বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০১৫

মৃত্যু বলে কিছু নেই, আছে রূপান্তর


মৃত্যু বলেকিছু নেই, আছে রূপান্তর
অনন্ত অসীম স্রষ্টা, অ-জর অ-মর

সংলাপ ॥ জীবনের সত্য-সোপান ধরে যাঁরা রেখে যান কর্মে ও মর্মে জাগ্রত জীবনের অনুধ্যান-তাঁদেরই একজন মোঃ সিরাজুল ইসলাম। কর্ম-মানবতা-শান্তির উত্থিত পতাকা হাতে ধাবমান হাক্কানী মিশন বাংলাদেশে-এর আদর্শে ও কর্মে তিনি ছিলেন একাত্ম। তাঁর অকৃত্রিম আন্তরিকতা, সময়নিষ্ঠতা ও কর্তব্য সচেতনতা তাঁকে অধিষ্ঠিত করিয়েছিল হাক্কানী মিশন বাংলাদেশে-এর মহাসচিব পদে। মিশন প্রকাশিত পত্রিকা - বর্তমান সংলাপ-এর জন্মলগ্নে সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি পদেও তাঁর মহান কর্মানুশীলনের স্বাক্ষর রেখেছেন।
১৯২৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ৩ মাইল দূরে পয়াগ গ্রামে এই মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম। তাঁর পিতা আলহাজ্ব মোঃ সেকান্দর আলী ছিলেন পয়াগ গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার। তিনিও ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, কর্মঠ, বিচক্ষণ ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি। ছয় ছেলে ও চার মেয়ে মোট দশ সন্তানের জনক হয়েও তিনি প্রত্যেককেই নিজ আদর্শে অত্যন্ত যত্ন সহকারে মানুষ করেছেন। ভাইদের মধ্যে সিরাজুল ইসলাম ছিলেন সবার বড়। বাবার স্কুলেই তিনি প্রাইমারী শিক্ষা নেন। তখনকার যুগে চতুর্থ শ্রেণী ও ষষ্ঠ শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা হত। তিনি চতুর্থ শ্রেণীতে বৃত্তি পান। প্রাইমারী স্কুল শেষ করে তিনি ভর্তি হন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিখ্যাত অন্নদা হাইস্কুলে। উল্লেখ্য যে, ঐ স্কুলে তখন ৩/৪ জন ছাড়া অন্য সবাই ছিল হিন্দু ছাত্র। হাইস্কুলের প্রথম দিনেই একজন মুসলমান ছাত্র হিসেবে অংক ক্লাসে সবগুলো অংক বোর্ডে করতে পারায় তিনি সকল ছাত্র ও শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ষষ্ঠ শ্রেণীতেও তিনি বৃত্তি পান। মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হতেন। ক্লাস নাইনে উঠে তাঁকে হোস্টেলে থেকে, অন্যের বাড়িতে জায়গীর থেকে পড়ালেখা চালাতে হয়। অনেক কষ্টের পরও তিনি মেট্রিকে প্রথম শ্রেণীতে পাস করেন ১৯৪৩ সালে। এরপর তাঁর প্রবল ইচ্ছা ছিল ঢাকায় গিয়ে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পড়বেন। কিন্তু তাঁর বাবা বললেন, “তোমার মামা সাতবার পরীক্ষা দিয়ে আইএসসি পাস করেছে। তুমি আই.এ. পড়বে।” ভয় এবং ভালবাসার মিশ্রণে পিতৃভক্ত তিনি বাবার কথা মেনে নিয়েছেন ছল ছল চোখে। ১৯৪৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর তিনি ঢাকা ভার্সিটিতে অর্থনীতিতে ভর্তি হন। অর্থনীতিতে অনার্স করে মাষ্টার্স শেষ করেন ১৯৪৯ সালে। এ সময় তিনি সলিমুল্লাহ হলে থাকতেন। এরপর তিনি চট্টগ্রামে এক প্রাইভেট কলেজে অধ্যাপনার চাকুরি নেন।
১৯৫২ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাওয়াট নিবাসী বিশিষ্ট সমাজসেবী আব্দুল হামিদ ভূঁইয়ার ৩ ছেলে, ২ মেয়ের অর্থাৎ মোট ৫ ছেলে-মেয়ের সবচেয়ে বড় মেয়ে বেগম শামসুন্নাহারের সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। বেগম শামসুন্নাহারও ছিলেন শিক্ষিতা এবং চাকুরিজীবী। (ঢাকা ভার্সিটিতে পলিটিক্যাল সাইন্সেসে এমএ তে অধ্যায়নরত অবস্থায় তিনি বিটিটি করে ঢাকা কামরুন্নেসা সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরি নেন। পরবর্তীকালে তিনি বিভিন্ন স্কুল ঘুরে সবশেষে ওই স্কুল থেকে ১৯৮৭ সালে হেড মিসট্রেস পদ থেকে দীর্ঘ চাকুরি জীবনের অবসর নেন।)
তাঁদের সাংসারিক জীবন সুখেরই ছিল। দু’জনেরই শিক্ষিত মননশীলতার দ্বারা তাঁদের ১ ছেলে ৩ মেয়েকে শিক্ষা-দীক্ষায় বড় করে তোলেন। বর্তমানে সিরাজুল ইসলামের একমাত্র ছেলে সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার আমেরিকায়। ছোট মেয়ে ডাঃ মিমিও আমেরিকায় অবস্থান করছে। অন্য মেয়ে দু’জন ঢাকাতেই থাকে। বড় মেয়ে ডাক্তার শাহীন শাহরিয়ার ও মেঝ মেয়ে শামীম শাহরিয়ার।
অধ্যাপনার পর তিনি ঢাকায় কৃষি ব্যাংকে ম্যানেজার পদে চাকুরি পান ১৯৫৭ সালে। এই কৃষি ব্যাংকেই কাটে তাঁর চাকুরি জীবনের দীর্ঘ ৩০ বছর। পদোন্নতি হতে হতে এক সময় তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘জেনারেল ম্যানেজার’ হন। ১৯৮৬ সালে তিনি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। চাকুরি ক্ষেত্রে তিনি সুনামের অধিকারী ছিলেন। তাঁর অমায়িক ব্যবহারে অধীনস্ত ও সহকর্মীরা বিরোধে নামার সুযোগ পায়নি কখনো। বরং মানুষকে আপন করে নেবার স্বভাবজাত গুণে তিনি প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁর হৃদয়ের গভীর মমত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায় সামান্য রাস্তার কুকুর গুলোকে প্রতিদিন দু’বেলা রুটি, ভাত লুকিয়ে খাওয়ানোয়। চাকুরিকালীন গরু পালনেও তার পশুপ্রীতি দেখা  যায়।
সন্তানদের প্রতি যোগ্য অভিভাবকত্বের গুণে তিনি প্রত্যেককেই যথার্থ শিক্ষায় গড়ে তুলেছেন। বরাবরই তিনি সন্তানদের প্রতি বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করতেন। প্রত্যেকের লেখা-পড়ার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। নিজের জীবনের অপূর্ণ সাধ তিনি পূরণ করেন ছেলে-মেয়েদের ভিতর দিয়ে। তাঁর দু’মেয়ের ডাক্তার হওয়ার পিছনে এই উদ্দীপনা কাজ করেছিল। সেই সাথে আরো ছিল তাঁর স্বভাবে লালিত পরোপকারের সুতীব্র বাসনা। ইতিবাচক চিন্তায় তিনি নিজে যেমন কখনো হতাশ হতেন না, সন্তানদেরকেও সেই শিক্ষা দিতেন। সন্তানদের কাছে তাই তিনি ছিলেন আদর্শ পিতা। ১৯৯১ সালের ২৪ অক্টোবর হাক্কানী মিশন বাংলাদেশ-এর সদস্য লাভের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে আরো একধাপ এগিয়ে নেন ‘সেবাপরায়ণ’ হিসেবে। কর্মে বিশ্বাসী তিনি খুব সহজেই তাঁর উন্মুক্ত মানসিকতায় হাক্কানী মিশনের কর্মকান্ডের সাথে একাত্ম হয়ে ওঠেন। তাঁর কর্মস্পৃহা যোগ্য নেতৃত্ব এবং মিশনের প্রতি প্রগাঢ় ও নিরবিচ্ছিন্ন ভালবাসায় অকৃত্রিম ভূমিকা রেখে ১৯৯২ সালে মিশনের মহাসচিব পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। মহাসচিব পদেই তিনি জীবনের অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে গেছেন। হাক্কানী মিশন বাংলাদেশ পরিচালিত হাক্কানী বিদ্যাপীঠ, হাক্কানী ফ্রি ফ্রাইডে ক্লিনিকসহ মিশনের প্রতিটি কর্মকান্ডেই ছিল তাঁর সফল অংশগ্রহণ। তাঁর কর্মময় স্মৃতিকে ধারণ করে হাক্কানী মিশন বিদ্যাপীঠ আজ হাক্কানী মিশন মহাবিদ্যালয়ে উন্নিত হয়েছে এবং হাক্কানী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে; বর্তমান সংলাপও রূপ নিয়েছে সাপ্তাহিকে। প্রখর সময় সচেতন ছিলেন তিনি। মিশনের প্রত্যেক সভা, অনুষ্ঠানে তাঁর নিয়মিত ও সঠিক সময়ের উপস্থিতি সেই স্বাক্ষরই দেয়।
শিশুর মত সারল্যতা দিয়েই তিনি সবার সাথে মিশেছেন বয়সের বিভেদ না টেনে। তাঁর নিরহংকার মনে ছিল মানুষের প্রতি গভীর বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের সোপান ধরেই তাঁর কর্মনিষ্ঠতা তাঁকে মুক্তির সত্যতায় উপনীত করেছিল। মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটিয়ে দিক-নির্দেশনা দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন ১৯৯৪ সালের ৮ জুলাই শুক্রবার রাত ১১-৩০ মিনিটে, মিশন কর্মীদের কাছে তিনি এক অবিস্মরণীয় সত্তা হয়ে ছিলেন-আছেন-থাকবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন