শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

সময়ের সাফ কথা.... রুগ্ন রাজনীতির কবলে জাতি!

সময়ের সাফ কথা....

রুগ্ন রাজনীতির কবলে জাতি!

নজরুল ইশতিয়াক ॥ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাজনীতির একটি রুগ্ন অবস্থা বর্তমানে জনগণকে দেখতে হচ্ছে। রাজনীতির নামে যা ইচ্ছা তাই দেখতে দেখতে জনগণের পীঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। রুগ্ন রাজনীতির ভয়ানক অবস্থা সামনে উঠে এসেছে। এটিই হবার কথা। যেমন কর্ম তেমন ফল। সন্ত্রাসী তৈরির প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রযাত্রা রুখতে আদর্শিক ও প্রগতিশীল রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে ও হচ্ছে। দেশি বিদেশি নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশপ্রেমিক জনগণের জাগরণতো দূরের কথা রাজনৈতিক দলগুলো কর্মী তৈরিতেও চরম অদক্ষতা আর অযোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সরকারও আদর্শ ভিত্তিক জাগরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। জান-মালের নিরাপত্তা সংকটময় অবস্থায়। গতানুগতিক গুজব ও কাল্পনিক রাজনীতির উত্থান ঘটছে। পাল্টে যাচ্ছে উন্নয়নের সংজ্ঞা, পাল্টে যাচ্ছে সন্ত্রাস ও জঙ্গী রাজনীতির ধারণা। কোন্ মন্ত্রী, কোন্ নেতা ও কোন্ রাজনীতিক কখন কি বলেন তা অনুধাবন করাও দুষ্কর হয়ে পড়ছে। কি করতে হবে, কিভাবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটবে তার কোন সঠিক দিক্ নির্দেশনা ও রূপরেখা নেই জাতির সামনে।
প্রস্তুতি ও অনুশীলন ছাড়াই খেলার মাঠে গোল দেয়া যাবে এমন একটি ধারণা নিয়ে বসে আছেন সরকারী দলের নেতাকর্মীরা। মাঝেমাঝে কিছু অন্তঃসারশূন্য হাকডাক শোনা যাচ্ছে আবার তা হারিয়ে যাচ্ছে প্রবাহমান বাতাসে। গোলকধাঁধায় পড়ছে জাতি।
দেশে কোন জঙ্গি নেই, কোন জঙ্গিবাদও নেই (সত্য)। সরকারের এমন প্রচারনার সুর পাল্টে গেছে দু’টি ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর। সংঘটিত দু’টি ঘটনার পরক্ষণেই প্রকারান্তরে জঙ্গি আছে কিংবা জঙ্গিবাদ কায়েমের চেষ্টা চলছে এটির সরকারী স্বীকারোক্তি আদায়ে সামর্থ্য হলো এতদিন যারা বলেছিলেন জঙ্গি আছে জঙ্গিবাদ চলছে। বোঝা যায় সরকার বাস্তবতাকে চিহ্নিত করেনি। জঙ্গি কি এবং কাকে জঙ্গিবাদ বলা যাবে সেটি তাদের জানা নেই এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাস জগাখিঁচুড়ি করে ফেলেছে। একই সাথে দেখা গেল সন্ত্রাস মোকাবেলায় প্রস্তুতির ঘাটতি। প্রশ্ন উঠতে পারে কি কারণে সরকার স্বীকার করলেন জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ চলছে! পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় দেশে একটি রাজনৈতিক সন্ত্রাস চলছে। মাঝে মধ্যেই দেশ পরিচালনায় সুষ্পষ্ট দিক্ নির্দেশনার অভাব দেখা যাচ্ছে। দারুন ধোঁয়াশা আর অন্ধকার জেঁকে বসছে। মনে হতে পারে পথ হারিয়ে ফেলেছে রাজনীতি। সরকারের তথ্য বিশ্লেষণ, অনুধাবন ও পর্যবেক্ষণ গতানুগতিক এবং সব অঙ্গগুলো প্রয়োজন মাফিক কার্যকর নয়। যাদেরকে যে দায়িত্বে রাখা হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে অনীহা চলছে। পুলিশি ব্যবস্থা সন্ত্রাসী আঘাত মোকাবেলায় যুগোপযোগী পারদর্শী নয়।
গতির পার্থক্য, দেখার দূরত্ব, বাস্তবতা নিরূপণের অযোগ্যতা প্রকট হয়ে উঠেছে। আরো স্পষ্টভাবে বললে পরিস্থিতি মোকাবেলার উপযোগী দক্ষ পুলিশি ব্যবস্থাপনার অভাব। কোন সংকটকে চিহ্নিত করার মধ্যেই তার সমাধান নিহিত থাকে, সামর্থ প্রস্তুতি পদক্ষেপ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হয়। ধর্মীয় জঙ্গিবাদ একটি ভুল শব্দ। এটির অন্তর্নিহিত সত্য উদঘাটন করলে দেখা যায় বর্তমান বিশ্বে জঙ্গিবাদের নামে যা সংঘটিত হচ্ছে তার নেপথ্যে বাণিজ্যে দখলদারিত্ব ও আধিপত্যবাদ জড়িত।
অন্ধ উগ্র বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলোকে ধর্মের নামে বিভাজিত করে লড়াইয়ে অবতীর্ন রাখা প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এমন একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করা যাতে করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অস্ত্র ব্যবসা এবং লুটপাটের মহাযজ্ঞ চালানো যায়। যতদিন এটি সম্ভব হবে ততদিন জিইয়ে রাখা। যা কিছু দেখছি ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া কোনটাই ধর্মীয় শাস্ত্রের মধ্যে পড়ে না। কৌশল-অপকৌশলের খেলায় ধরাশায়ী হয়েছে সে সব দেশগুলো। জাতীয়তাবোধের রাজনীতি তথা দেশপ্রেমিক শক্তির উত্থান না হওয়াই সংকটের কারণ। চলমান এসব খেলা বর্তমান সভ্যতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। পর্যবেক্ষণে সভ্যতার এই সংকটকে চিহ্নিত করা যায় যা বিশ্ববাস্তবতায় ক্ষত। আধিপত্যবাদের এই খেলা সব সময় চলছে। যেখানে ধর্ম ও দারিদ্রতা কেবলই খেলার হাতিয়ার।
অনুসন্ধানে দেখা যায় দেশের সামনের অগ্রগতি ও হুমকির বিষয়ে মাঝে মধ্যে আলোচনা হলেও সে সব নিয়ে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সরকারে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয় ধর্ম, সংস্কৃতি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাংলার মাটি-পানি-বাতাস-মানুষ পর্যালোচনা করে সময়োপযোগী কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেনি।
ফলে উদ্ভূত সংকট ভয়াবহ রূপে সামনে এসে পড়েছে। বিশেষ করে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে উপেক্ষা করার পরিণতি সরকার হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে। সীমাহীন স্থবিরতা চলছে ধর্মমন্ত্রণালয়ে। এই মন্ত্রণালয়ের কোন প্রতিষ্ঠান ঠিকমত কাজ করছে না। ফলে বুমেরাং হয়ে প্রত্যাঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে গোটা দেশ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় লোক দেখানো কাজের কাজী আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির আখড়া। কোন অর্জন নেই এই মন্ত্রণালয়ের বরং অদূরদর্শীতার ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে। কোন নজরদারি নেই, কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কেবলই গলাবাজি সেখানে। উল্লেখিত মন্ত্রণালয়-গুলোর ওয়েব সাইট কোন সময় আপডেট থাকে না। তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোন সমন্বয় নেই। জবাবদিহিতা নেই। 
ধর্মের নামে সব সন্ত্রাসীতৎপরতার মূলে ষড়যন্ত্র রয়েছে। যাকে যখন যে কায়দায়, যে দক্ষিণায়, যে ফাঁদে - লোভে ফেলে লুটপাট করা যায় সে প্রচেষ্টাই শুধু চলে। সেক্ষেত্রে পরিকল্পনাকারীরা এখন পর্যন্ত দারুন সফল, কেননা ইসলামের নামে সন্ত্রাস কায়েমে তারা বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্ট সন্ত্রাসের মূল উদ্দেশ্য সেখানে সৌদী আরব ও আমেরিকার আধিপত্য বজায় রাখা ও বিস্তার করা। বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সম্পূর্ণ পরিকল্পিত  খেলা চলছে সেখানে। সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ষ্পষ্টতই দু’টি বৃহৎ বিভাজন জিইয়ে রাখবে। যা আরো আগে ঘটলে বিশ্বে সন্ত্রাসের জোয়ার দেখা দিতো না। মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু থেকেই রয়েছে। সন্ত্রাসীদের হাতে অর্থ, অস্ত্র, ভূমি, জল-জলাধার, পতাকা, লক্ষ্য, যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ ও শাসন কাঠামো রয়েছে। সেখানে তারা একটি নাজুক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে তাই এটাকে জঙ্গিবাদ (যুদ্ধবাদ) বলা যেতে পারে।কিন্তু আমাদের দেশে যা হচ্ছে তা জঙ্গিবাদ নয়। এটির পিছনে রাজনীতির ষড়যন্ত্র, বিচার প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়া এবং সরকারকে বাধ্য করার প্রচেষ্টা জড়িত।
গুলশান কিংবা শোলাকিয়ার ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি পরিকল্পিত সন্ত্রাসী কার্যক্রম। মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ এবং রুগ্ন রাজনীতির ষড়যন্ত্র এ হামলার কারণ। পরিকল্পিত সন্ত্রাস সৃষ্টির অবারিত সুযোগ রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে কতটুকু করতে পারবে, কারা ক্রীড়নক হবে, এটি চিহ্নিত করাটাই জরুরী। দৃষ্টান্ত স্থাপনের রাজনীতি, দেশপ্রেমের অভিন্ন আদর্শিক পথ, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি ও শিক্ষার আড়ালে নানামুখি যে বিভাজন বৈষম্য সৃষ্টি করেছে সে সব বিভাজনের ফাঁক দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি একটি সহজ কাজে পরিণত হয়েছে। এটি রাজনীতিকদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। গুলশানে সন্ত্রাসীরা চোখ এড়িয়ে ঢুকে পড়েছে। তারা কিভাবে কোন গাড়িতে সেখানে প্রবেশ করেছে, চেকপোষ্টে কেন তল্লাসীতে এসব ভারি অস্ত্র বোমা ধরা পড়লো না এটি নিরূপণ বেশি জরুরি। আবার তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য কি ছিল, কতটুক ছিল, কাদেরকে হত্যা করে, কখন কিভাবে বের হয়ে যাবে সেসব জানার মধ্য দিয়ে  হামলার স্বরূপ নির্ণয় হতে পারে। এসব নানা দিক  চিহ্নিত করে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে ব্যর্থ হওয়ায় গুলশান হত্যাকাণ্ড জনমনে আতংক সৃষ্টি করেছে। এটি সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়। ভিন্নধর্মী বিদেশী বন্ধু ও নারীদেরকে নির্মমভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার বিভৎসতা প্রমাণ করে হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা ও উদ্দেশ্য। যা গুমোট একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সহায়ক।
অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যায় পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটানোর মাধ্যমে সরকার উৎখাতের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। সরকারের দুর্বলতার সুযোগে সহজেই একটি রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় সন্ত্রাসীদেরকে দিয়ে এসব করছে। তাদের আশু লক্ষ্য আইন শৃংখলার চরম অবনতি ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। সরকার অস্থির হলে সৃষ্ট সংকট সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপে অংশগ্রহণ করা যাবে। সেখানে কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায়ে সরকারকে বাধ্য করা সম্ভব হবে।
নিশ্চিতভাবে দু’টি ঘটনা প্রমাণ করে সরকারের যথাযথ প্রস্তুতির ঘাটতি আছে। পরিস্থিতি মূল্যায়ণ তথা বাস্তবতা অনুধাবনেও সীমাহীন অদূরদর্শীতার চিত্র ফুটে উঠেছে। একই সাথে পুলিশ-প্রশাসনের প্রশিক্ষণ, কাজে গতি বাড়ানোয় সরকারযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা সামনে এসেছে। সরকার বাস্তবতা অনুধাবনে দূরদর্শীতার প্রমাণ দিতে পারেনি। তারা অনুধাবন করেনি ষড়যন্ত্রের ডালপালা কতটুকু বিস্তৃত এবং তা মোকাবেলায় জনগণকে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। বৈদ্যুতিন মাধ্যম যেন বল্গাহীন ঘোড়ার মতো ছুটছে, পুরো পরিস্থিতিকে জটিল করছে যা গণমাধ্যম সংস্কৃতির রুগ্ন ও ক্ষত দিকটা জনগণ দেখেছে। 

দেশে জাগরণ সৃষ্টিতে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে এবং সেগুলোর সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা কতটুকু সেটিই এখন দেখার বিষয়। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে ক্ষমতা দখলের খেলায় একটি সরকার কিংবা একটি দল ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ কখনো পরাজিত হয় না। দেশপ্রেমিক জনগণ দেশের জন্য যা করা দরকার তাই করে। সরকারের সফলতা নির্ভর করছে উদ্ভুত ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় জনগণকে কতটুকু সম্পৃক্ত করতে পারছে তার উপর। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন