বৃহস্পতিবার, ১১ জুন, ২০১৫

রাজনৈতিক অঙ্গনের হাতিয়ারঃ উন্নয়ন


রাজনৈতিক অঙ্গনের হাতিয়ারঃ উন্নয়ন

সংলাপ ॥ আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ‘উন্নয়ন’ শব্দটা একটা মহৌষধি। স্বাধীনতার পর বাকশাল প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার পর থেকে কোনও সরকারই গরিব মানুষের উন্নয়নে সত্যিকার আন্তরিক প্রয়াস কখনও নেয়নি। যেটুকু করেছে নিজেদের ভোটবাক্সের কথা ভেবে। ফলে, যেখানে যেটুকু উন্নতি হয়েছে তার ফল পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। তাদের মধ্যে অনেকে পেয়েছে প্রয়োজনের অতিরিক্তও। অথচ, যাদের পাওয়ার কথা তারা কিছুই পায়নি। আমাদের এই অসম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উন্নয়নের জলজ্যান্ত প্রমাণ আমাদের গ্রামগুলো। আমাদের গ্রামাঞ্চলে গেলে দেখা যাবে যারা ২০-৩০ বছর আগে খেতে পেত না, তাদের অনেকের এখন আছে একাধিক মটর সাইকেল, বাড়ি, মাছের ভেড়ি, আরো কত কী। কীভাবে হল এই উন্নয়ন? পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তা হয়েছে রাজনৈতিক দলের দয়ায়। ঠিক তার পাশেই খোঁজ করলে পাওয়া যায় হাড় বেরনো মানুষের দল, যেমন ছিল আগে আজও তেমনই আছে অনাহারে অর্ধাহারে। এই যে জঙ্গল আর পাহাড় অশান্ত হচ্ছে আর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে, তার একমাত্র কারণ ক্ষমতাসীন সরকারদের চোখ এড়িয়ে, দলবাজি উন্নয়নের জন্য।নিরপত্তাবাহিনী আর সামরিকবাহিনী দিয়ে চারদিক থেকে ঘিরে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সাময়িক নিয়ন্ত্রণ করতে পারা যায়, কিন্তু খেতে না পাওয়া মানুষগুলোর ক্ষোভ তাতে কমছে না। এই সুযোগে একদিন আবার কেউ কোনও অন্য নামে এসে ওই সব গরীব মানুষের সঙ্গে মিশে টাকার লোভ দেখিয়ে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। যেখানে উন্নয়ন নেই সেখানেই জনতার ক্ষোভ-বিক্ষোভ থেকে জেগে উঠছে গরীব মানুষ।
এই সত্যটা প্রগতিশীল রাজনীতিকরা জানেন না এমন নয়। কিন্তু সত্য জানাকে এবং সত্য প্রতিষ্ঠাকে রাজনীতিকরা কবে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন?
গত চুয়াল্লিশ বছরে প্রত্যেক সরকারের আমলে যে ‘রাজনৈতিক সংরক্ষণের’র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা সংবিধান থেকে সুপ্রিম কোর্ট, কারও সাধ্য নেই সেই সংরক্ষণের প্রাচীর ভেদ করে। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, খেলার মাঠ-জমি দখল, হোটেল-রেস্তোরা, পাড়ার ক্লাব-শ্মশানঘাট-গোরস্থান-সংস্কৃতি-সাহিত্য-সব কিছুকেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ‘রাজনৈতিক সংরক্ষণের’র আওতায় নিয়ে এসেছে। তাই বর্তমান রাজনীতিকরা মানুষকে আর মানুষ ভাবেননা। মনুষ্যত্বের বা মেধার দাবি আর রাজনীতিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল লোকটা কোন দল করে, দল করো সব পাবে, বিরোধী হলে সন্ত্রাসী হবে সোজা হিসাব। বাংলাদেশে সব রাজনৈতিক দল এই মতাদর্শে কমবেশীশামিল। তাই সাধারণ মানুষ মধ্যে যতই ক্ষোভ থাকুক-মুখে চুপ। এই রাজনৈতিক সংরক্ষণের দিকে তাকিয়েই মন্ত্রণালয়ে সচিব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা কলেজের প্রিন্সিপাল নির্বাচিত হন, অফিস-কাছারিতে পদোন্নতি হয়, বিভিন্ন সার্ভিস কমিশনে ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে।
গত চুয়াল্লিশ বছরে এই রাজনৈতিক সংরক্ষণের সুযোগে কত অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কত কিছু করে নিল, তা চোখের সামনেই গ্রাম অঞ্চলের এবং শহরের মধ্যবৃত্ত ও নিম্নশ্রেণীর লোকেরা দেখছে। তবে রাজনীতিকরা যাই করুন, যত ক্ষমতাই ভোগ করুন, সাধারণ মানুষ এদের করুণার চোখে দেখেছে এবং আজও দেখে। কারণ, আত্মমর্যাদা খোয়ানো সেবাদাসদের কেউ কোনওদিন শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারেন না, দেখলে তা তো আত্মঅবমাননারই শামিল। রাজনৈতিক সংরক্ষণের মাধ্যমে সরকারি দয়া নিয়ে যারা কৃতার্থ বোধকরেছেন, তারাও কার্যত আত্মঅবমাননাই করেছেন। বাংলার মাটিতে, যারা এই ধরনের রাজনৈতিক সংরক্ষণ চালু করেছেন, তারা আর যাই হোন বাঙালির শুভচিন্তক নন, ধর্মীয় উগ্রবাদে রাজনৈতিক ইসলাম এর দোহাই দিয়ে গরীবদের উগ্রবাদী বানায়ে আর  নারীদের গলায় আরও গাঢ় করে ‘অবলা-দুর্বলা’র তকমাটা এঁটে দিতে চান। বর্তমানে গোটা দেশের নারী-প্রগতিতে, পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীর লড়াই করার শক্তি দেখে ওরা শঙ্কিত। নির্বিবেক রাজনৈতিক সংরক্ষণের জের নিকট অতীতে রাজনীতিকদের ভুগতে হয়েছে এবং  সামলাতে হচ্ছে আজও।
বাংলার মানুষ আজ বুঝে গিয়েছে যাবতীয় সর্বনাশের মূলই হল ওই রাজনৈতিক ‘সংরক্ষণ’। সাধারণ মানুষের চিন্তা ওই সংরক্ষণের প্রাচীর ভাঙতেই বিন্দু বিন্দু করে জমে মহাসাগরের পথ প্ররিক্রমার দিকে এগুচ্ছে। তাই দিন বদলের পালায় - কাণ্ডারি হুঁশিয়ার, সত্যের পথ কঠিন। পা ফেলে এগিয়ে চলতে আছে কাঁটার জ্বালা। একবার সার্বিক অঙ্গনে সত্য প্রতিষ্ঠা হলে কাণ্ডারী চিরস্মরণীয়  থাকেন দেশ ও জাতির কাছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন