বৃহস্পতিবার, ১১ জুন, ২০১৫

জাতি চায় প্রতিবেশী দেশের সাথে নিবিড় সম্পর্ক


জাতি চায় প্রতিবেশী দেশের সাথে নিবিড় সম্পর্ক

সংলাপ ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় সাম্প্রতিক ঝটিকা সফর এবং এসময় সম্পাদিত চুক্তিসমূহ সাম্প্রতিককালে দেশের কুটনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট তাৎপর্যবহ ঘটনা। যে কোন বিপদ ও সমস্যায় প্রতিবেশীই একজন মানুষের প্রথম ভরসা ও আশ্রয়স্থল। স্বাধীনতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের সবাই না হোক, একটি বিশেষ শ্রেণী আজ যে পার্থিব উন্নতি লাভ করেছে তা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? কিন্তু দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, স্বাধীনতার সুফল সবার ঘরে উঠেনি এবং ১৯৭৫ সালের পর ভারতের সাথে আমাদের দেশের ভুল বোঝাবুঝির কারণে এ দু’দেশ ও তার জনগণের মধ্যে দুরত্ব তৈরি হয়। কিন্তু এ দুরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝিকে কাজে লাগিয়েছে দু’দেশের কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। বিভিন্ন সময়ে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে চোরাচালানী তৎপরতা যার মাধ্যমে দু’দেশেই পাচার হয়েছে নিষিদ্ধ ও অবৈধ পণ্য ও অস্ত্র। দাগী আসামী, খুনী চক্র একদেশে যাবতীয় অপরাধ ও অপকর্ম করে অপর দেশে গিয়ে আস্তানা গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে। অর্থাৎ, দু’দেশের অশুভ চক্রের মধ্যে  সংযোগ যেভাবে হয়েছে, সাধারণ জনগণ ও শুভ-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের মধ্যে যোগাযোগ সেভাবে গড়ে উঠেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণ এশিয়ার এ দু’টি দেশের বিশেষ করে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভারতের কয়েকটি রাজ্যের বিশাল জনগোষ্ঠি আজও পিছিয়ে আছে নানা দিক দিয়ে। দু’দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার দীর্ঘদিন পরে হলেও এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছে শান্তিকামী মানুষদের কাছে এটাই আজ সবচেয়ে আনন্দ ও স্বস্তির খবর। গত শনিবার ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দু’টি রুটে বাস সার্ভিসের উদ্বোধন হলো। কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা এবং ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি রুটে এই বাস চলবে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসময় উপস্থিত ছিলেন।  এসময় দু্‌ই প্রধানমন্ত্রী ও মমতা বাসে ওঠেন। উদ্বোধনের পর তিনটে বাসের একটি শিলং, একটি কলকাতা ও অপরটি আগতলার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের পরিবহন দপ্তরের সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা এসময় উপস্থিত ছিলেন। দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে শীর্ষ বৈঠকে সামরিক উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। এদিকে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের পর ২২ টি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।  শেখ হাসিনা বলেন, ‘উপকূলীয় নৌ-চলাচল চুক্তি, অভ্যন্তরীণ নৌ-ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রটোকল স্বাক্ষর এবং এর সঙ্গে নতুন বাস সার্ভিস উদ্বোধন এই অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ প্রতিষ্ঠা করবে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দু’দেশ ‘জিরো টলারেন্স্থ নীতিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দু্‌ই দেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ও আলোচনা হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ একটা বড় সমস্যা। বিদ্যুৎ সমস্যা মেটাতে রিলায়েন্স পাওয়ার বাংলাদেশে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করতে চলেছে।  ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মাননীয় প্রধানন্ত্রী, আপনার সফর আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন আশা ও গতির সঞ্চার করেছে।
ঔপনিবেশিক শক্তি বাংলাকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করলেও আত্মিক ও সাংস্কৃতিভাবে ভাগ করতে পারেনি। একদিকে গঙ্গা, অন্যদিকে পদ্মারতীরের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, রুচি, খাদ্যাভ্যাস, প্রায় অভিন্ন। ১লা বৈশাখে, ঈদ, কিংবা দুর্গোৎসবে দু’দেশের মানুষ কাঁটাতারের বেড়া ডেঙ্গিয়ে আজও স্বজনদের কাছে ছুটে যায়। সেনাবাহিনীর বাধা পেলে কাঁটাতারের ভিতর থেকে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায়। এই আবেগ ও ভালোবাসা কোনও কিছুতেই রুদ্ধ করা যায় না। মোদির ঢাকা সফর অতীতের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন পিছনে ফেলে সময়ের দাবি মেটাতে সক্ষম হবে বলে বাংলাদেশের প্রত্যাশা। সেই সুরই দিনভর শোনা গেল গোটা ঢাকা শহর জুড়ে।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ ফ্লাইট ‘রাজদূত’ গত শনিবার সকাল ১০টা ১০ মিনিট নাগাদ ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানের সামনে দু’পাশে উড়ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় পতাকা। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও ছাইরঙা ওয়েষ্ট কোট পরা মোদি বিমান থেকে বেরিয়ে এসে হাত নাড়েন, নমস্কার জানান। বিমানের সিঁড়ি থেকে নেমে লাল গালিচায় পা রাখেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। লাল গালিচায় অপেক্ষা করছিলেন বাংলাদেশের প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফুল দিয়ে মোদিকে বরণ করা হয়। ১৯ বার তোপধ্বনি হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্মানে। লাল শাড়ি পড়া একটি শিশু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন শুভেচ্ছার ফুল। শিশুটিকে আদর করে তার সঙ্গে কথাও বলেন মোদি। তিনি নাম জানতে চাইলে শিশুটি জানায়, তার নাম কাজি কার্পিতা হোসেন। পড়ে প্রথম শ্রেণিতে। এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হয় গার্ড অব অনার। বেজে ওঠে দুই দেশের জাতীয় সংগীত। গার্ড পরিদর্শনের পর শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভার সদস্যসহ শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে মোদির পরিচয় করিয়ে দেন। পরে মোদি তার সফরসঙ্গীদের সঙ্গে শেখ হাসিনাকে পরিচয় করিয়ে দেন। বিমান বন্দরে এই সময় উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরি, পররাষ্টমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহম্মদ নাসিম, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভি ও মসিউর রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। তিন বাহিনীর প্রধানসহ সামরিক ও অসামরিক উচ্চপদস্থ কর্তারাও ছিলেন বিমান বন্দরে। উপস্থিত ছিলেন হাইকমিশনার পঙ্কজ সরণসহ ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারাও।
দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে মোদি প্রথমবার বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদির এই সফর ‘ঐতিহাসিক’। মোদির সফর ঘিরে অভূতপূর্ব নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছিল গোটা ঢাকা শহরকে। আকাশপথে নজরদারি চালাতে দিনভর চক্কর দিয়েছে হেলিকপ্টার।
বিমানবন্দরে আনুষ্ঠিকতা শেষে ‘৭১-এর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান মোদি। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানান গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী একে এম মোজাম্মেল হক, সাভারের সংসদ সদস্য এনামুর রহমান। সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিঁঞা ও পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানও সেখানে ছিলেন। ১১টা ২৫ মিনিটে নরেন্দ্র মোদি শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। শহীদ বেদির সামনে এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। ফুল দিতে স্মৃতি সৌধের পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষরের পর মোদি বৃক্ষরোপণ এলাকায় একটি ‘উদয়পদ্ম’ গাছের চারা রোপণ করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে মোদিবহর ঢাকার ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের উদ্দেশে রওনা হয়। বেলা ১২ টা ০৫ মিনিটে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে পৌঁছালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর বহমান স্মৃতি ট্রাস্টের সদস্য সচিব ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। পরে জাদুঘরের বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে দেখেন এবং পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পরিদর্শনের পর মোদি এক ট্যুইটে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, গণতন্ত্রের প্রতিমূর্তি, এক বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং ভারতের এক মহান বন্ধুকে শ্রদ্ধা।’
দিনের প্রথম ভাগের কর্মব্যস্ত সময় পার করার পর বেলা ১টা নাগাদ হোটেল সোনারগাঁওয়ে যান মোদি। সেখানে বিশ্রাম এবং মধ্যাহ্নভোজ শেষে ৩টে নাগাদ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর হোটেল সোনারগাঁওয়ের সুরমা হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে দিনের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে শীর্ষ বৈঠক করেন মোদি। তার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিস ও কলকাতা -ঢাকা-আগরতলা বাস পরিষেবার উদ্বোধন করেন।
দুই প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী একান্তে কথা বলেন। তাঁদের আলোচনা শেষে সীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থনের দলিল বিনিময় হয়। পরে দুই প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। আনুষ্ঠানিক আলোচনার পর বিভিন্ন প্রকল্পের ফলক উন্মোচন শেষে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চুক্তি, সমঝোতা স্মারক, প্রোটোকল ও সম্মতপত্র সই হয়।
খুলনা-মংলা রেললাইন, শিলিগুড়ির রবীন্দ্র ভবন, ফেনী নদীর উপরে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১. কুলাউড়া-শাহজিবাজার রেলপথ, সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমিতে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ভবনের ফলক উন্মোচন করেন মোদি। এছাড়া বিএসটিআইয়ের আধুনিকীকরণ করা ল্যাবরেটরি ও ব্রাক্ষণবাড়িয়া-ত্রিপুরা সীমান্ত হাটের উদ্বোধন করেন মোদি-হাসিনা। রাতে হোটেল সোনারগাঁওয়ে তাঁর সম্মানে শেখ হাসিনার দেয়া নৈশভোজে যোগ দেন নরেন্দ্র মোদি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মমতাও।
ঢাকা সফরে রামকৃষ্ণ মিশন ও ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রামকৃষ্ণ মিশনে মোদি আসছেন, এই খবর পৌঁছাতেই বেলুড় মঠ এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সাধারণ সম্পাদক স্বামী সুহিতানন্দ ঢাকায় এসেছেন। মোদির আগে সুষমা স্বরাজও ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে পুজো দেন। তবে, এই প্রথম ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী এই মন্দিরে পা রাখছেন। কথিত আছে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নাম থেকেই ঢাকার নাম হয়। রবিবার সকালে মন্দিরে পুজো দিয়েছেন। এরপর তিনি বারিধারায় ভারতীয় হাই কমিশনের নতুন চ্যান্সেরির উদ্বোধন করেছেন। দুপুরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে তার সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে অটল বিহারী বাজপেয়ির পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্মাননা গ্রহণ করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী।
কূটনৈতিক দৌরাত্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্যমকে দরাজ কন্ঠে সমর্থন করল আমেরিকা। শুধু সমর্থনই নয়, তাঁর বিদেশ সফরে তিনি যে কুটনৈতিক সাফল্যও পেয়েছেন, তাও মনে করেন আমেরিকার শীর্ষ কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ রিচার্ড রাহুল ভার্মা। তিনি এখন ভারতে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত। ওয়াশিংটনে সেন্টার ফর ষ্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’-এর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, কূটনৈতিক পর্যায়ে মোদির প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাঁর এই উদ্যম ভারতকে বিশ্ব-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসাবে ক্রমশ তুলে ধরার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেই সঙ্গে ভারত তার বৈদেশিক নীতি-নির্ধারণে গতি পেয়েছে। আমরা (আমেরিকা) বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতির আঙ্গিনায় ভারতের নেতৃত্ব দেওয়ার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের নতুন বাতাবরণ তৈরি নিয়েও মোদির উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ভার্মা।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়নে মোদির উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন ভার্মা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়নে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সফলভাবেই হেঁটেছেন। ভারতের প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভুটানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। নেপালের ভূমিকম্পে ভারত যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
মোদির  মার্কিন সফরকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন ভার্মা। তিনি বলেছেন, গত জানুয়ারি মাসে ওবামা-মোদি বৈঠকে আমরা ৭৭টি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রকে বাছাই করেছি। যেগুলোকে কেন্দ্র করে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক আবর্তিত হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সৌরশক্তি। ভারত উপ-মহাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়া কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে ইন্দো-মার্কিন যৌথ নীতি নির্ধারণেও একটা রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি বলেছিলেন, ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক শুধু একে অপরের জন্য নয়। গোটা বিশ্বের জন্য আমাদের কাজ কতে হবে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত সেই প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, বিশ্বের দু’টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিশ্বের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যেই কাজ করবে।
বাংলাদেশের বিকাশের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়িত করতে ভারত আপনাদের সঙ্গে রয়েছে, পাশেও রয়েছে। ভারতের মতোই উন্নতি ঘটুক সোনার বাংলার। গত রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই আবেগ-ভাষণ মন জয় করে নিল বাংলাদেশের মানুষের।  বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকক্ষে উপস্থিত কয়েক হাজার পড়ুয়া, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদের সামনে তাঁর আবেগঘন বক্তৃতায় উঠে এসেছে প্রতিবেশী এই দেশের সন্ত্রাসবাদ রোধ, শিশু ও নারীশিক্ষা, শিল্পে এগিয়ে চলার কাহিনী। কুর্নিশ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসকে। বলেছেন, একজন মহিলা যেভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, তা দেখে সত্যিই অভিভূত। দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে ভারত যে সবসময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে থাকবে, তাও জানিয়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। বললেন, প্রতিবেশীদের মধ্যে একজন দুর্বল হলে আরেকজন উন্নতি করতে পারে না। ভারত-বাংলাদেশকে উন্নতি করতে একে অপরের পরিপূরক হতে হবে। গরিবের উন্নয়নে, দরিদ্রদের ঘরে বিদ্যুৎ দিতে বাংলাদেশকে সাহায্য করবে ভারত। স্থল সীমান্ত চুক্তির প্রসঙ্গ তুলে এনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া এবং বাংলাদেশের বিশিষ্টদের বললেন, যাওয়ার সময় হলো। কিন্তু মনে হচ্ছে এই সবে যাত্রা শুরু হলো। উন্নয়নের লক্ষ্যে একসঙ্গে অনেক পথ চলতে হবে। ফেরার পর অনেক কাটাছেঁড়া হবে কী পেলাম, কী হারালাম তা নিয়ে। কিন্তু দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে হবে আমরা পাশাপাশি আছি, আবার একসঙ্গেও আছি। বাংলাদেশের জন্য আমার আবেগ রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে জনসমর্থন বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে ভারত জুড়ে যখন প্রচার চলছে তখন জনসমর্থন আরও বাড়াতে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে আমার রাজনীতিতে প্রবেশ। মোদি বলেন, বাংলাদেশকে যত দেখি গর্ব হয়। নানান প্রতিকূলতা, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেও এগিয়ে চলেছে। মোদি বলেন, চীনে গিয়ে শুনলাম বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্পে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। শুনে প্রতিবেশী হিসেবে গর্বিত হয়েছিলাম। পড়শি উন্নতি করলে কার না ভাল লাগে। প্রতিবেশীর উন্নতির আলো তো ভারতেও পড়বে। বাংলাদেশের যত বিকাশ হবে, আমরাও ততো বিকশিত হবো। শিশু ও নারী শিক্ষা, শিল্প, জঙ্গিদমনে বাংলাদেশ এগিয়েই চলেছে। এদেশের আতিথেয়তা মুগ্ধ করেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই তো সেদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে আসার আগে আমায় বললেন, যান না, গিয়ে দেখবেন সেখানকার মানুষ কেমন আবগপ্রবণ। ওখানকার মানুষের আতিথেয়তা ভোলার নয়। যাওয়ার আগে বলে যাচ্ছি, ফের আসব। তারপরই সকলকে অবাক করে দিয়ে মোদি কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা উদ্ধৃত করে খাঁটি বাংলায় বলে ওঠেন - ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়’।
বাংলাদেশকে পাশে চাই। আবার আমাদের রাজ্যগুলোকে নিয়েও চলতে হবে। বাংলাদেশে এসেছি, তিস্তা প্রসঙ্গ আসবে, এটাই স্বাভাবিক। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রর সমাধান আমরা করেছি। পাখি, হাওয়া, জল - সীমানা দিয়ে আটকানো যায় না। সমাধানের পথ বের করতে হবে। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে। তবেই সমাধান আসবে। দায়িত্ব আমরা পালন করব। সীমান্তে হত্যা মর্মান্তিক। গরিব মানুষ মরে। সীমান্তে হত্যা রুখতে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।
জমির জন্য বহু দেশের মধ্যেই যুদ্ধ হয়। কিন্তু আমরা বিশ্বে পথপ্রদর্শক। মোদি বলেন, স্থলসীমান্ত চুক্তি করে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি জমিকে আমরা সম্পর্কের সেতু হিসেবে ব্যবহার করেছি। কত জমি হারালাম, কী পেলাম সেটা বড় কথা নয়। কিছু জমি গেল সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, সেটাকে আমরা কতটা সম্পর্ক উন্নয়নে কাজে লাগাতে পেরেছি। এক ঘন্টারও বেশি সময় মোদি ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে দিশা দেখান। বলেন, ত্রিপুরার পালাটানায় বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে যেতে বাংলাদেশ তাদের জমি ব্যবহার করতে দিয়েছে। না হলে এই কেন্দ্র তৈরিই হতে পারত না। তাই সেই সহযোগিতায় শরিক হওয়ার জন্য আমরা বাংলাদেশকে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেব। সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান-ভারত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে আমরা সাহায্য করেছিলাম। চাইলেই বাংলাদেশের জমি ব্যবহার করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারতাম। তাদের ৯০ হাজার সৈন্য আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। বিনিময়ে কিছু চাইনি।
নারীশক্তিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। তাদের প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, বিরোধী নেত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য সকলেই মহিলা। ঢাকার রাজপথে দেখলাম বাংলাদেশের জাতীয় দলের ক্রিকেটার সালমা খাতুনের জামায় লেখা বিজ্ঞাপন - মেড ইন বাংলাদেশ। দেখে গর্ব হলো। নারীশক্তির যুগ চলছে বাংলাদেশে।
তারুণ্যের প্রশংসা করলেন নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের মহিলা ক্রিকেট দলের সদস্য সালমা খাতুন, অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, দুই মহিলা এভারেস্ট জয়ী নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজরিনের নাম উল্লেখ করেন বক্তৃতায়। বলেন, আপনাদের মহিলা ক্রিকেটার সালমা খাতুনের ছবি আমি দেখেছি। এটা নারী ক্ষমতায়ন আর তারুণ্যের শক্তির প্রমাণ। বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটাররা দুর্দান্ত খেলেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘গ্রাফ’ টি এদেশের অর্থনীতির উন্নতির একটি ছাপ বলে মনে করেন মোদি। বলেন, ক্রিকেট-বিশ্বে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে অনেক পরে। কিন্তু আজ ভারত-সহ ক্রিকেটে সব বড় দেশ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে আর ছোট দল হিসেবে ভাবার সাহস পায় না। আপনারা অনেক দেরিতে শুরু করেও, এরই মধ্যে বিশ্বে জায়গা করে নিয়েছেন। এটা বাংলাদেশের কৃতিত্ব। মোদি বলেন, নিশাত ও ওয়াসফিয়া দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে এভারেস্টের উচ্চতা ছুঁয়েছে। এটাই এদেশের শক্তি। আর এ নিয়ে আমিও গর্ববোধ করি। দেশ উন্নয়নে তারুণ্যের প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত-বাংলাদেশ এই দু’দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষের গড় বয়স ৩৫ বছরের নিচে। তারুণ্যে টগবগ করছে, এটাই দু’দেশের চরম উন্নতি এবং এগিয়ে যাওয়ার সময়।
কেউ করছে আর জাল নোট নিয়ে দোষ হচ্ছে বাংলাদেশের। এটা হতে দেয়া যায় না। জাল নোট রুখতে তাই বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে একজোট হয়েছে। জঙ্গি-হামলায় কত নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়। ভারতে ৪০ বছর ধরে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। সন্ত্রাসবাদ দমনে ভারত কঠোর হয়েছে। বাংলাদেশও একই অবস্থান নিয়েছে।
‘আমার বাংলাদেশের ভাইবোনেরা সমস্কার। কেমন আছো। আমরা তোমার সাথে আছি। আমরা তোমাকে সঙ্গে নিয়ে চলবো। আমার বাংলা কেমন বলো তো।’ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজিত অনুষ্ঠানে মোদির মুখে বাংলা শুনে উচ্ছ্বসিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। উচ্ছ্বসিত শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানে হাজির বুদ্ধিজীবীরা। তাদের প্রাণের ভাষায় মোদি কথা বলায় উল্লাস বাংলাদেশ জুড়ে। টিভিতে মোদিকে বাংলায় কথা বলতে শুনে আনন্দিত বাংলাদেশের মানুষ। বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির রক্ত ঝরেছে। ভারতীয় সৈন্যরাও রক্ত ঝরিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। সেই সব রক্ত কি আলাদা করা যায়। হাজার হাজার বাঙালি রক্ত ঝরাতে তৈরি ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আমার প্রণাম।
এবার যাওয়ার পালা। কিন্তু বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। কত কিছু দেখা হয়নি। মোদি বলেন, নোয়াখালির গান্ধীজির আশ্রম দেখা হয়নি। যেতে চাই কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহে। খুব ইচ্ছে রয়েছে পরের বার ঢাকায় এসে পদ্মানদীর বুকে নৌকোয় করে ভেসে বেড়ানোর। পদ্মার বুকে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে এখানকার তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা মারবো। জয় বাংলা,  জয় হিন্দ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন