বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬

মনুষ্যত্ব জাগ্রত রাখাই মানুষের ধর্ম

মনুষ্যত্ব জাগ্রত রাখাই মানুষের ধর্ম

·        ‘নিশ্চয় যারা বিশ্বাসী, ইহুদী, সাবেয়ী ও খ্রীষ্টানদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাস করবে, আর সৎকাজ করবে, তার কোন ভয় নেই, আর সে দুঃখও পাবে না’। (আল কুরআন-৫: ৬৯)।
·        ‘আল্লাহ্ তোমাকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে পরলোকের কল্যাণ অনুসন্ধান কর। ইহলোকে তোমার বৈধ সম্ভোগকে তুমি উপেক্ষা করো না। তুমি মহানুভব হও, যেমন আল্লাহ্ তোমার ওপর মহানুভব। আর পৃথিবীতে ফ্যাসাদ (সন্ত্রাস) সৃষ্টি করতে চেয়ে যেও না। আল্লাহ্ তো বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালবাসেন না। (আল কুরআন-২৮ : ৭৭)।
·        ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার কাছে’। (আল কুরআন-১০৯:৬)।
·        ‘তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহ্ প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্ প্রকৃতির কোন পরিবর্তন নাই। এ-ই সরল ধর্ম; কিন্তু মানুষ অনেকেই তা জানে না’। (আল কুরআন-১০৯ : ৬)।
শাহ্ ফুয়াদ ॥ শব্দের উৎপত্তিগত অর্থে ‘মান’ সম্পর্কে যার হুঁশ আছে সেই মানুষ। সূফী সাধক আনোয়ারুল হক বলেছেন, ‘মানুষ যদি হতে চাও তবে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত কর’। ইসলাম মানবতা ও সত্যের ধর্ম। এখানে মানবতাবিরোধী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ও মিথ্যাচারীদের কোনো স্থান নেই। সাধক কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি কো ইসলাম। সত্যকে যে চায়, আল্লায় মানে মুসলিম তারি নাম’। ‘ইসলাম পৃথিবীতে কাউকে গোলাম করতেও আসিনি, কারও গোলাম হতেও আসেনি’। ইসলাম শব্দের অর্থই শান্তি। সেই অর্থে ইসলামকে শান্তির ধর্ম না বলে শান্তিধর্ম বলাই যুক্তিসঙ্গত। শান্তির পরিপন্থী কোনো কাজ করলে সেখানে আর ধর্ম থাকে না। আজ থেকে চৌদ্দ শ’ বছর আগে আরব দেশের মক্কা নগরী যখন অন্যায়, অত্যাচার, হানাহানি, নির্যাতন, বিশেষ করে নারী নির্যাতন, ব্যাভিচারসহ সকল ধরনের অশান্তি ও বর্বরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন সেখানে এই শান্তিধর্মের বাণী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ (সা.)। এর জন্য মক্কা নগরীর হেরা গুহায় মহানবী (সা.) কে তাঁর আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা, গবেষণা, অনুসন্ধ্যান ও ধ্যান করে কাটাতে হয়েছিল দীর্ঘ পনেরোটি বছর।
জন্মেছিলেন তিনি তৎকালীন আরবের সবচেয়ে প্রভাবশালী কোরাইশ বংশে। যৌবনে তিনি হিলফুল ফুজুল-এর মতো সংগঠন করে তৎকালীন আরব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন বাস্তবধর্মী কর্মকাণ্ড গ্রহণ করেছিলেন। পরিণত বয়সে যখন এক আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের আহবান জানালেন তখন কোরাইশ বংশের লোকেরা তাঁর প্রচারিত শান্তিধর্মে বিশ্বাস স্থাপন তো দূরের কথা, তাদের অত্যাচারে নবীকে মক্কা ছেড়ে হিজরত (অভিবাসন) করতে হয়েছিল মদিনায়। কারণ, তাঁর প্রচারিত সত্য ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে কোরাইশদেরকে প্রভাব-প্রতিপত্তি, আধিপত্য, মোনাফেকী, অত্যাচার, ব্যাভিচারসহ যাবতীয় মিথ্যাচার সব কিছুই ছেড়ে দিতে হয় যা কোরাইশদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। মহানবীর সারাজীবনের অপরিসীম কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল হিসেবে শান্তিধর্মকে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন। জয় করলেন মক্কা । আর এই জয়ের সাথে সাথে কোরাইশসহ তৎকালীন আরবের অনেক বংশের ভণ্ড, প্রতারক, মোনাফেক ও কায়েমী স্বাথবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী মুসলমানের দলে ভীড়ে গেলো, যাদের প্রকৃত পরিচয় উন্মোচিত হলো মহানবীর ওফাতের পর। তাঁর উত্তরাধিকার তথা ক্ষমতা নিয়ে শুরু হলো দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, মহানবী (সা.) কিন্তু তাঁর পরিধেয় বস্ত্র (জোব্বা) মক্কা নগরীর কাউকেই দেননি, পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সূদুর ইয়েমেনে তাঁর আশেক ও ভক্ত ওয়াসেস করণী (রা.)-এঁর জন্য, যিনি তাঁর অসুস্থ ও বৃদ্ধা মায়ের সেবা-শুশ্রুষার জন্য নবীজির সাথে জীবনে দেখাই করতে পারেননি। নবীজীর ওফাতের পর চার খলিফার মধ্যে তিনজনই নিহত হয়েছিলেন মুসলমান ঘাতকদের হাতে, পরবর্তীতে নবীজির প্রিয়তম দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.) ও ইমাম হাসান (রা.) সহ নবীবংশই এজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল তারাও ছিল মুসলমান। তবে তারা কী ধরনের মুসলমান ছিল সেটাই প্রশ্ন। বস্তুতপক্ষে ‘ইসলাম’ শব্দটিকে তারা ব্যবহার করেছিল পার্থিব ক্ষমতা তথা রাজনীতির স্বার্থে। ফলে সেখানে মানবতা, সত্য ও শান্তির পথ তারা জলাঞ্জলি দিয়েছিল। এক আল্লাহ্র ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে সেই বিশ্বাসে তারা কখনো একনিষ্ঠ ছিল না। একনিষ্ঠ শুধু তারাই ছিলেন যারা মুহাম্মদ (সা.) প্রবর্তিত শান্তি ও সত্যের বাণী প্রচারে ছড়িয়ে পড়েছিলেন বিশ্বময়। তারা ছিলেন সূফী সাধক, অলি-আউলিয়া-দরবেশ, মানবতার মহান ব্রতে তাঁরা তাঁদের জীবনকে করেছিলেন উৎসর্গ। তাঁদের নিদর্শন হিসেবে ভারতবর্ষে খাজা মঈনুদ্দিন হাসান চিশতি (রা.), বাংলাদেশে শাহ্ জালাল (রা.)-এর মতো দরগাহ ও মাজার শরীফ আজও সব ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষদের মিলনকেন্দ্র, শান্তি-মঙ্গলের নিশানা। এভাবে দেখা যায়, কমপক্ষে বারো শ’ বছর ধরে এদেশের মানুষ মুসলমান, শান্তি (ইসলাম) ধর্মের অনুসারী। অথচ আজ আবার এদেশের মুসলমানকে নতুন করে ধর্ম শেখাতে চায়, নতুন করে মুসলমান বানাতে চায়, এরা কারা? নাকি এরা শান্তি ধর্মের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীদের বংশধর যারা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এসেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আজ খুঁজছে এদেশের বিবেকবান ও সচেতন মানুষেরা।

ধর্মের নামে, ইসলামের নামে বর্তমানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের নামে আধিপত্য সৃষ্টি করে রাখতে চায়। তারা ধর্মীয় আধিপত্য কায়েম করতে চায়। এসব বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নবীজির ওফাতের পর থেকেই এই চেষ্টা করে আসছে। এটাকে তাই বলা হয় রাজনৈতিক ইসলাম। আর এই রাজনৈতিক ইসলামের বর্তমান পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতা খোদ্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এর আগে ছিল ব্রিটিশ পরাশক্তি। বস্তুত সমগ্র ইউরোপই তাদের মদদদাতা। এই ব্রিটিশ ও মার্কিনীরাই মুহাম্মদ (সা.)-এর আরব দেশে কায়েম করেছে সৌদি রাজবংশ এবং তাদের সহযোগী কাতার, কুয়েত, বাহরাইনে অন্যান্য আরও কয়েকটি রাজবংশ। মুহাম্মদী আরব না হয়ে তাই রাষ্ট্রের নাম হয়েছে সৌদি আরব। ইসলাম কখনো রাজতন্ত্র সমর্থন করে না। এই রাজতন্ত্রই এখন সমগ্র মুসলিম উম্মার উন্নয়নের পথের কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের সবচেয়ে ঘনিষ্ট মিত্র এই সৌদি আরব। বলতে গেলে সৌদি রাজতন্ত্রের এবং সৌদি রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব ও ক্ষমতাও ইসরাইলকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এই সৌদি আরবই আবার ওহাবীবাদের জন্মদাতা, ধারক, বাহক ও প্রচারকারী। ইসলামের নামে এই ওহাবীবাদই এখন সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের ধর্মভীরু মানুষদেরকে গ্রাস করে রেখেছে এই ওহাবীবাদ। অথচ এই ওহাবিরা কখনো ধার্মিক হতে পারে না। মওদুদিবাদী জামাত-তাবলিগ-হেফাযত এসবই রাজনৈতিক ইসলামের ধারক-বাহক। এরাই ধর্মান্ধতা সৃষ্টি করে। আইএস ওহাবীবাদের নতুন সংস্করণ। এভাবে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি করে এদের দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিগত বছরগুলোতে আরবী ভাষাভাষী ও মুসলিম রাষ্ট্র ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় বিভিন্নভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে তছনছ করে দিয়েছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের হস্তক্ষেপ না থাকলে সিরিয়া তথা গোটা মধ্যপ্রাচ্যেরই যে কী অবস্থা হতো তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উগ্র সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ মার্কিন মদদপুষ্ট ওইসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী জামাতসহ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো এখনো নিশ্চিহ্ন হয়নি। বরং প্রধান প্রধান কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো এখন সরকারকে মরণকামড় দিতে চাইছে। আর এক্ষেত্রে এখনো তাদেরকে ব্যবহার করতে হচ্ছে ইসলামকেই। একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের এই অভূতপূর্ব জয়জয়কারের মধ্যেও সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার এ কী দুঃখজনক ঘটনাপ্রবাহ! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ধর্মের নামে এমন হাজারো মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। কারণ, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সাধারণ মানুষ চিরকালই শান্তিপ্রিয়। এখানকার জলবায়ু, প্রকৃতি, নদী-নালা, খালবিল, এখানকার ষড়ঋতুর বৈচিত্র ইত্যাদি সবকিছুই ধর্মের নামে সন্ত্রাসকে প্রত্যাখ্যান করেছে যুগে যুগে। এখানকার মানুষ সহজ-সরল, কোমল হৃদয়ের অধিকারী। এখানকার মাটিতে শায়িত রয়েছেন অসংখ্য সূফী-সাধক, মুনি-ঋষি-আউলিয়া-দরবেশ। এখানকার কবি বলেছেন, ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’। ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান’। ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ইশ্বর’। তাই এখানকার মানুষ মনুষ্যত্বকে জাগ্রত রাখতেই আনন্দ পায়। মনুষ্যত্বকে জাগ্রত রাখার মধ্যেই নিজেদের আদর্শ ধারণ করার চেষ্টা করে, মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এটাই তাদের ধর্ম। মানুষ হত্যাকারী, খুনী, ধর্মব্যবসায়ী তথা মানবতাবিরোধী শক্তিগুলো এদেশের সমাজে ঘৃণার পাত্র। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন