখেই নজরুলকে বিচার করতে
হবে। নজরুলের মানস-চিন্তা,
দারিদ্রের কঠোরতা, যুদ্ধের হিংস্রতা, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, সংকীর্ণতা, ও কু-সংকার
প্রভৃতি প্রতিকুল পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। উৎপীড়িত মানুষের জন্য
লিখেছেন ও লড়াই করেছেন। সময় ও পরিস্থিতি প্রয়োজনে, তাঁর মোহ নিদ্রা থেকে জাগাবার লক্ষ্যেই
তিনি জয়গান করলেন দ্রোহ,
আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তির। এভাবে দ্রোহী, চেতনা ও অহমের
সাধনার মাধমে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, তাই বাংলা মানসলোকে তাঁকে করে তুললো
অনন্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ রোমান্টিক কবি প্রবরের আনন্দময় কাব্য ধারার
সঙ্গে এখানেই পার্থক্য বিচিত্র নজরুল চেতনার।
প্রতিবাদ ও নেতিবাচক মনোভাব
নজরুল-দর্শনের শেষ কথা নয়। এটাকে আমরা নজরুল দর্শনের প্রারম্ভিক পর্ব বলে অভিহিত করতে
পারি। নজরুল ধ্বংসস্তুপের ওপর গড়ে তুলতে চান নতুন সৃষ্টির সৌধ। আর এ জন্যে তিনি জোর
দেন অহংবোধ ও আত্মনিষ্ঠার। এভাবে নিজের উপর নিজের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষ আত্মশক্তিতে
বলীয়ান হয়। সে অনুধাবন করতে পারে পরম স্রষ্টার শ্রেষ্ঠতম জীব হিসেবে সে মহান। মানুষের
অন্তরে স্রষ্টার অধিষ্ঠান হয়। মানুষকে স্রষ্টার কাছাকাছি যেতে কোনো অনুমতির প্রয়োজন
পড়ে না। এ প্রসঙ্গে মহাকবি ইকবাল তার ‘আসরারই খুদী’ গ্রন্থে ‘আমি’র বর্ণনায়
বলেন, যার অর্থ, নিজেকে এমনভাবে শক্তিশালী কর যেন প্রতিটি ভাগ্য নির্ধারণের সময় স্বয়ং আল্লাহ তাঁর
বান্দাকে জিজ্ঞেস করেন : বল; তোমার কি চাই? একই বক্তব্যের ক্রমধারায়, অর্থাৎ স্রষ্টা
ও সৃষ্টির এই নিবিড় সম্বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল ‘আমি’কে বর্ণনা
করেন অসীম বলে।
দর্শনের দার্শনিকরা যেভাবে
স্রষ্টা ও সৃষ্টি,
খোদা ও বান্দার সম্বন্ধ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন, আমরা দেখি
নজরুল ঠিক একইভাবে অগ্রসর হন। একই প্রসঙ্গে কবি বলেন -
‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়
আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
আমার তিয়াসী বাসনায়-’
নজরুল এই একই তত্ত্ব ব্যক্ত
করেছেন তাঁর আরেকটি কবিতায়। তিনি বলেন ঃ
আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল আমার
দেউল
আমার আপন দেহ
আমার এই প্রাণের ঠাকুর নহে
সুন্দর
অন্তরে মন্দির সেই।
‘ধূমকেতু’ কবিতাটির
মধ্যে নজরুল এর কবিসত্ত্বার স্বরূপ প্রতিবিম্বিত। সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে দেখা যায়
যে, এই আপাত দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য নজরুল কবি মানসের মধ্যে একটি স্থির বিশ্বাসের আলোকের
সমন্বয় লাভ করেছে। যে তত্ত্বের মধ্যে সমস্ত বৈলক্ষন্য সংগতি ও ঐক্য পায় তা বাংলায় লীলাবাদ
নামে পরিচিত। নজরুল এই তত্ত্বের তাত্ত্বিক ছিলেন বলে তাঁর পক্ষে একই সঙ্গে শাক্ত সংগীত, বৈষ্ণব গান, ইসলামী সংগীত
প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্ম বিষয়ক রচনার জনক হওয়া সম্ভব হয়েছে।
নজরুল কবি মানসে শুধু দ্রোহ
নয়, আমরা দেখি প্রেমও কবির অন্তরে ফল্গুধারার ন্যায় বহিত হয়েছে। কবির অনেক কাব্যে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রেমের প্রকাশ
ঘটেছে। ‘দোলন চাঁপা’ কাব্যে কবির প্রেম সম্পর্কিত অস্থির, মানসিকতা ধরা পড়ে। প্রেমিকের বিচিত্র
প্রণয়লীলা ও তাঁর মান-অভিমান, অনুরাগ-বিরাগ, দ্বন্দ্ব-সংশয় প্রভৃতি সবরকম ভাবই
‘দোলন-চাঁপা’ কাব্য গ্রন্থের বিধৃত হয়েছে। এরকম শোনা যায় প্রমীলার ডাকনাম ছিল ‘দুলি’ বা ‘দোলন’। এই দোলন
থেকেই কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে। কবিতাগুলো ভিতরকার কথা প্রিয়ের জন্য বেদনা-উচ্ছাস।
সামরিক কবির প্রেমের উল্লাস তাঁর সামরিক উচ্ছ্বাসের মতোই ঝড়ের হাওয়ায় বহমান। ‘পূজারিনী’ কবিতাটি তাঁর
শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। যাতে নজরুল দেহগত প্রেমের অদ্ভূত রহস্য উদ্ঘাটনে উন্মুখ হয়েছে। ‘পূজারিনী’ কবির জীবন্ত
মানস-প্রতীমা।
নজরুল শুধু আত্মসত্তার মহিমাই
বর্ণনা করেন নি, তিনি গুরুত্বের সঙ্গে মানব সত্ত্বা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর দর্শনে প্রেম হলো
মানব প্রেম আর ধর্ম হলো মানব ধর্ম। তাঁর কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও
গানে মানুষের কথাই বলা হয়েছে। সমাজের সংকীর্ণতা, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, মানুষে মানুষে
বিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা কবি মনকে দারুণভাবে ব্যথিত করেছেন। তিনি সব সময়ই মানুষের জয়গান
গেয়েছেন। সবার উপরে স্থান দিয়েছেন মানুষকে। কবি তাই ‘মানুষ’ কবিতায় লিখেছেন
ঃ
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু
মহীয়ান।’
নজরুল সাম্প্রদায়িকতা কখনো
প্রশ্রয় দেননি। তিনি সব সময় অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তিনি হিন্দু-মুসলমান
উভয় সম্প্রদায়ের অমানবিক দিকগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। নজরুল জীবন দর্শনের লক্ষ্য
ছিলো হিন্দু মুসলমানের মিলন ঘটানো।
নজরুল ছিলেন দেশ প্রেমিক। নজরুলের
দেশপ্রেম তাঁর নিজেরই মতো দুর্দম, তাঁর কোন দলের জ্ঞান নেই, প্রাধান্যের আকাঙ্খা নেই; সকলকে সমান
অধিকারে তিনি দেখতে চেয়েছেন এবং তাদের সঙ্গে গলাগলি হয়েই সে স্বাধীনতা পেতে চেয়েছেন।
নজরুলই সম্ভবতঃ একমাত্র কবি, যিনি এ দেশের হিন্দু-মুসলমান দুই বৃহৎ জাতিকে বলিষ্ঠ স্বীকৃতি
দিয়েছেন। তার কবিতায়,
তাঁর গান, তাঁর সামাজিক মেলামেশা প্রভৃতির ভেতর দিয়ে তা ফুটে উঠেছে। তিনি
বিশ্বাস করতেন, এই দুই বৃহৎ জাতির পরস্পর প্রীতির অন্তরালেই সমগ্র দেশের কল্যাণ নিহিত আছে। তাই
তিনি সকল সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পেরেছেন। এ ব্যাপারে তিনিই বোধ
হয় একক। বঙ্কিমচন্দ্র,
শরৎচন্দ্র এমন কি রবীন্দ্রনাথও সাহিত্যক্ষেত্রে সব সময় সাম্প্রদায়িকতার
উর্ধ্বে উঠতে পারেননি।
নজরুলের মানবতাবাদের প্রকাশ
ঘটেছে তাঁর বিভিন্ন কাব্য,
সাহিত্য, গান ও অভিভাষণে। তিনি সমস্ত মানুষকে এক করে দেখতে চেয়েছিলেন।
সমগ্র পৃথিবীকে তিনি এক দেশ হিসেবে ভাবতেন। এদিক থেকে নজরুল ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদী।
তিনি ছিলেন বিশ্বের নাগরিক। তাঁর বিভিন্ন কাব্যে মানবতার সুরটি স্পষ্ট হয়ে উঠে। কবিতাগুলোতে
শোষণ, বঞ্চনার, অসাম্যের বিরুদ্ধে কবি কণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছে। নির্যাতিত অবহেলিত মানবতার বিরুদ্ধে
তিনি প্রচন্ড বিদ্রোহ করেন। তিনি এই শোষণ, বঞ্চনা যে পর্যন্ত শেষ না হবে সে পর্যন্ত থামবেনা না। বিদ্রোহী কবিতায়
তিনি বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা করেন ঃ
মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপান ভীম বণ-ভূমে
রণিবে না।
গভীর ও ঘনিষ্ঠ মানবতাবোধই নজরুলের
সাম্যবাদের ভিত্তি। মানুষের ভেদাভেদ তিনি স্বীকার করেন নি। নর-নারীর মধ্যে অধিকার বৈষম্যের
তিনি বিরোধী। সর্বধর্মের উপরে মানবধর্মকেই তিনি উচ্চতম স্থান দিয়েছেন। মানুষের মধ্য্যেই
তিনি সৃষ্টিকর্তাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর সাম্যবাদ ঈশ্বরকে অস্বীকার করে না। এক ঈশ্বরের
অস্তিত্ব সম্পর্কে দৃঢ় আস্থা নজরুলের সাম্যবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘সাম্য’ কবিতায় তিনি বলেন ঃ
হেথা স্রষ্টার ভজনালয় এই দেহ এই মন
হেথা মানুষের বেদনায় তাঁর দুঃখের
সিংহাসন
সাড়া দেন তিনি এখানে তাঁহারে
যে নামে যে কেহ যাকে
যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু
যে নামে ডাকে সে মা’কে।
নজরুলের সাম্যবাদ সবধর্মের
মহামিলন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন ঃ
যেখানে আসিয়া এক হ’য়ে গেছে সব
বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ
মুসলিম-খৃষ্টান।
নজরুল কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন
না। তবু তাঁর বিভিন্ন রচনায় রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে। কবি জীবনের প্রারম্ভকাল
থেকে অবসান কাল পর্যন্ত নজরুল ইসলাম মনে প্রাণে বিপ্লব ও বিদ্রোহকে সমর্থন করেছেন।
বিদ্রোহ ও বিপ্লব ব্যতীত স্বাধীনতা ও মুক্তি লাভ সম্ভব নয়, এ রকম ধারণা
নজরুলের জীবন দর্শনের অর্ন্তগত।
আধুনিক বাংলা কবিতার দু’শো বছরের
(উনিশ ও বিশ শতাব্দী) ইতিহাসে নজরুল ইসলাম অন্যতম প্রধান কবি। অবিসংবাদী রবিকাব্যচ্ছায়া
থেকে তিনি প্রথম বাংলা কবিতাকে মুক্ত করেন - অন্য কয়েকটি ধারা প্রবাহিত করেন। নজরুল
ইসলাম হয়ে ওঠেন ‘জাতীয়তাবাদী কাব্য নায়ক’ বাংলা কবিতার প্রথম সার্থক সাম্যতন্ত্রের উদগাতা, নিপীড়িত ও
শোষিত শ্রেণীর মানুষের বন্ধু, হিন্দু-মুসলমানের সৌভ্রাত্বের প্রতীক, আন্তর্জাতিক
মিলনের পরিপোষক। এই পরিচয়েও নজরুলের সমস্ত পরিচয় প্রকাশিত হয় না; কেননা তিনি
ওসবের পরও প্রেমের কবি,
নিসর্গের কবি, বাঙালি জাতির কবি। আসলে নজরুলের ছিলো
বিচিন্তক মানুষের ভিন্ন-ভিন্ন কক্ষ। তাঁর প্রতিভার তাবৎ বিচ্ছুরণ কবিতার কেন্দ্র থেকেই
- কবিতার রশ্মি ও জল তাঁর সমস্ত শিল্পকাজে সঞ্চালিত ও প্রবাহিত। এতো বিচিত্র ক্ষেত্রে
এতো সাবলীল স্বচ্ছলতা,
আর তাও মাত্র সৃষ্টিশীল তেইশ বছরের (১৯১৯-১৯৪২) মধ্যে আজ একটি
প্রাকৃতিক ঘটনা বলেই মনে হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন