বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বাংলার মানুষ ও মাটির ভাষা বুঝতে না পারলে রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় না

বাংলার মানুষ ও মাটির ভাষা বুঝতে না পারলে
রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় না

দিগন্ত ॥ বাংলার মাটি এবং এর জনগণের ভাষা বুঝতে না পারলে এদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় না। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় যে রাজনৈতিক শক্তি এদেশের গণমানুষের সকল আশা-আকাঙ্খাকে ধূলিসাৎ করতে চেয়েছিল তাদের পরাজয়ের একটি মাত্র কারণই ছিল তারা এদেশের মানুষের ভাষা অর্থাৎ, চাওয়া-পাওয়াকে চায়নি। ইতিহাসের সেই একই ঘটনার পুনারাবৃত্তি ঘটেছে এদেশে বিগত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল কয়েকমাস ধরে যেভাবে ধ্বংসাত্মক তাণ্ডব চালায় তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, রাজনৈতিক কর্মসূচী  আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর্যায়ে ছিল না বরং তা রীতিমতো সন্ত্রাসে রূপ ধারণ করে। এ রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাস কার বিরুদ্ধে ছিল? আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা হয়, রেলগাড়ি, বাস, বেবিট্যাক্সি, রিক্সায় পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করা হয়। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জনগণের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বিনষ্ট করা হয়। বিরোধী জোট যেন সারাদেশকেই ধ্বংসের শেষ সীমানায় নিয়ে যেতে চায়। এভাবেই যদি চলতে থাকতো তাহলে দেশের অবস্থা কি দাঁড়াতো? তারা সব ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে কেন এহেন আচরণ শুরু করেছিল? কেন সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল? এ প্রশ্নের কোন জবাবই তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। এখন তারা আবার নির্বাচিত এবং বিশ্ব মহলের স্বীকৃত নতুন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। অথচ এ সরকারের আমলে উপজেলা নির্বাচনেও এখন তারা অংশ নিচ্ছে!
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার ছিলো, নবম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকেই প্রধান বিরোধী দল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাও প্রদর্শন করেনি। তারা দিনের পর দিন সংসদের অধিবেশনে অনুপস্থিত থেকেছে, নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন থেকেও বিরত থেকেছে। বিএনপি-জামাত গণতান্ত্রিক রাজনীতির বদলে সন্ত্রাসকেই তাদের অন্যতম প্রধান কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। জামাতের সঙ্গে জোটবেঁধে তারা হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতা চালাচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচাল করতে অবরোধের নামে ট্রেনে আগুন লাগিয়ে ও লাইন উপড়ে ফেলে কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করা হয়েছে। ঝরে গেছে অনেক অমূল্য জীবনও। এসব বিষয় রাজনীতির কোনো সংজ্ঞায়ই নির্ণীত হতে পারে না। হরতালে নির্মমতা-নিষ্ঠুরতার যেসব চিত্র ফুটে উঠছে তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অতীত। জীবন্ত মানুষ দগ্ধ হয়েছে হরতালের আগুনে। তারপরও হরতাল আহ্বানকারীদের বিবেকবোধ জাগ্রত হয়নি ! প্রশ্ন হচ্ছে, আর কত মানুষ রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হবে? কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে গণতন্ত্রের নামে এমন মর্মন্তুদ চিত্র অচিন্তনীয়।
জনগণই সর্বময় ক্ষমতার উৎস বলা আছে আমাদের সংবিধানে। অথচ পথেঘাটে, গ্রামেগঞ্জে জনগণকে হত্যা করা হচ্ছে। জনগণের ওই ক্ষমতায়নে কোনো রাজনৈতিক দলই আজ পর্যন্ত বাস্তবধর্মী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে অথবা আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণকে রাজনীতিকরা গিনিপিগ হিসেবে বারবার ব্যবহার করছে। একের পর এক ককটেল, টিয়ারশেল, গুলি, পেট্রোলবোমা মেরে, সিএনজিতে আগুন দিয়ে, জীবন্ত পুড়িয়ে মারছে সাধারণ মানুষকে। গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে গণতন্ত্রপ্রেমীরা নিরীহ সাধারণ মানুষকে মেরেছে অনায়াসে। 

হরতাল অবরোধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সারাদেশে বিজিবির এক সদস্যসহ বিভিন্ন পেশার কমপক্ষে ৬০ জন মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছে শিশু নারী-পুরুষসহ প্রায় আড়াই হাজার। তারা দুই শতাধিক যানবাহনে আগুন ও এক হাজারের বেশি যানবাহন ভাঙ্‌চুর করেছে। রেলে নাশকতার সংখ্যা প্রায় ২শ'। বিভিন্ন স্থানে একের পর এক নৈরাজ্যের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। হানাদার বাহিনীর আদলে জামাত-শিবিরের তাণ্ডবে ধ্বংস করা হয়েছে দেশের রেলপথ, সড়কপথ। ইতিহাস বলে, গণতন্ত্রের জন্য, সুশাসনের জন্য, সাম্য-ন্যায়বিচার-স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে যে রক্ত ঝরেছে, সেখানে নিরীহ মানুষকে কখনো লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি। যাঁরা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছেন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছেন; তাঁরাই অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। আজকের দিনের মতো তাঁরা অন্যের জীবন কেড়ে নেননি। বরং আন্দোলনকারীরা সর্বদা নিজের জীবনের বিনিময়ে অন্যকে জীবন দান করেছেন। মানব ঢাল হয়ে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করেছেন। অথচ আমাদের দেশে গণতন্ত্র রক্ষার নামে যে আন্দোলন হচ্ছে,  সেখানে আন্দোলনকারীরা সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে পুড়িয়ে  মেরেছে, হত্যা করেছে। সন্ত্রাস-ত্রাসের রাজত্ব কায়েমই তাদের আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের রক্তে যাদের হাত রঞ্জিত, সেই খুনি-সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে কখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে আন্দোলনকারীকেই সর্বপ্রথম গণতন্ত্রমনা হতে হবে। গণতন্ত্রপ্রেমীদের গণমানুষের ভাষা বুঝতে হবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সফলতার পূর্বশর্ত হচ্ছে, গণমানুষের ভালোবাসা অর্জন। নিরীহ মানুষকে হত্যা করে নয়, নিজের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দেয়ার মনসিকতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তির পক্ষেই কেবল সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ইতিহাস বলে, খুনিরা কখনো গণতন্ত্রের সৈনিক হতে পারে না। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করা যায়। কিন্তু কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। একাত্তরের ঘাতক-দালালসহ পরাজিত কোনো শক্তিকে বাঁচাতে গেলে জনগণের ভাষা, বাংলার মাটির গন্ধ বোঝা কখনোই সম্ভব নয় এবং এই জাতীয় কোনো শক্তি বাংলার মাটিতে কখনো ঠাঁই পাবেনা-এই সত্যটুকু যত তাড়াতাড়ি তারা বুঝতে পারবে-ততই মঙ্গল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন