মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

কুরআনের আলোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব

কুরআনের আলোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব

সংলাপ ॥  আদম (আ.)- কে সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ তাঁকে সব কিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন। আর এসব নামই মূলত ভাষা। মাতৃভাষা হলো মায়ের ভাষা। মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ তার মনের ভাব সহজেই প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। স্রোতের পানির মতো সে ভাষা অবিরাম চলে চলে পথ করে নেয়। বাঁধ দিতে গেলে বাঁধ টেকে না,  স্রোতের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। গতিরোধ করা যায় না। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মানুষের অস্তিত্বের প্রধান তিনটি অবলম্বনই হচ্ছে- মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি। মানুষের জীবন হচ্ছে তার মাতৃভাষা, দেশের ভাষা, জাতির ভাষা। ভাষা সমাজ গড়ে, আবার সমাজও ভাষা গড়ে। তাই কোনো জাতির ভাষা দ্বারা তার সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। পৃথিবীতে মানব বংশের বিচিত্রতা এবং মানুষের  চৈত্র্যময় রং, রূপ, দেহসৌষ্ঠবের পার্থক্য যেমন মেনে নিতে হয়, তেমনি তাদের ভাষার পার্থক্যও মেনে নিতে হয়। ভাষাকে আল্লাহ তায়ালার মহান সত্তাকে চেনাজানা ও তাঁর রহস্যকে বোঝার নিদর্শন বলা হয়েছে। কুরআন বলছেন,  'নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি এবং তোমাদের স্ব স্ব (মাতৃ) ভাষা ও বর্ণের  বৈচিত্র্য, তাঁর (আল্লাহর) নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম।' (৩০:২২) কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী ভাষার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আল্লাহই।
মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করে তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য কথা বলা শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী : 'তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাদের ভাব প্রকাশ করতে শিক্ষা দিয়েছেন।'' (৫৫:৩-৪) তথা কথা বলা শিক্ষা দিয়েছেন।
পৃথিবীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত যত ভাষার আবির্ভাব হয়েছে এবং যেসব ভাষা বর্তমানে প্রচলিত আছে, তার মধ্যে এমন কোনো ভাষা নেই, যে ভাষায় শুধু একজন লোক বা একটি পরিবার কথা বলে; বরং প্রত্যেক মাতৃভাষায় নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠী কথা বলে। আবার কখনো দেখা যায় একই মাতৃভাষায় একাধিক দেশের জনগণ কথা বলে। যেমন- বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং নেপালের কিছু লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। আরবি ভাষায় কথা বলে প্রায় ২২টি দেশের লোক। বিশ্বের বহু দেশের লোক ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, নির্দিষ্ট একটি ভূখণ্ডের বা একাধিক ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষাটি তাদের মাতৃভাষা হিসেবে বিবেচিত। মাতৃভাষা যে আল্লাহ প্রদত্ত জন্মগত অধিকার, তার একটি প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে লক্ষ্য করে বলছেন, 'তোমাদের ভাষার বিভিন্নতা আল্লাহর এক অন্যতম নিদর্শন।' (৩০:২২)। এ আয়াতে 'তোমাদের' (বহুবচনের) সর্বনামটি এ কথাটিই প্রমাণ করে যে একটি মাতৃভাষায় নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠী কথা বলে থাকে।
পৃথিবীর নানা দেশে নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এক কিংবা দুই লাখ ২৪ হাজার নবী-রাসুলের এক মহাসমারোহ ঘটেছে। আর প্রত্যেক নবী ও রাসুলের ওপর ওহি প্রেরিত হয়েছে তাঁর স্বগোত্রীয় ভাষার মাধ্যমে। মহানবী (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতির জন্য অন্তত একজন করে নবী নির্দিষ্ট ছিল। আর এ জন্যই প্রত্যেক নবী ও রাসুলের ভাষা ছিল তাঁদের অঞ্চলের মাতৃভাষা। কুরআন বলছেন - 'আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যেন তাঁরা তাঁদের সমপ্রদায়ের নিকট সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন।' (১৪:৪)। মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা-ঔদাসীন্য প্রদর্শন সম্পূর্ণভাবে অনুচিত। যারা মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে, তাদের প্রতি ঘৃণাভরে কবি আবদুল হাকীম বলেছেন :
'দেশী ভাষা বিদ্যা যার মন না জুড়ায়
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশে না যায়।'
মহান আল্লাহ মাতৃভাষার গুরুত্ব বোঝাতে কুরআন সম্পর্কে বলেন : 'আমি এ কিতাব (তোমাদের মাতৃভাষা) আরবিতেই অবতীর্ণ করেছি, যাতে করে তোমরা তা বুঝতে পারো।' (১২:২) মহান আল্লাহ তাঁর বাণীতে মাতৃভাষার মৌলিক চারটি কথা- শোনা, বলা, পড়া ও লেখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। মানুষ যেসব মাধ্যম ব্যবহারে জ্ঞান অর্জন করে থাকে, পড়া হলো এর অন্যতম। তাই মহান আল্লাহ কুরআনের সর্বপ্রথম বাণীতে তাঁর নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, 'হে নবী, তুমি তোমার সৃষ্টিকর্তা প্রভুর নামে পড়ো। যিনি সৃষ্টি করেছেন।' (৯৬:১) মহানবী (সা.)-কে যে ভাষায় পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা ছিল তাঁর মাতৃভাষা।
জ্ঞান অর্জনের দ্বিতীয় মাধ্যম হচ্ছে শোনা। আল্লাহ বলছেন, 'সুতরাং আমি যখন নাজিলকৃত বাণী পাঠ করি তখন তুমি (ব্যস্ত না হয়ে) সে পাঠের অনুসরণ করো।' (৭৫:১৮) কুরআনের অন্যত্র বলা হচ্ছে, 'যখন কুরআন পড়া হয় তখন তোমরা তা মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং নিশ্চুপ হয়ে থাকবে। আশা করা যায়, তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হবে।' (৭:২০৪) মহানবী (সা.)-কে যে ভাষায় অহির বাণী শোনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা ছিল তাঁর মাতৃভাষা। শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রথমে অন্যের কাছ থেকে শুনতে হয়।
মানুষকে তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য লেখায় দক্ষ হতে হয়। মহান আল্লাহ মানুষকে কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন (৯৬:৪)। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মহানবী (সা.) নিজ মাতৃভাষায় বিশুদ্ধতা অর্জনের ফলে গর্ববোধ করে বলেছিলেন, 'আমি আরবদের মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধ ভাষাভাষী। উপরন্তু আমি কুরাইশ বংশের লোক।' (ইবনে হিশাম, পৃ. ১৬২)।
হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে এ বলে প্রার্থনা করেছেন, 'আমার জিহ্বায় জড়তা রয়েছে, আমার কথা প্রাঞ্জল নয়, সুতরাং হারুনের প্রতিও প্রত্যাদেশ করুন।' (২৬:১৩) 'হে প্রভু! তুমি আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও, যাতে করে তারা আমার কথা ও বক্তব্য বুঝতে সমর্থ হয়।' (২৬:১৩) মহানবী (সা.) ছিলেন আরবি ভাষাভাষী, মাতৃভাষাকে তিনি এত বেশি ভালোবাসতেন যে তিনি নিজেই বলেছেন, 'আমি তিনটি কারণে আরবি ভাষাকে ভালোবাসি। তন্মধ্যে একটি হলো আরবি আমার মাতৃভাষা।' আল্লাহ বলেন, 'হে নবী! কুরআনকে আমি তোমার নিজের ভাষায় সহজ করে নাজিল করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে' (৪৪:৫৮)।
আরবিতে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আরবি ভাষা মহিমান্বিত হলেও কোনো ভাষাই ইসলামে অবহেলিত নয়। সব মাতৃভাষা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান। তাই কুরআনের ভাষা আরবি হওয়া সত্ত্বেও পবিত্র কুরআন অন্যান্য ভাষার শব্দকে আরবি হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। যেমন- তোয়াহা, আল-ইয়াম, আত-তূর ইত্যাদি সুরইয়ানি ভাষার শব্দ। এর মাধ্যমে কুরআন সব ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। আর এভাবেই একটি মাতৃভাষা সমৃদ্ধ হয়। (জালালউদ্দীন সুয়ুতী, আল-মুযহির। (পৃ.২৬৮-২৬৯)।
নিজ নিজ মাতৃভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা অপরিহার্য বিষয়। পারতপক্ষে সব জায়গায় নিজের ভাষায় কথা বলা। নিজের ভাষায় লেখা আবশ্যক। মহানবী (সা.) হুদায়বিয়ার সন্ধির পর রোম ও পারস্য সম্রাটসহ বিভিন্ন রাজা-বাদশাহর কাছে আরবি ভাষায় চিঠি লিখে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মাতৃভাষা মানুষের জীবনে কত যে গুরুত্বপূর্ণ তার প্রতি লক্ষ রেখে মনীষীরা মূল্যবান উক্তি করেছেন। যেমন- হজরত ইবরাহীমের (আ.) সহিফায় লেখা ছিল, 'জ্ঞানীর জন্য উচিত তার ভাষা ও সাহিত্যের সংরক্ষণ করা, যুগসচেতন হওয়া ও স্বীয় কর্তব্যে সদা মগ্ন থাকা।' হজরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহ.) তাঁর এক ছাত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলে ন, 'যদি হিন্দুস্তানে দ্বীনি খেদমত করতে চাও, তবে উর্দু ভাষায় যোগ্যতা অর্জন করো।' প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, 'প্রত্যেকেরই শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষা হওয়া উচিত। অপর ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষাদান অসম্পূর্ণ শিক্ষারই নামান্তর।' সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, 'কোনো দেশে দ্বীনি খেদমত করতে আগ্রহী ব্যক্তিকে সে দেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি বোধ পূর্ণ মাত্রায় অর্জন করতে হবে।' হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) বলেন, 'যতক্ষণ না তোমরা আপন ভাষা সাহিত্যের অঙ্গনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে, ততক্ষণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।'

অতএব প্রতীয়মান হয় যে কুরআন মাতৃভাষার প্রতি অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করেছে এবং মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য ও শ্রদ্ধাবোধ শিক্ষা  দিয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন