বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬

বাঙালি জাতিসত্ত্বা সমুন্নত রাখতে বাউল সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা সময়ের দাবি




বাঙালি জাতিসত্ত্বা সমুন্নত রাখতে
বাউল সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা সময়ের দাবি

রাজীব, কুষ্টিয়া ॥ বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষদেরকে অশান্ত করে তোলার জন্য দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের নানা অপকর্ম বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। বিশেষ করে বাঙালি জাতিসত্ত্বা ও সংস্কৃতির অন্যতম একটি ধারা বাউল সম্প্রদায়কে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে আমদানীকৃত ধর্মের ধর্মান্ধ স্বার্থান্বেষী মহল। বাঙালি ঐতিহ্যের ধারক বাহক সত্যমানুষ ফকির লালন শাহ্ এর উত্তরসূরী নির্লোভ-নির্মোহ ফকির বাউল ও তাদের আস্তানায় বিগত কয়েক বছর ধরে একের পর এক হামলা হচ্ছে। আজ উন্নত বিশ্বে দেশ-বিদেশের বহু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে বাংলার সনামধন্য পথ প্রদর্শক সত্যমানুষ ফকির লালন শাহ্ ও বাউল সাধনা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, যেখানে ফকির লালন শাহ্ এঁর দর্শন পাঠদান করা হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে বাংলার একটি ধর্মজীবী-ধর্মান্ধ গোষ্ঠী লালন দর্শন তথা বাউল দর্শনকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
গত ২৯ জুলাই শুক্রবার দিবাগত রাতে চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা থানার গোবিন্দপুর গ্রামে ফকির জুলমত শাহ্ এঁর আখড়ায় ৭/৮ জনের একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী আনুমানিক রাত্রি ১২ টার দিকে অতর্কিত হামলা চালায়। তারা প্রথমেই এসে লাইট এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে উপস্থিত তিনজন বাউল ফকির জুলমত শাহ্, তাঁর স্ত্রী মোমেনা বেগম ও হরেন্দ্রনাথ গোস্বামী নামক এক ভক্তকে গাছের সাথে বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটায় ও চুল, দাঁড়ি কেটে দেয়। এক পর্যায়ে জুলমত শাহ্ গলায় ছুরি চালানোর জন্য উদ্ধত হলে হাতে পায়ে ধরে তারা রক্ষা পায়।
আগামী ১ মাসের মধ্যে তারা আখড়া ভেঙে না ফেললে পুনরায় হামলা করবে বলে সন্ত্রাসীরা হুমকি দেয়। সন্ত্রাসীরা ঘরের আসবাবসহ তবলা, হারমোনিয়াম, সাইকেল, একটি শ্যালোমেশিন ও বেশ কিছু বইপত্র এক জায়গায় জড়ো করে প্রেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফকির জুলমত শাহ্ বেশ কিছু দিন যাবৎ হৃদরোগে ভুগছিলেন। চিকিৎসার জন্য জমানো ১৭০০০ (সতের হাজার) টাকাও একই সাথে পুড়িয়ে দিয়ে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।
বাউল জুলমত শাহ জানিয়েছেন, বছর ছয়েক আগে তিন বিঘা জমির উপর তিনি আখড়াটি বসিয়েছিলেন। প্রতি বছর ১৫ বৈশাখ, ৫ আষাঢ় এবং ২৫ ফাল্গুন সেখানে আসর বসে, দেশ-বিদেশ থেকেও বহু বাউল-ফকির তাতে অংশ নেন। আক্রমণের শিকার বাউলরা জানিয়েছেন, আক্রমণকারী তরুণরা নিজেদের খুলনার লোক বলে দাবি করলেও চুয়াডাঙ্গার আঞ্চলিক টান ছিল তাদের কথায়।
এ ব্যাপারে দামুড়হুদা থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি আবু জিহাদ মোহাম্মদ ফকরুল ইসলাম জানিয়েছেন ইতোমধ্যে অভিযান চালিয়ে মদনা নামক পার্শ্ববর্তী ১টি গ্রাম থেকে আলাউদ্দিন (২৮) এবং নাসিরুল নাসির (২৫) নামে দুই জন আসামীকে ধরা হয়েছে। সোমবার সকালে তাদেরকে কোর্টে প্রেরণ করা হয়েছে এবং তারা পুলিশ হেফাজতে আছে। এদিকে চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক ও চুয়াডাঙ্গা বাউল পরিষদের সভাপতি মনিরুজ্জামান আগামী শুক্রবার মানববন্ধন ও কালোব্যাজ ধারণের এক কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। এছাড়াও চুয়াডাঙ্গা ২ আসনের এমপি হাজী আলী আজগর টগর, পুলিশ সুপার, টিএনও সকলেই জায়গাটি পরিদর্শন করে তাদের পুনর্বাসন ও নিরাপাত্তার আশ্বাস দিয়েছেন।
অন্যদিকে গত ১৬ জুলাই শনিবার রাতেও একই জেলার জীবননগর উপজেলার একতাপুর গ্রামের আখড়ায় বাউলদের ওপর হামলা চালিয়েছিল মুখোশ পরা দুষ্কৃতিরা। রাত ১টার দিকে সাত-আট জন যুবক আখড়ায় এসে বাউলদেরকে লোহার রড ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে। একতারপুরের আখড়াটিও পুড়িয়ে দেয় দুষ্কৃতিরা। পরে তাদের চিৎকারে এলাকার লোকজন এলে তারা পালিয়ে যায়। দুই মহিলাসহ তিনজন এই হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন। আহতরা হলেন - কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার শহরদা গ্রামের আবদুর রহিম (৬৫) ও তার স্ত্রী বুলু খাতুন (৫০) এবং ঝিনাইদহের হরিণাকু উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের রুশিয়া খাতুন (৪৫)। তদন্তে নেমে জামাতে ইসলামি ও তাদের ছাত্র শাখার কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ দিনের ঘটনার পিছনেও জামাতের সন্ত্রাসীরা রয়েছে বলে সন্দেহ পুলিশের। স্থানীয়রা সে সময় আহতদের উদ্ধার করে প্রথমে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি  করে। হামলার পর থেকে আখড়ায় সাধারণ বাউল - সাধু - ফকিরসহ তরিকাপন্থীদের অবস্থান ও গানবাজনা বন্ধ রয়েছে। সন্ত্রাসীদের হামলায় তছনছ হয়ে পড়া আখড়াবাড়িটি মেরামত করা হয়নি। এ ঘটনায় পরদিন ১৭ জুলাই একতারপুর গ্রামের শহিদুল হক শাহ বাদী হয়ে জীবননগর থানায়  মামলা দায়ের করেন। আখড়াবাড়িতে অনধিকার প্রবেশ, ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলাটি করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো-জীবননগর উপজেলার সেনেরহুদা গ্রামের নিয়ামত মন্ডলের ছেলে জামায়াত নেতা জামাত দ. কলিমদ্দিন (৩৯), আনাম আলীর ছেলে শফি উদ্দিন (২৬) ও উথলী গ্রামের সাগর আলীর ছেলে ইলিয়াস হোসেন (২৫)। এদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবী করেছেন জীবননগর উপজেলার বিভিন্ন বাউল সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। জেলা বাউল কল্যাণ সংস্থার সভাপতি মহিউদ্দিন শাহ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাউল-সাধুরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তাঁরা কাউকে কোনো ক্ষতি না করলেও একটি মহল কারণ ছাড়াই একতারপুর আখড়াবাড়িতে হামলা চালায়।
বিগত কয়েক বছর ধরে বাউল সম্প্রদায়ের উপর বার বার হামলা করা হচ্ছে। কারা বাউল সংস্কৃতি বিরোধী তা এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ সবাই জানে। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রেরও অজানা নয় কারা বাউলদের উপর হামলার জন্য দায়ী। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এইদেশে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর বিভিন্ন সময় একই উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠী হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে হতাহত করেছে। বিগত কয়েক মাসে হিন্দু-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অনেক পুরোহিত নিহত ও আহত হয়েছে উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠীর দ্বারা যা রোধ করার কোন পন্থা প্রশাসন বের করতে পারছে না। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারা বাউল সম্প্রদায়ের ফকিরদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সরকারের আশু প্রশাসনিক পদক্ষেপ সময়ের দাবী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন