সত্যপক্ষ সরকার
চায় জাতি
শাহ্
আব্দুল বাতেন ॥ স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ শক্তির মাঝে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক
সরকার ইস্যুতে সমঝোতা নাটকের সূচনা হল গত ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে। আগামী দশম জাতীয়
সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে এই সমঝোতা নাটকের মধ্যেই
আবারও বেসামাল হয়ে উঠছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। এই সার্বিক অবস্থার শিরোনাম হতে পারে
‘একের ভিতরে তিন’। যেমনঃ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, রাষ্ট্রীয়
ক্ষমতা, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা। যা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বাইরে দেশব্যাপী সংঘাত সহিংসতা
সৃষ্টির এক অনিবার্য কারণ। বিশেষ করে ক্ষমতার নিত্য নেশায় মত্ত রাজনীতিকদের মধ্যে পারস্পারিক
অনভিপ্রেত দ্বন্দ্ব অবিশ্বাস ও রুক্ষ-রুগ্ন রাজনীতির পরিণতি, দেশের কি পরিমাণ জান মাল
বিনষ্টের মধ্য দিয়ে শেষ হবে - তা বলা মুশকিল। প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে বলা যেতে পারে,
দেশপ্রেম বিবর্জিত জাতীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস অবিশ্বাস, পক্ষ-বিপক্ষ-নিরপেক্ষ ইত্যাদির
ধুম্রজাল থেকে অসহায় সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যে আর কোন শান্তিপূর্ণ নিরাপদ পথের সন্ধান
মিলছে না। কারণ জোটগতভাবে দেশের রাজনীতি আজ দুই ভাগে বিভক্ত। ফলে পূর্বাপর জোট সরকারগুলোর
মেয়াদজুড়ে সরকার ও বিরোধী জোটের মধ্যে দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গঠনমূলক চিন্তা ও কর্ম
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোন প্রকার সম্মিলিত উদ্যোগ বিগত বছরগুলোতে পরিলক্ষিত হয়নি। বিরোধী
জোটের মাঝে মধ্যে সংসদে যাওয়া এবং উভয় জোট সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত বিভিন্ন স্থায়ী কমিটিগুলোতে
কালে-ভাদ্রে
তাদের
উপস্থিতিটুকু ছিল পদ-পদবী, ব্যবসা বাণিজ্য, স্বাস্থ্য-সেবা, বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদি রাষ্ট্রীয়
সুযোগ সুবিধা ভোগের নেশায়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং খাজনা-ট্যাক্সের অর্থে পরিপুষ্ট
এসব সাংসদের নৈতিকতাহীন ভূমিকা, দেশবাসীর জন্য অনেক বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়। এই দুর্ভাগ্য
থেকে মুক্তির পথ আর কত দূর, কোন বিবেকবান মহলের চিন্তা সীমানায় তা স্থির করতে পারছেন
কিনা জানা নেই।
মেয়াদের
শেষপ্রান্তে বর্তমান মহাজোট সরকার, সাংবিধানিক পন্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচন করার অঙ্গীকারে
অনড়। ১৮ দলীয় বিরোধী জোট নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক কিংবা যে কোন নামের এমন একটি
সরকারের অধীনে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীতে অনড় থেকে ইতোমধ্যে দীর্ঘমেয়াদী হরতাল-অবরোধসহ
নানা কর্মসূচী প্রদান ও হুমকি প্রদানে রত। ফলে দেশের অস্থির অবস্থা দিন দিন আরো অস্থির
হচ্ছে। সময়ের কাঠগড়ায় দেশ জনতার জানমালের ক্ষয়ক্ষতির ফর্দ আরো দীর্ঘ হচ্ছে। নির্দলীয়
নিরপেক্ষ নামক এই মিশ্র ধারণাটি ভবিষ্যত বাংলাদেশ ও প্রজন্মকে ভ্রান্ত পথের বন্ধুরতার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে।
এবার
প্রশ্ন হল, নিরপেক্ষতা কি এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তি কে বা কারা? আমরা জানি, বিচারিক আদালতে
বাদী-বিবাদী তথা প্রথম পক্ষ ও দ্বিতীয় পক্ষ নামে পক্ষদ্বয়ের যথার্থ প্রয়োগ রয়েছে। ধারণা
করা হয়ে থাকে, এই দুই পক্ষের মাঝখানে মাননীয় আদালত নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষ শব্দটির অর্থ
বুঝায় কোন প্রকার পক্ষপাতহীনতা। তাহলে মাননীয় আদালত কি কোন প্রকার পক্ষবিহীন? - প্রশ্নই
ওঠে না। কারণ মাননীয় আদালতের একটি কঠিন পক্ষ আছে। সেটি হল সত্যপক্ষ। সত্য পক্ষে অবস্থান
করেই মাননীয় আদালত বাদী-বিবাদী পক্ষের মাঝে বিরাজিত বিরোধ বিপত্তির কবল থেকে সত্যকে
উদ্ঘাটন করে রায় দিয়ে থাকেন। এখানে নিরপেক্ষ বা পক্ষপাতহীন কোন চরিত্রগত ভূমিকা নেই।
কারণ পক্ষপাতহীন কোন চরিত্র ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বা সত্য-মিথ্যার রহস্য বা মিশ্রনকে
পৃথকিকরণে সক্ষম নয়। ১৯৯৬ সালে বর্তমান বিরোধী দলীয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়,
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক (তৎকালনি বিরোধী দলীয় নেত্রী) নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক
সরকার প্রবর্তনের দাবীকে পাগল ছাগল দিয়ে বুঝিয়েছিলেন। বর্তমান অবস্থায় এমন বক্তব্যের
পুনরাবৃত্তি না ঘটলেও ইতিহাস সময়ের ভাষায়ই কথা বলে।
উল্লিখিত
মত বিস্তার শেষে আরেকটি ছোট অধ্যায়ে অনুপ্রবেশ করতে চাই। যেমন - জগতে ফেরেস্তারাও একটি
পক্ষ অবলম্বনকারী দল। কেননা ফেরেস্তাগন স্রষ্টার আজ্ঞা বহনকারী। আর স্রষ্টা স্বয়ং মহাসত্য
তথা সত্যপক্ষ। স্রষ্টা কারো উপর নির্ভরশীল কিংবা মুখাপেক্ষী নন। স্রষ্টা স্বাধীন। আর
স্রষ্টার অনুশীলন, অনুকরণকারীও স্বাধীন। পাশাপাশি স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে তাঁর আদেশ,
উপদেশ, নিষেধ অমান্যকারীরা সন্দেহভাজন, স্বার্থান্বেষী, অন্যায় অসৎ ও মিথ্যাচার অবলম্বনকারী
পক্ষ। তাহলে এই দু’পক্ষের মধ্যে মানুষ মানুষের মাঝে নিরপেক্ষ
মানুষ খুঁজে কোথায়? শাশ্বত রীতি অনুযায়ী এই দু’পক্ষের বাইরে কোন মানুষ থাকতে পারে কি?
এ প্রেক্ষিতে স্বভাবতই কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, তাহলে ‘নিরপেক্ষ’ শব্দটির উৎস
কোথায়? একেবারে সহজ সরল ভাষায় বলতে গেলে, সমাজের
চিন্তাশূন্য স্বার্থান্বেষী পক্ষপাতদুষ্ট একশ্রেণীর মানুষই ‘নিরপেক্ষ’ শব্দটির প্রবর্তক
বলে বোধ করি। এই অজ্ঞতাগ্রস্ত অদূরদর্শী-চিন্তাশীল শ্রেণীটাই দেশ সমাজ ও রাষ্ট্রের
অবাধ উন্নয়ন অগ্রগতির পথে সব সময়ই পর্যাক্রম অন্তরায়।
সত্য
তথা ন্যায়নীতির পৃষ্ঠে আঘাত করে অপরাধী অপরাধ করে ব্যক্তি দল বা গোষ্ঠীস্বার্থের জন্য,
আর বিচারক বিচার করেন তাঁর সত্য ও ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করে। এখানে নিরপেক্ষ একটি অলীক
ধারণা। আর এই ভ্রান্ত ধারণার উপর ভর করে বরাবরই একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনপূর্ব
কোন ধ্বংসাত্মক চিত্র জাতির জন্য কাঙ্খিত নয়। জাতীয় নির্বাচন সমাগত হলেই বিরোধী দলগুলোর
পক্ষ থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন করার শোরগোল এবং হুমকির
চোটে গোটা দেশ অস্থির-অশান্ত ও বিস্তর ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি
তারই এক ধারাবাহিক অনাকাঙ্খিত রূপ। যে রূপের বিষাক্ত ছোবলে ইতোমধ্যে অনেক জানমালের
ক্ষতি হয়ে গেছে। এই ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি, গণতন্ত্র ও মানবতা বান্ধব নয়। এই পরিস্থিতি
থেকে জাতির পরিত্রাণ আশু প্রয়োজন। বলাবাহুল্য যে, সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই জাতির প্রতিনিধিত্বকারী।
ফলে জাতির এই আশু প্রয়োজনীয়তাকে মর্যাদার আসনে স্থান দিতে হলে, উভয় জোটকেই ধ্বংসাত্মক
কার্যকলাপ, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, মিথ্যাচার ও আক্রমণাত্মক বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে বেরিয়ে
এসে একেবারে খোলা মনে বিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়াতে হবে। একইসঙ্গে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ
জনগণের আস্থা অর্জনে নির্বাচনপূর্ব শোভন আচরণ, গণমুখী কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে
এবং এই বিশ্বাসের জায়গা থেকে যৌথ আন্তরিক প্রচেষ্টায় দক্ষ প্রশাসন, শক্তিশালী নির্বাচন
কমিশন, দূরদর্শী দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক দল গঠন ও আনয়নের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন
করতে হবে। এক্ষেত্রে যে কোন ধরনের সরকার পদ্ধতি বা সরকার প্রধানই থাক না কেন নির্বাচন
সুষ্ঠু সুন্দর ও জনকল্যাণমুখী হতে বাধ্য। এখানে নিরপেক্ষ নামের সরকার প্রধান বা সরকার
গঠনের প্রতিযোগিতায় থেকে শুধু সময় সম্পদ নষ্ট করা যাবে - কিন্তু গণমুখী রাজনীতি দেশপ্রেম
ও নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে শান্তি শৃঙ্খলার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে না। এর বাইরের
রাজনীতি যারা অব্যাহত রাখতে চান, তারা শুধু রাজনীতিক বা রাজনীতিজীবী হতে পারেন। কিন্তু
রাজনীতিবিদ হতে পারেন না। মনে রাখা আবশ্যক যে, সত্যের সাথে মিথ্যার আপোষ বা সমঝোতা
হতে পারে না। তৈল যেমন পানির সাথে মিশে না, তেমনি সত্যও মিথ্যার সাথে মিশে যেতে পারে
না। স্বাধীনতা উত্তর ৪২ বছর ধরে স্বাধীনতার স্বপক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির মধ্যে এমন ধারাই
প্রবাহিত হয়ে আসছে। অতএব এমন একটি অনৈতিক কাজ কেউ যদি করে বা করাতে চায়, তাহলে ‘সত্য’ মিথ্যার কালিমায়
কলংকিত হয়েই থাকবে। দেশবাসী আর আত্মপ্রবঞ্চনাময় রাজনীতির স্রোতে ভাসতে চায় না, চায়
দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে সত্য প্রতিষ্ঠিত হোক। আর এজন্য দরকার একটি সত্যপক্ষ সরকার, কমিশন বা প্রতিষ্ঠান যারা সত্যনির্বাচন
নিশ্চিত করবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন