বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বাঙালিত্বের জাগরণ জরুরি

বাঙালিত্বের জাগরণ জরুরি

শেখ বর্ষা ॥ শুরু হলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। স্মরণ করতে হয়, সেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত বাঙালি অতুল প্রসাদ সেন গেয়ে উঠেছিলেন 'মোদের গরব, মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা, তোমার বুকে তোমার বুলে কতই শান্তি ভালোবাসা'। অথচ আজ এদেশেরই তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত মানুষদের মধ্যে বাংলা ভাষার চাইতে ইংরেজির প্রতি আকর্ষণ বেশি দেখা যায়, ছেলেমেয়ের বিবাহ-অনুষ্ঠানের কার্ডটি ইংরেজিতে ছাপিয়েই নিজেকে সমাজের 'নামি-দামি মানুষ' হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে আবারো শুরু হয়েছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি, কড়া নাড়ছে ফাগুন মাস। বাংলা এখন  বিশ্বের তিন তিনটি দেশের-বাংলাদেশ, ভারত ও সিয়েরালিয়নের দাফতরিক ভাষা, বিশ্বের কমবেশি ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষার এখন বাংলা, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, মেঘালয়, বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, ছত্তিশগড়, দিল্লিসহ বিভিন্ন রাজ্যের অসংখ্য মানুষ বাংলায় কথা বলে-এসব কথা ঠিক, কিন্তু এদেশের স্বাধীনতার সুফলভোগকারী একটি গোষ্ঠির মধ্যে বাংলার প্রতি অবজ্ঞা ও ইংরেজিপ্রীতি যেভাবে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে সে ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতে না পারলে দেশকে কখনোই এগিয়ে নিয়ে যাবে না কি-না সে ব্যাপারে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বাঙালি জনগোষ্ঠী আজ হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগরের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে, দূরপ্রাচ্য থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে তারা পাড়ি জমিয়েছে ইউরোপ-আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া-আফ্রিকায়, কিন্তু বাংলাদেশের একটি ব্যাপক জনগোষ্ঠী যে এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, সমাজে ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীর আস্ফালনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন দেশ প্রতিষ্ঠা যে এখনো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি তা বলাই বাহুল্য। নিঃসন্দেহে এর বড় কারণ দেশে একটি অশুভ চক্র এখনো সক্রিয়, যা পরিপুষ্ট হয়েছে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগষ্টের পর। এই অশুভ শক্তিই এদেশের মানুষকে তাদের বাঙালি পরিচয় ভুলিয়ে দিতে চায়, বাংলাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ইংরেজীর প্রতি আকৃষ্ট করে রাখতে চায়। কিন্তু নিজের দেশ, নিজের ভাষা ও নিজের সংস্কৃতিকে ভালো না বাসলে কেউই প্রকৃত অর্থে বড় হতে পারে না, সেকথাটিও আজ তারা হয়তো ভুলে থাকতে বা ভুলিয়ে রাখতে চাইছে। আর এজন্যই  'বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনোবাক্যে বাঙালি হ' -মহাপুরুষ গুরুসদয় দত্তের এই মহাবাণীটি তাই আজ আবারো সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার সময় এসেছে।
এমনই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় নিয়ে গত ১৯শে মাঘ শনিবার থেকে শুরু হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে দেশকে গড়ে তুলতে সামনে পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। এদিকে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১লা ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করে বলেছেন, 'বাংলাদেশে অশুভ শক্তির কোনো স্থান হবে না। এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি শান্তিকামী দেশ'। প্রধানমন্ত্রী আরও বেশি করে বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতির্চ্চার আহবান জানিয়ে বলেন, অশুভ শক্তি প্রতিরোধে সমাজের প্রতিটি স্তরে জাতীয়তাবাদী চেতনার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। একুশের গ্রন্থমেলাকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রেরণার উৎস হিসেবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, লেখক, প্রকাশক ও নতুন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনার বিকাশে এই মেলার অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে এবং এখান থেকে তারা ভবিষ্যতের সঠিক দিকনির্দেশনা লাভ করেন। তিনি বলেন, এই বছরই বইমেলার পরিধি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়েছে। এর লক্ষ্য, এই ঐতিহাসিক স্থানকে জাতির সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত করা। একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দু'দিনব্যাপী জাতীয় কবিতা উৎসব, যার প্রতিপাদ্য ছিল 'কবিতা সহেনা দানব যন্ত্রনা'। এর উদ্বোধনের পর কবি সৈয়দ শামসুল হক তার বক্তৃতায় বলেন, এখনো দেশে দানব রয়েছে। তাদের যাতনা থেকে মুক্ত হতে হলে কবি-সাহিত্যিকদের মিলিত হতে হবে। সুন্দর ও সত্যেও পক্ষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ও অস্ত্র চোরাচালানী ১৪ জনের ফাঁসিতে জাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এই শুভদিনকে ত্বরান্বিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে; যাতে পরাজিত শক্তি আবার মাথাচাড়া দিতে না পারে। উৎসবে বক্তৃতা পর্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ানোর আহবান জানানো হয়।
তাই নতুন দিনের আলোকে বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহীদের আত্মার প্রতি সম্মান জানাতে হলে দেশ থেকে অশুভ শক্তি নির্মূলে ইস্পাতকঠিন শপথ নিতে হবে। এই অশুভ শক্তি সক্রিয় রয়েছে সমাজের সর্বস্তরে, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ছদ্মবেশে। তাদেরকে চিহ্নিত করে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে ইংরেজি, হিন্দী এমনকি আরবীর প্রতি অন্ধমোহগ্রস্ত হয়ে যারা বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করছে তাদেরকে সঠিক পথে আনতে হবে। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) নিজের মাতৃভাষা আরবীকে যেভাবে ভালোবাসতেন, নিজের আরব পরিচয়কে যেভাবে সম্মান করতেন তার অনুসারী হতে হলে আমাদের মাতৃভাষাকে বাংলাকেও সেভাবে সম্মান ও ভালোবাসার শিক্ষা সবাইকে দিতে হবে। বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে একজন খাঁটি মুসলিম হতে গেলে সবার আগে যে একজন খাঁটি বাঙালি হতে হবে- এই সত্য (হাক্কানী) কথাটুকু সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। বাঙালিত্বের জাগরণ দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আর দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলেও এই জাগরণই একমাত্র পথ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন