বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০১৩

যার তাকওয়া নেই সে কোরবানির নামে পশু হত্যা করে!


যার তাকওয়া নেই সে কোরবানির নামে পশু হত্যা করে!

 
সাদিকুল হক ॥ “উহাদের গোশত ও রক্ত আমার নিকট পৌঁছায় না।  কিন্তু তোমাদের তাকওয়া আমার নিকট অবশ্যই পৌঁছায়।” (২২ সুরা হজ : ৩৭)।

যাহা পৌঁছায় না তাহা পাঠানো অজ্ঞতা, যাহা পৌঁছায় তাহা পাঠানো জ্ঞান। মহান প্রভু নিজেই বলে দিয়েছেন - গবাদি পশুর গোশত ও রক্ত তাঁর কাছে পৌঁছায় না। তাঁর কাছে পৌঁছায় বান্দার তাকওয়া। কুরআনের এই বাণী জানার পরও না বুঝার কারণে মানুষ তাঁর কাছে গোশত, রক্ত পাঠায়। পশু জবাই করলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয় আর তা দেখে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন বিষয়টা অদ্ভুত লাগে শুনতে, অস্বস্তি লাগে ভাবতে, লজ্জা লাগে বলতে। আল্লাহর কাছে পৌঁছায় তাকওয়া। তাকওয়ার সাথে পশুর রক্ত-মাংস কিংবা লোমের কোন সম্পর্ক নাই।

‘তাকওয়া’ কুরআনের একটি অতি মর্যাদাবান শব্দ। সকল ইবাদতের লক্ষ্য তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া শব্দের অনেকগুলো বাংলা প্রতিশব্দ রয়েছে, যেমন - সততা, আল্লাহর আনুগত্য, ধর্মনিষ্ঠা, সংযম, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং আল্লাহ্‌র নির্দেশ মানার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা তৈরী করা। তবে সবকিছুরই মর্মকথা হলো - ‘মনুষ্যত্বের উদ্বোধন’।  আল্লাহ্‌ তায়ালা পশুর রক্ত কিংবা গোশতের মুখাপেক্ষী নন, তিনি পরার্থে প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার শিক্ষা দেন। ধর্ম মানবতার জন্য, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের জন্য নয়। তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহর পথে অর্থাৎ মানবতার সেবায়, প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গের জন্য সদা প্রস্তুত থাকা। তাকওয়া হচ্ছে - প্রশুপ্রবৃত্তির উপর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিষ্ঠা। তাকওয়া হচ্ছে পাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করা। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে যাবতীয় অপরাধ, অন্যায় ও আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ, কথা ও চিন্তা থেকে নিজেকে রক্ষা করার নাম তাকওয়া। পাহাড়ের দুই ধারে কাঁটাবন, মাঝখানে সরু পথ, এমতাবস্থায় সাবধানে পথ অতিক্রম করতে হবে শরীরে যেন কাঁটা না লাগে, এই সাবধনতাই তাকাওয়া। তাকওয়া ব্যতীত যে কোন মানবিক কর্ম নিজ স্বার্থে পশুপ্রবৃত্তিকে চরিচার্থ করবার জন্য পরিচালিত হয়। আজকের পাপ পঙ্কিলতাপূর্ণ পৃথিবী যেখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে পাপাচার, অনাচার, সত্যকে আবৃত রাখার প্রবণতা (কুফর), যেখানে অক্টোপাসের মত ছড়িয়ে আছে দুর্নীতি, ঘুষ আর সুদের কাঁটা সেখানে একজন আল্লাহপ্রেমিককে অতি সাবধানে হাঁটতে জীবন চলার পথে। এই সাবধানতার নাম - তাকওয়া।

তাকওয়া ব্যতীত যে কোন মানবিক কর্ম নিজ স্বার্থে পশুপ্রবৃত্তিকে চরিচার্থ করবার জন্য পরিচালিত হয়। তাকওয়া যাবতীয় কল্যাণের মূল উৎস। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র, আরব-অনারব, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ভিত্তিতে মানুষের মূল্যায়ন হবে না। মূল্যায়নের ভিত্তি কী হবে তা তিনি নিজেই বলেছেন.. “নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে যারা তাকওয়ার অধিকারী তারাই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত।” (কুরআন  ৪৯: ১৩) তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি সৎকর্মপরায়ণ সেই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান। তাকওয়া ব্যতীত শান্তি পাওয়া যায় না। তাই কুরআনে যেখানেই শান্তির আলোচনা করা হয়েছে, সেখানেই তাকওয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি একদিকে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন অন্যদিকে সমস্ত অনাচার, অত্যাচার ও পাশবিকতার বিরুদ্ধে হয়ে ওঠেন আত্মত্যাগী যোদ্ধা। তাকওয়াই সমাজে মানবতাবোধ, নীতিবোধ ও মূল্যবোধ নামে পরিচিত। উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যিনি তাকওয়া অবলম্বন করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক তথা সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করেন তিনিই কুরআনের ভাষায় মুত্তাকী নামে পরিচিত।

আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের জবেহ কবুল করেন, অর্থাৎ মুত্তাকী হতে হলে যে কামনা-বাসনা, প্রবৃত্তির অবাঞ্চিত চাহিদা ও ব্যক্তিস্বার্থ জবেহ করতে হয় তা-ই তিনি কবুল করেন।

কুরআনের সাফ কথা - মুত্তাকী ব্যতীত অন্যদের পশু জবেহ নিছক উদর পূর্তির উদ্দেশে পশু বলি। কুরআন তাকওয়া অর্জনের নির্দেশে পরিপূর্ণ। স্থানে স্থানে একটু পরপরই তাকওয়ার নির্দেশ এসেছে। কোনো নির্দেশ বা বিধান জারি করার পূর্বে বা পরে তাকওয়া অর্জনের নির্দেশনা কুরআনের নীতি। কারণ তাকওয়াই হচ্ছে সেই বস্তু, যা মানুষকে আল্লাহ তাআলার হুকুম মেনে চলতে উৎসাহিত করে। মানুষ পার্থিক জগতে নিষিদ্ধ কর্ম থেকে বিরত থাকে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ভয়ে। আইন-আদালত ও শাস্তির ভয় না থাকলে মানুষ আইনের শাসন মানে না। কিন্তু একান্ত নির্জনে এবং নিশুতি রাতের অন্ধকারেও সত্য ও ন্যায়ের প্রতি যে ভালবাসা মানুষের অন্তরে অতন্দ্র  প্রহরীর মতো কাজ করে তা  হলো তাকওয়া। যিনি সর্বদা এই ধারণায় জাগ্রত থাকেন যে, ‘আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখছেন’- তিনিই তাকওয়া অর্জনকারী।

পর্ববেক্ষক ক্যামেরায় আওতায় মানুষ অপরাধ করে না। আধুনিক সমাজে নিরাপত্তা রক্ষায় বা অপরাধ দমনে কোন সিকিউরিটি গার্ড বা পুলিশ বাহিনীর প্রয়োজন হয় না। সিসি টিভিই যথেষ্ট। সিসি টিভির আওতায় প্রবেশ করলে সতর্ক করে দেওয়া হয় - ‘আপনাকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে’। অর্থাৎ গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে প্রত্যেকের প্রতিটি কর্ম লক্ষ্য রাখা হচ্ছে, রেকর্ড রাখা হচ্ছে, ফলে ব্যক্তি সতর্ক হয় এবং এমন কোনো কাজ করে না যা বিধানের পরিপন্থী। বিধান পরিপন্থী কোন কাজ করলেই তাকে তার কর্মের রেকর্ড দেখানো হবে এবং বিধি মোতাবেক শাস্তিও তাকে ভোগ করতে হবে। সিসি টিভির মাধ্যমে যেভাবে কর্তৃপক্ষ মানুষকে পর্যবেক্ষণে রাখেন ঠিক সেভাবেই আল্লাহ তায়ালা সব সময় আমাকে দেখছেন, আমরা যে যা করছি, সব তিনি জানেন - চেতনার এই জাগ্রত অবস্থা হলো তাকওয়া। যার মধ্যে এই চেতনার জাগরণ ঘটেছে তিনি কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করবেন না, কারো হক নষ্ট করবেন না। আল্লাহ তায়ালার কোনো বিধান তিনি লঙ্ঘন করবেন না। কেবল এই একটি জিনিসই মানুষকে সকল অন্যায়-অপরাধ, পাপাচার ও সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত রাখতে পারে। তাই বায়জীদ বোস্তামী বলেছিলেন - ‘প্রতিমার সামনে জাগ্রত চিত্ত পূজারী, কাবার ভেতরে ঘুমন্ত মুসলমানের চেয়ে উত্তম।’ কোন অনারবের ওপর কোন আরবের ও কোন আরবের ওপর কোন অনারবের কোন কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের ও কোন শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই তাকওয়া ব্যতীত। জাত পাত কিচ্ছু না। কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয় মানুষের মর্যাদা।

পশুর রক্ত-মাংস নয় কীভাবে তাকওয়া অর্জন করা যাবে এটাই গুরুত্বপূর্ব প্রশ্ন। আল্লাহ বলেন - “ইয়া আইয়্যুহাল লাযীনা আমানুত্তাকুল্লা-হা ওয়াবতাগূ ইলাইহিল ওয়াছীলাতা ওয়া জ্বা-হিদূ ফী ছাবিলিহী লা’আল্লাকুম তুফলিহূন।” অর্থ - ‘হে আমানুগণ! আল্লাহকে ভয় কর। তাঁর সান্নিধ্য লাভের উপায় অন্বেষণ কর এবং তাঁর রাস্তায় চরম প্রচেষ্টা কর যাতে তামরা সফলকাম হতে পার।’ (কুরআন ৫ : ৩৫)। আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দানের পাশাপাশি তা অর্জনের দু’টি পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। প্রথমটি হল, আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জনের জন্য ‘ওসীলা’ বা উপায় অন্বেষণ করা। অর্থাৎ, এমন একজন ব্যক্তির সাহচর্য গ্রহণ করা, যিনি তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত। এটি তাকওয়া অর্জনের সবচেয়ে সহজ ও সবচেয়ে ফলপ্রসূ পন্থা। মানব জীবনে সোহবত বা সাহচর্যের গভীর প্রভাব রয়েছে। সাহচর্যে মানুষের কর্ম ও চিন্তায়, চরিত্র ও নৈতিকতায় পরিবর্তন আসে। সাহচর্যের মাধ্যমেই জীবন থেকে জীবনে প্রবাহিত হয় ধর্ম। সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় নবী (সা.) এঁর সাহচর্যে ছিলেন। সাহাবীদের সাহচর্য লাভ করেছেন তাবেঈগণ। তাবেঈনগণের সাহচর্য লাভ করেছেন তাবে তাবেঈনগণ। ধার্মিকের সাহচর্যেই মানুষের মাঝে ধর্মবোধের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় ধার্মিকের সামান্য সাহচর্য মানুষের জীবনের গতিধারা পাল্টে দেয়। রসুল (সা.) এঁর জীবনে রয়েছে এমন অসংখ্য নজির। কুরআনের নির্দেশ - “হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাহচর্যে থাকো” (কুরআন ৯ : ১১৯)? কথিত আছে - ‘ধার্মিকের সামান্য সময়ের সাহচর্য একশত বছরের একনিষ্ঠ ইবাদতের চেয়েও উত্তম!’ যারা মনে করে যে, শুধু বই পড়লেই ধার্মিক হওয়া যায়, তারা আছে মারাত্মক বিভ্রান্তিতে।

ধর্মের দীক্ষা পেতে হলে ধার্মিকের সাহচর্যে আসতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই। মানুষ তার নিজের রোগ নিজে চিহ্নিত করতে পারে না। তাকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেই হয়। যেমন ‘মিথ্যাকথন’ একটি রোগ। মিথ্যাকথন হারাম। এতে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু কোনো মিথ্যুক ব্যক্তিই স্বীকার করে না যে, সে মিথ্যাবাদী। মিথ্যাকথন রোগ চিহ্নিত করে এর চিকিৎসা কে করবে? এজন্য প্রয়োজন সাহচর্যের, গুরুর। সুরা আল ইমরানের  ১০২ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে যেভাবে ভয় করা উচিত তাকে তোমরা ঠিক সেভাবে ভয় করতে থাক এবং মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ এখানে মুসলমান অর্থ হলো আত্মসমর্পণ করা। গুরুর কাছে আত্মসমর্পণ না করে কেউ মুসলমান হতে পারে না। গুরুর সাহচর্যে না এসে কেউ ধার্মিক হতে পারে না। যে ধার্মিক নয় তার তাকওয়া নেই। যার তাকওয়া নেই সে কোরবানির নামে পশু হত্যা করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন