মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৩

সংবিধানকে ‘তেজপাতা' বলা রাষ্ট্রদ্রোহিতা


সময়ের সাফ কথা ....


সংবিধানকে ‘তেজপাতা' বলা রাষ্ট্রদ্রোহিতা


শাহ্‌ ফুয়াদ ॥ মহানগর বিএনপির আহবায়ক সংবিধানকে তেজপাতা বলেছেন। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এবং এরপরেও অনেক দিন ঢাকার মেয়র ছিলেন তিনি। গত ১৪ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির এক সমাবেশে দলের নেতাকর্মীদেরকে ‘দা-কুড়াল নিয়ে সরকারি দলকে মোকাবেলার আহ্বান জানানোর পর থেকে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তাকে গ্রেফতারের জন্য গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল গোপীবাগে তার বাড়িতে তল্লাশীও চালিয়েছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসের সাথে যে স্থানটি অত্যন্ত পবিত্র, গত ২৫ অক্টোবর বৃহষ্পতিবার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় সভাপতির বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের সংবিধানকে ‘তেজপাতা বলে উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ব্যক্তিগত আকাঙ্খা চরিতার্থ করার জন্য যেভাবে সংবিধানের পরিবর্তন করেছেন, তাতে দেশে সংবিধান বলতে আর কিছু নেই। বর্তমান সংবিধানকে ‘হাস্যকর আখ্যায়িত করে তিনি আরও বলেছেন, এখন দেশে যে সংবিধান চলছে, তা জনগণের নয়, আওয়ামী লীগের। ১৮-দল ক্ষমতায় যেতে পারলে এই সংবিধানকে আপটুডেট করার কথাও বলেছেন তিনি।
নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানকে পরিবর্তন, সংশোধন ও আপটুডেট করার ক্ষমতা অবশ্যই আছে। আর এর জন্যই তো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য রাজনীতি করে থাকে। বাংলাদেশের ৪২ বছরেরও বেশি সময়ে সংবিধান নিয়ে সেজন্যই অনেক রাজনীতি হয়েছে। সংবিধানের অনেক কাঁটা-ছেড়া হয়েছে, সংশোধন হয়েছে। আর এর যত কাঁটা-ছেড়া বা সংশোধনই হোক না কেন তার সবই হয়েছে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে। সাদেক হোসেন খোকার দল বিএনপিও এ পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে তিন তিনবার ক্ষমতায় গিয়ে তাদের ইচ্ছামতো সংবিধানের পরিবর্তন ও সংশোধন করেছে এবং সেইসব সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে অনেক রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-১৯৭৯ সালের ৫ই এপ্রিল সংসদে যখন বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী, তখন সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পর হতে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকান্ডের ফরমান ও প্রবিধানের বৈধতা দান করা হয়, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ হিসেবে যা বহুল পরিচিত। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ সেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে ১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ডের বিচার ও এর রায় কার্যকর করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কেউ সংবিধানকে ‘তেজ পাতা বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে কেউ বলতে পারবে না। আর সংবিধানকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, হেয় করা যে কত বড় অপরাধ তার মতো রাজনীতিকের নিশ্চয়ই না জানার কথা নয়। সংবিধান নিয়ে এমন বক্তব্য অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর আওয়ামী লীগ তার মতো করে সংবিধান সংশোধন করবে-সেটা নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই দেখা গেলো, ২০১১ সালের ৩০শে জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এই সংশোধনী জনগণের বিরুদ্ধে হয়েছে বলে কোনো দল মনে করলে তাকে অবশ্যই সাধারণ নির্বাচনে আবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সংসদে গিয়ে এই ধারাটির বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। এর আগে যে সংবিধান বহাল আছে সেই সংবিধানকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়াই একজন রাজনৈতিক কর্মী বা নেতার স্বাভাবিক আচরণ। এর ব্যত্যয় ঘটলে সেই নাগরিক বা রাজনৈতিক কর্মীকে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করাই রাষ্ট্রের যথাযথ কর্তব্য। কারণ, বর্তমানে সংবিধানের আলোকেই এদেশটি, রাষ্ট্রটি কার্যকর রয়েছে, এই সংবিধানের আলোকেই খালেদা জিয়া সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী। অন্যান্য নেতাদের কেউ কেউ জাতীয় সংসদের সম্মানিত সদস্য/সংরক্ষিত আসনের সদস্য আবার কেউ বা বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ। বিরোধী দলের একজন সদস্যও এখন পর্যন্ত জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন নি, বরং সবাই সংসদ সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চলেছেন। তাই সংবিধানকে ‘তেজ পাতা হিসেবে আখ্যায়িত করে সাবেক মেয়র যেভাবে এর অবমাননা করেছেন সেজন্য তাকে বিচারের কাঠগড়ায় সম্মুখীন করা এখন সময়ের দাবি। তিনি ১৯৭১ সালে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন -একথা বিশ্বাস করাও এখন এদেশের সচেতন মানুষের কাছে এক লজ্জার ব্যাপার। স্মরণ করতে হয় বাংলার এই অমূল্য প্রবাদ বাক্যটি- ‘তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, মানুষ প্রাণপণ প্রচেষ্টায় তবে মানুষ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে ৭১-এর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সামনে যে সংবিধানকে ‘তেজপাতা বলতে পারেন তাকে আর কখনো মুক্তিযোদ্ধা বলা যাবে কি-না সে ব্যাপারে আজ স্পষ্ট ঘোষণা আসা দরকার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন