মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৩

সময়ের সাফ কথা....বান্দার দেলে আল্লাহর জাতের প্রকাশই হকিকি হজ

সময়ের সাফ কথা....
বান্দার দেলে আল্লাহর জাতের প্রকাশই হকিকি হজ

সাদিকুল হক ॥ খাজা মুঈনুদ্দিন হাসান চিশতি বলেন - 'ইনসানের দেল খানায়ে কাবা এবং মোমিনের দেল আল্লাহর আরশ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন 'আমি তোমাদের নফস-এর সাথে মিশে আছি, তোমরা কি দেখতে পাও না'। মানুষের দেলে আল্লাহ অবস্থান করেন বিধায় দেলকে খানায়ে খোদা বা আল্লাহর আরশ আখ্যা দেয়া হয়েছে। বান্দা যখন নফস্‌-এর বন্দেগীরূপ পর্দা দূর করে দেয় এবং আবেদ ও মাবুদের মধ্যে যখন কোন পর্দা অবশিষ্ট থাকে না তখন সে সিফাতে এলাহিতে সামিল হয়ে যায় এবং তখন তার দেলে জাতে এলাহি প্রকাশ পায়। খাজা বলেন, 'বান্দার দেলে আল্লাহর জাতের প্রকাশ হওয়াই কাবায়ে হজ বা হকিকি হজ'।
বাহ্যিক জগত থেকে অসংখ্য বিষয় ভেতরে ঢুকে অভ্যন্তরীণ জগতকে কলুষিত করে। ফলে আমরা প্রবৃত্তির দাসত্ব করতে শুরু করি এবং বিপথগামী হই। তাই অভ্যন্তরীণ জগত থেকে সকল প্রকার সন্দেহ, গোমরাহি ও গায়রুল্লাহর পর্দা দূরীভূত করলে দেলরূপ আয়নায় আল্লাহর জাতের জলোয়া প্রত্যক্ষ নজরে আসবে। এটাই খানায়ে কাবার হজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাঁর মতে, হকিকি হজের আর একটি উদ্দেশ্য হলো স্বীয় হাস্তীকে এমনভাবে মিটিয়ে ফেলা যেন হাস্তীর কোন অস্তিত্বই না থাকে। এ স্তরে বাহির ও অভ্যন্তর সমভাবে পবিত্র হবে এবং ইনসানের দেল আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হবে। তাঁর মতে - 'মাহবুবে হকিকি অর্থাৎ আল্লাহর আশেক হলেই আপন হাস্তি ফানা করা সম্ভব। খাজা মুঈনুদ্দিন হাসান চিশতির তত্ত্বে বাহির থেকে ভেতরে প্রবেশের প্রাক্কালে বিষয়রাশিকে যাচাই-বাছাই করা হলো সালাত, তাকে প্রতিরোধ করা হলো সিয়াম, তাকে বিতাড়িত করা হলো যাকাত। লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিহীন বিষয়গুলো বিতাড়িত করলেও আবার আসতে পারে। তাই আত্মদর্শনের মাধ্যমে তত্ত্বদর্শনে উন্নীত হয়ে এসব বিষয়রাশিকে চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করে জবাই করে দেয়া হলো কুরবানি। এতে অনাকাঙ্খিত বিষয়গুলো আর আগমন করতে সক্ষম হবে না। তাই হজের একটা বিশিষ্ট অঙ্গ হলো কুরবানি।
খাজার দরশনে আত্মদর্শনই হজ। আত্মদর্শনের শেষ স্তরে আল্লাহ দর্শন হয়। আত্মদর্শন অর্থ নিজেকে দেখা। মানুষের একমাত্র সমস্যা হচ্ছে সে নিজেকে দেখতে পারে না। পরিবেশের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় কে কিভাবে সাড়া দেয়, কোন্‌ পরিবেশ তার মধ্যে কি ধরনের উদ্দীপনার সৃষ্টি করে মানুষ এ সম্পর্কে সচেতন নয়। প্রতিমুহূর্তে পরিবেশ থেকে নিজের মধ্যে অগণিত বিষয় প্রবেশ করছে এবং নিজ থেকে অগণিত বিষয় পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে কিন্তু এসব বিষয়রাশির গ্রহণ-বর্জন থাকছে অজ্ঞাত। এসব বিষয়কে জানার চর্চাই আত্মদর্শন বা হজ। হজের মাসগুলো আত্মদর্শনের মাস। যে মাসেই মানুষ আত্মদর্শন করে তা তার হজের মাস। আত্মদর্শনের আবহ সৃষ্টি করতে শওয়াল, জেলক্কদ, জেলহজ্ব এই তিন মাস সকলের জন্য নির্ধারিত  হয়েছে। যারা আত্মদর্শন বা হজ করবেন তারা আত্মদর্শনকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করবেন এবং নির্ধারিত তিনটি মাস এমন সচেতনভাবে যাপন করবেন যেন গৃহীত বিষয়গুলো চিহ্নিত হয়। হজ করতে হলে তা করার সামর্থ্য অবশ্যই থাকতে হবে, এজন্য সর্বোত্তম সামর্থ্য হচ্ছে তাকওয়া। একই সাথে আনুষ্ঠানিক হজে যেমন পথের সম্বল হিসাবে পাথেয় দরকার হয় তেমনই নির্জনে আত্মদর্শন করতেও নিজের এবং পোষ্যদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হয়।
প্রবৃত্তির দাসত্বেই মানবের মানবিকতা ধ্বংস হয়। নিজের উপর নিজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ প্রবৃত্তির দাসত্বে লিপ্ত থাকে। প্রবৃত্তির দাসত্ব তো শয়তানেরই দাসত্ব। শয়তানের দাসত্ব করলে কোন কর্মই আল্লাহর বিধানানুযায়ী হয় না। যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির নির্দেশানুযায়ী চলে, সে আল্লাহ্‌র বান্দা নয়, শয়তানের বান্দা।
আল্লাহর বান্দা হতে হলে আল্লাহ্‌র গুণে গুণান্বিত হবার জন্য আত্মদর্শন অপরিহার্য। আত্মদর্শন একটি জটিল বিষয়। আপন দেহের মধ্যে যা সংঘটিত হয় তা অবলোকন অর্থাৎ গ্রহণ-বর্জন পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করা কঠোর সাধনা সাপেক্ষ। মাথা মুন্ডন করা হজের অবশ্য পালনীয় একটি প্রতীকানুষ্ঠান।
জীবন চলার পথে যেসব বিষয় বারবার গ্রহণ করার মাধ্যমে মগজে স্থায়ীত্ব লাভ করেছে সেসব বিষয় সমূহ নিজের চিন্তাকে অধ্যয়ন করার মাধ্যমে চিহ্নিত করে মুছে ফেলা হচ্ছে মাথা মুন্ডনের হাকিকত। প্রতীক রূপে মাথা মুন্ডন তখনই যথার্থ হয় যখন সাধক দীর্ঘদিনের লালিত বিষয়গুলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে ত্যাগ করতে পারেন। যাদের মধ্যে বিষয়গুলো এমন দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে যে এগুলো ত্যাগ করা যাচ্ছে না তাদের হজ সুসম্পন্ন হয় না। এরূপ ব্যক্তিদের হজ সুসম্পন্ন করার জন্য ত্যাগ ও সংযমের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অভ্যাসের দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়া সহজ নয়। অভ্যাসের দাসত্বে আত্মসচেতনতা থাকে না। অভ্যাসই আত্মবিস্মৃত মানুষকে আধারে নিমজ্জিত করে। হজ বা আত্মদর্শন হচ্ছে একটি সাধন পদ্ধতি। এ পদ্ধতি পথপ্রদর্শক বা গুরুর কাছ থেকে শিখতে হয়।  গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা ও পর্যায়ক্রমে দীক্ষা না নিয়ে কেউ আত্মদর্শনের প্রক্রিয়ায় নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারে না।
খাজা মুঈনুদ্দিন হাসান চিশতি বলেন - আল্লাহর নৈকট্য প্রত্যাশীদের চারটি দলে বিভক্ত করা যায়। এ চারটি দলের মধ্যে জ্ঞানে-গুণে পরস্পরকে বিচার করলে আকাশ-পাতাল পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রথম দল হলো - আওয়ামুল আলম বা সাধারণ মুসলিম। এরা বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতাকে গুরুত্ব দেয়। এরা শরীয়ত পন্থী। এশকে এলাহির পথে চারটি সিড়ির প্রথম সিড়িতে এদের অবস্থান। এরা যদি পরবর্তী মারেফাতের সিড়ি অতিক্রম করার চেষ্টা না করে তবে দ্বিন-দুনিয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে জাহের পরস্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। এ দলকে আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব দল বলা হয়। দ্বিতীয় দল হলো - আওয়ামুল খাস অর্থাৎ সাধারণের মধ্যে বিশিষ্ট দল। এ দলে সাধারণ ও বিশিষ্ট উভয়বিধ গুণাবলি পরিলক্ষিত হয়। এরা আধ্যাত্মিকতার দিকে আকৃষ্ট, কিন্তু আধ্যাত্মিকতার তাৎপর্য সম্পর্কে অজ্ঞ। এরা কখনো দুনিয়ার দিকে আবার কখনো দ্বিনের দিকে আকৃষ্ট হয়। এজন্য এদের বাতেনি চক্ষু নূরে বাতেনি দ্বারা পরিপূর্ণভাবে আলোকিত হয় না। এরাই আহলে তরিকত বলে পরিচিত। তৃতীয় দল হলো খাস ব্যক্তিগণ। এরা শুধু দ্বিনের প্রতি আকৃষ্ট এবং এদের বাতেনি চক্ষু নূর দ্বারা আলোকিত। এরাই আহলে হকিকত। চতুর্থ দল হলো অতি খাস। এদের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র আল্লাহ। আল্লাহর পবিত্র জাতের মজুদ এরা সর্ব অবস্থায় দর্শন করে এবং মনে-মুখে-দেলে বিশ্বাস করে। সর্বপ্রকার কলুষতা ও গায়রুল্লাহর পর্দা এরা একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। দুধের মধ্যে যেমন চিনি মিশে যায় এরাও তেমনি আল্লাহর সাথে মিশে যায়। এরাই আহলে মারেফাত।
সাধারণের মধ্যে বিশিষ্টদের প্রতি খাজা মঈনুদ্দিন হাসানের উপদেশ - 'জাহেরি উলামাগণের (শরিয়ত পন্থীদের) সাথে এসব নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করো না। তাদের চিকিৎসা খোদ আল্লাহই করতে সমর্থ।' প্রত্যেক তরিকতপন্থীদের একথা স্মরণে রাখা দরকার। এর অন্যথা হলে সত্যানুসন্ধান জাহেরি আলেমদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন