বুধবার, ২৪ জুন, ২০১৫

আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ

আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ

সংলাপ ॥ মুসলমান - ‘পোষা জানেয়ার, বুনো জানোয়ার, যে বলে সে মুসলিম জিভ ধরে টানো তার’ ....... এই শব্দগুলো মোটেও ইসলাম বিদ্বেষী কোনো বিধর্মীর মুখের কথা নয়। নয় উগ্র কোনো ধর্মান্ধ ইহুদি-খ্রীষ্টান বা হিন্দুর কলমের লেখা। গত শতাব্দির গোঁড়ার দিকে অগ্নি-বীণার আনোয়ার কবিতায় এই কথাগুলো বলেছিলেন সাধক কাজী নজরুল ইসলাম। আজকে বাংলাদেশে যাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভূষিত করা হয়েছে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে!
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, সাধক নজরুল কেন মুসলমানদের ‘বুনো জানোয়ার’ ও ‘পোষা জানোয়ার’ বলে আখ্যায়িত করলেন? মুসলিম বলে দাবিদারের জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে বললেন? নজরুল কি তবে স্বজাতি বিদ্বেষী ছিলেন? অথবা এজেন্ট ছিলেন বিধর্মীদের? নজরুলের গোটা জীবন ও তাঁর কর্ম, তাঁর প্রকৃতি, তাঁর চরিত্র সর্বোপরি সময়ে সাক্ষ্য দেয় - নজরুল ছিলেন একজন খাঁটি মুসলিম, একজন নিখাঁদ মানুষ, ছিলেন একজন মহান সাধক। তাই নজরুলের পক্ষে স্বজাতি তো বটেই কোনো জাতির প্রতিই বিদ্বেষপরায়ণ হওয়া সম্ভব ছিলো না। সত্য সাধক নজরুলের কন্ঠে তাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে সত্যেরই অমর ধ্বনি।
মুসলমানদের সম্পর্কে সাধক নজরুলের উপলব্ধি, তাঁর উচ্চারণ যে কত বড় সত্য তা অনুধাবন করার জন্য একশ’ বছর পেছনে যেতে হবে না, আজকের সমসাময়িক বিশ্ব মুসলমান পরিচয়দানকারী জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালেই তা ধরা পড়ে একটু খুঁটিয়ে দেখলেই।
সামপ্রতিক বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া চরম হিংসাত্মক ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলেই ফুটে ওঠে নজরুল আখ্যায়িত ‘মুসলমান (?) চরিত্র’। ধরা পড়ে মুসলমান নামধারীদের যুগপৎ ‘বুনো’ ও ‘পোষা’ জানোয়ার চরিত্র!
উপমহাদেশের চলমান শান্তি প্রক্রিয়ার আকাশ ঢেকে দিচ্ছে সংঘাত-হানাহানির আশঙ্কার কালো মেঘ। বলার অপেক্ষা রাখে না এই হামলাকারীদের পরিচয় মিডিয়ার ভাষায়, ওরা ‘ইসলামি জঙ্গি (!)’।
এসব হামলাকারীদের চরিত্র নিয়ে বিতর্ক তুলতে গিয়ে প্রশ্ন উঠবেইঃ ইসলাম কি? কুরআনিক মুসলিম কে? মুসলমান কে? ইসলাম সন্ত্রাস সমর্থন / অনুমোদন করে কিনা? বাংলায় ‘শান্তি’ই আরবীতে ‘ইসলাম’। সেই শান্তি বা ইসলামের নামে অশান্তি-হানাহানি সৃষ্টি সম্মত কিনা? কিংবা মুসলিম তথা ভদ্র পরিচিত ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ‘বুনো’ হিংস্র পশুর মতো আচরণে মত্ত হয়ে উঠতে পারে কিনা? এসব প্রশ্ন নিয়ে ইসলাম নির্ভর ধর্মজীবীরা গভীর তাত্ত্বিক বিতর্কেও ডুবে থাকতে পারেন। পারেন ফতোয়াবাজিতে লিপ্ত হতে। কিন্তু এসব হিংসাত্মক ঘটনায় তাৎক্ষণিক ও মেয়াদী কড়া মাশুল গুনতে হয় যে কোটি কোটি ধর্মভীরু মুসলমানদের। তাত্ত্বিক বিতর্ক বা ফতোয়া কোনোই কাজে আসে না তাদের দৈনন্দিন জীবনে। ইসলাম রক্ষা বা মুসলমানদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার কথা বলে পরিচালিত এসব জঙ্গি হামলার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাঝেই ধর্মভীরু মুসলমানদের খুঁজতে হচ্ছে এসব তৎপরতার অন্তর্নিহীত অর্থ, অঘোষিত লক্ষ্য ও চেপে রাখা ইতিহাস ও বর্তমান উদ্দেশ্য।
এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণে প্রথমেই দেখতে হবে এসব হামলায় লাভবান তথা ‘বেনিফিসিয়ারী’ কারা। উল্লেখ্য, গভীর রহস্যময় ক্লুবিহীন খুনের ঘটনায় তদন্তকারী দল প্রথমেই খোঁজে খুনের সম্ভাব্য বেনিফিসিয়ারী কে বা কারা। এ পথে এগোতে গিয়েই ধরা পড়ে সম্ভাব্য খুনীর পরিচয়। এ ক্ষেত্রেও গভীর বিশ্লেষণ ছাড়াই এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট এসব জঙ্গি হামলার ফসল সরাসরি ঘরে উঠছে ইসলাম বিদ্বেষীদের। সমষ্টিগত ভাবে বিশ্বে সমগ্র মুসলমানরা পরিচিত হয়ে উঠছে জঙ্গি, মধ্যযুগীয়, আদিম, বর্বর হিসেবে। নতুন প্রজন্মের বিশ্ব নাগরিক কিংবা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে শান্তি বা ইসলামকে উপস্থাপিত করা হচ্ছে আদিম বর্বরতার প্রতীক হিসাবে। ঘৃণা, অবজ্ঞা, নিস্পৃহতা জন্ম নিচ্ছে এদের মাঝে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে।
অপরদিকে বিশ্বজুড়ে ব্যক্তিগত ভাবে ধর্মভীরু মুসলমান কিংবা জন্মসূত্রে মুসলমান পরিচয়ধারী কোটি কোটি মানুষ নিগৃহীত হচ্ছে নানাভাবে। বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকায় ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত, বঞ্চিত, নিগৃহীত হচ্ছে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে সমগ্র পৃথিবীতে মুসলমান পরিচয়ধারী মানুষ বৈষম্য আর অবজ্ঞা-ঘৃণার মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিদিন। বিঘ্নিত হচ্ছে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পেশাগত নিরাপত্তা। ফলে ধর্মান্ধ জঙ্গিদের ‘বুনো’ চরিত্র দেখার পরও কি ধর্মভীরু মুসলমানদের মানতে হবে এরা কুরআনিক মুসলিম? সাধক নজরুলের কথা মতো জিভ ধরে টান না দিলেও এদের ইসলামি (?) ছদ্মাবরণ টেনে ছিঁড়ে ফেলাটা ধর্মভীরু বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য কি জরুরি নয়? ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলাফল দেখেও কি বুঝতে অসুবিধা হয় যে এরা কারো না কারো ‘পোষা’। আর এদের গলায় বাঁধা অদৃশ্য শেকলের ও মাথায় ধরা হাতটি কার তা বুঝার জন্যও কি অনেক গবেষণার প্রয়োজন? আল-কায়েদার জন্ম কোন ল্যাবরেটরীতে? ওসামা বিন লাদেনের জন্মদাতা কে? সাদ্দাম, আরাফাত, গাদ্দাফী, জিয়াউল হক সহ বিভিন্ন স্বৈরাচারী কারা তৈরি করছে? সমগ্র বিশ্বে মুসলমান
অধ্যুষিত দেশসমূহে কারা বাদশাহী অথবা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার কৌশল ও অস্ত্র সরবরাহ করছে? তালেবানদের লালন-পালন আর প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রদাতা কে এর কোনটাই আজ অজানা নয়। হয়তো এখনও অপ্রমাণিত। কিন্তু পঁচিশ-ত্রিশ বছর পরে মার্কিনীরা যখন নিয়মানুযায়ী হোয়াইট হাউস আর পেন্টাগণের ‘ক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস্তুগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করবে তখন সেসব গোপন নথিতে উঠে আসবে লাদেন, আল-কায়েদা, সাদ্দাম আর তালেবান সৃষ্টির মার্কিনী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও  বাস্তবায়নের অজানা কাহিনী। জানা যাবে তাবৎ বিভিন্ন ধর্মের ধর্মান্ধ জঙ্গিদের জন্ম জঙ্গলে (আমেরিকা!)। যেমনটি প্রকাশিত করা হয়েছে ত্রিশ বছর আগের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক হোয়াইট হাউসের বেশ কিছু ‘ক্লাসিফাইড’ দলিল। ফলে এই উপমহাদেশের মানুষ জানতে পারলো ‘সার্বভৌম’ (!) ‘মুসলিম’ (!) রাষ্ট্র পাকিস্তানের সেনাপতি ইয়াহিয়া খান দেশে সামরিক শাসন জারির আগাম অনুমতি নিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রভু নিক্সনের কাছ থেকে, ১৯৭১-এ।
মার্কিনীদের আজকের ক্লাসিফাইড দলিলের কাহিনী জানতে হলে বিশ্বকে অপেক্ষা করতে হবে হয়তো পরবর্তী পঁচিশ-ত্রিশ বছর। কিন্তু ততদিনে বিশ্বের কোটি কোটি ধর্মভীরু মুসলমানদের কি হবে? কি হবে পবিত্র ধর্ম ইসলামের, যা কিনা সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্ব তথা মানবতার মাধ্যমে ‘শান্তি’র মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত?
কি হবে তা নিয়েই ভাবার সময় নেই আজ বিশ্বের ধর্মভীরু মুসলমানদের সামনে। ধার্মিকদের কাছ থেকে জরুরি তাগিদ আসছেঃ জেগে ওঠো। ধর্মভীরু মুসলমানরা জেগে ওঠো। কুরআনিক মুসলিম হও। চৌদ্দশ’ বছর আগে যে কুরআনকে ধারণ-লালন-পালন করে রাসুল (সাঃ) হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত কুরআন সেই পবিত্র কুরআনের আলোকে সত্যিকারের মুসলিম হিসাবে নিজেদের গড়ে তোলো। চৌদ্দশ’ বছর আগের সেই দ্যূতি ছড়ানো ঝলসানো আলোর মতোই বিশ্বমানবের সামনে আবারও নিজেদের তুলে ধরো সভ্যতার কান্ডারী হিসাবে - এক একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে। ধ্বনিত হোক প্রতিটি মুসলমানের কন্ঠে সাধক নজরুলেরই সেই অমর বাণী -

‘আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন