বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬

সঙ্কটের মূলে ব্যক্তিস্বার্থপরতা



সঙ্কটের মূলে ব্যক্তিস্বার্থপরতা

ধন-সম্পদ বাড়াবার লোভ ও লিপ্সা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে যতক্ষণ না পর্যন্ত কবরে উপনীত হও। এটা সঙ্গত নয়, শীঘ্রই তোমরা তা জানতে পারবে; আবার বলি, এটা সঙ্গত নয়, তোমরা শীঘ্রই তা জানতে পারবে। কখনোই নয়! যদি তোমরা নিশ্চিত জানতে পারতে অবশ্যই তোমরা মোহাচ্ছন্ন  হতে না। তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে; আবার বলি তোমরাতো তা অবশ্যই দেখবে চাক্ষুষ প্রত্যয়ে, এরপর সেদিন অবশ্যই আল্লাহ্র নিয়ামতসমূহ সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (আল কুরআনঃ ১০২: ১-৯)
শাহ্ ফুয়াদ ॥ ব্যক্তিত্ব আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বা ব্যক্তিস্বার্থপরতা এক কথা নয়, ভিন্ন বিষয়। বাংলা একাডেমীর সহজ বাংলা অভিধান মতে, ব্যক্তিত্ব হচ্ছে ব্যক্তির স্বকীয়তা। অন্যের সঙ্গে পার্থক্য করা যায় এমন ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য। আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অর্থ হচ্ছে, সর্বজনীন বা সমষ্টির গুরুত্বের চেয়ে যে মতবাদ ব্যক্তির গুরুত্বকে প্রাধান্য দেয়। এমন এক নীতি যাতে সমাজের চেয়ে ব্যক্তি বড়। এটা একজন মানুষের এমন একটি অবস্থা যা তাকে চরম আত্মকেন্দ্রিক, সমাজবিমুখ ও স্বার্থপর করে তোলে। আমাদের সমাজ ও দেশের এখন যে অবস্থা তাতে স্পষ্টতই দেখা যায় যে, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা কমে গেছে, প্রতিষ্ঠা হয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, ব্যক্তিস্বার্থপরতায় আচ্ছন্ন লোকদের প্রভাবে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে বৈষম্য, দুর্নীতি ও মিথ্যাচার। তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদ, স্বাধীনতার সুফল হিসেবে মানুষের আর্থিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ইত্যাদি সবকিছুই মানুষকে আগের চাইতে যেন আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। ফলে গুলশান ও কিশোরগঞ্জে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও বিদেশি হত্যাযজ্ঞ, রাজধানীর কল্যাণপুরে অভিযান চালিয়ে ৯ জঙ্গীকে হত্যার ঘটনায় দেশের সবাই আজ সরব ও উচ্চকিত হয়ে উঠেছে ঠিকই, এই ঘটনা যে সমাজের ব্যক্তিস্বার্থপরতারই পরিণতি তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, এদেশেরই এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের জন্য সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ছাত্র ও যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করছে, সন্ত্রাসী বানাচ্ছে, হত্যা করছে নিরীহ মানুষকে । দেশ রসাতলে যাক-এ নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য এদের নেই। ১৯৭১-এ যেমনটি করেছিল রাজাকার-আলবদর-জামাত-মুসলিম লীগ-শান্তিকমিটিসহ এদেশীয় স্বার্থান্ধ, বর্বর পাকিস্তানীদের দালালেরা। দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, পাকিস্তানী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের সময় এদেশের রাজনীতিতে, সমাজের সর্বস্তরের নিঃস্বার্থ, নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী ও সংগঠকের  অভাব ছিল না, স্বাধীন দেশে এই সংখ্যাটি কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। সবাই চায় এখন নিজেই বড় হয়ে যেতে। রাজনৈতিক দল, সরকার, চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব ক্ষেত্রেই একথা আজ প্রযোজ্য। সামগ্রিক স্বার্থে নয়, সব কিছুই যেন ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থে। ফলে মিথ্যাচারের সংস্কৃতি থেকে জাতি মুক্ত হতে পারছে না।                          
আর এরই পরিণতিতে, বাংলা ভাষায় প্রচলিত নির্দেশনামূলক বাক্য-‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’- বর্তমান সমাজে এর বাস্তবতা কতটুকু ? আর এর বিপরীতে অবস্থাটি ‘দেশের চেয়ে দল বড়, আর দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়’- এর মধ্যে বাস্তবতা কতটুকু? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা রয়েছে সমাজের সচেতন প্রতিটি মানুষের কাছেই। ব্যক্তিগতভাবে একজন মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে-এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু রাজনীতি, সমাজনীতি, আমলাতন্ত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষাদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামগ্রিক স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া হয় না বলেই সমাজে বিরাজ করে অশান্তি, অন্যায়, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি চলে ধর্মের নামে। ধর্মের নামে উগ্র-সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আজ তাই ভয়াবহ রূপ পেয়েছে-নাম নিয়েছে জঙ্গীবাদ বলে। আর সেই সন্ত্রাসকে রুখে দেয়ার জন্য ব্যবহার করতে হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি ।
অবশ্য অন্যায়-অশান্তি-সন্ত্রাস-মানুষের নিত্য সঙ্গী, পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই। এসবের বিরুদ্ধে মানুষকে শান্তির নিশানা দেয়ার জন্যই যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন নবী-রাসুলগণ। এঁদেরই উত্তরাধিকার সূফী-সাধক-আউলিয়াগণ যাঁরা সময় ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় মানুষকে শান্তি ও সত্যের বাণী শুনিয়েছেন, মানুষকে এই পথে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। এক সাধক বলেছিলেন, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। এই ‘সকল’ বলতে তিনি শুধু মানুষ প্রজাতিকেই বুঝিয়েছিলেন, অন্য কোনো চতুষ্পদ প্রাণী এর মধ্যে পড়ে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ নিজেকে নিয়ে আজ বড় বেশি ব্যস্ত। এই ব্যস্ততা ব্যক্তিগত সুখভোগ, সম্ভোগ বৃদ্ধি, নগদ অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তি তথা পুঁজি বাড়ানোর লক্ষ্যে। সেই বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় সৃষ্টি হয়েছে ব্যাংকিং পদ্ধতি, যা আজ বিশাল আকার ধারণ করেছে আমাদের দেশেও। এই পুঁজি বাড়ানোর প্রতিযোগিতা ইসলাম ধর্ম (শান্তিধর্ম) কখনো স্বীকার করে না। হাক্কানী সাধক বলেন, ‘ যে নিজেকে মুহাম্মদ (সাঃ)-এঁর অনুসারী দাবি করবে তার কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ (বর্তমান যুগে যা ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট)  থাকতে পারে না। কারণ, মুহাম্মদ (সাঃ)-এঁর কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না।’ ইতিহাস বলে, বিবি খাদিজা (রাঃ)-এঁর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সমস্ত সম্পদ শান্তিধর্ম (ইসলাম ধর্ম) তথা মানবতার মহান ব্রতে নিয়োজিত করেছিলেন। ব্যক্তিস্বার্থের কথা ভাবার কোনো চিন্তাও নবীজীর ছিল না। অপরদিকে, তাঁর শান্তি ও সত্যের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে ব্যক্তিস্বার্থ তথা গোষ্ঠীস্বার্থ যাদের ক্ষুন্ন হবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, সেই কুরাইশ বংশের লোকেরা তাঁর ওপর কত অত্যাচার, নির্যাতন, জ্বালাতন করেছে তা বিশ্ব ইতিহাসেরই অংশ হয়ে আজও বিরাজ করছে।
আজ বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলমান হলেও এর কত শতাংশ নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সেই আদর্শ ধারণ, পালন ও লালন করেন সেটাই প্রশ্ন। ব্যক্তি স্বার্থ আদায় ও ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসের জন্য, পার্থিব সম্পদ বৃদ্ধিও জন্য মুসলমানরাও যেভাবে আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলার কিছু নেই। বিশেষ করে তথাকথিত শিক্ষিত ও সুবিধাভোগী মুসলমানেরাই বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। তাদের চাহিদা ও প্রয়োজনেরও যেন শেষ নেই। এই চাহিদা মেটাতে গিয়েই তারা দুর্নীতি করছে, সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে চিন্তা করার সময়ও তাদের নেই। অথচ রাজনৈতিক স্বার্থে বলা হয়, ‘মুসলমান-মুসলমান ভাই, মুসলিম উম্মাহ’-এ জাতীয় কত কথা! এভাবে এক শ্রেণীর মুসলমানরাই বঞ্চিত করছে আরেক মুসলমানকে, বঞ্চিত করছে দেশ ও সমাজকে। কিন্তু পরিণতিতে তারা নিজেরাও যে বঞ্চিত হচ্ছে সে-কথা স্মরণ রাখার সময়ও হয়তো তারা পান না। প্রাকৃতিক নিয়মে অন্যসব প্রাণীর মতোই তারা পৃথিবীতে আসেন। ত্যাগে, জগতের সাথে ভালোবাসা ও প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মধ্যে যে অপার আনন্দ রয়েছে, সেটি উপলব্ধি করার আগেই তারা পৃথিবী থেকে চলেও যান। মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ ও এর সার্থক পরিণতির মধ্যেকার আনন্দ কোনোদিনই পান না তারা। এ প্রসঙ্গে সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর অমূল্য বাণী হচ্ছে, ‘ভোগের আনন্দ সাময়িক, ত্যাগের আনন্দ চিরন্তন’।
প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমানের এই বাংলাদেশের মানুষদের সে কারণেই আজ জেগে উঠার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রের। উল্লেখ্য, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দের ১৮ কার্তিক মোতাবেক ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত (যা আজও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ) রয়েছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা - যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’। রাষ্ট্র, সরকার তথা সমাজের সর্বস্তরে দায়িত্বশীল সকলকে এ ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন হওয়ার ডাক এসেছে। এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য মহান সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর অমর বাণী, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই তার স্বীয় কর্মবৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে’। সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হবেন, রাষ্ট্র ও সরকার সেখানে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে-বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল সময় রাষ্ট্রের এই ভূমিকা পালনের যে অভাবনীয় সুযোগ এনে দিয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহার হবে-এটাই আজ বিবেকবান মানুষদের প্রত্যাশা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন