বৃহস্পতিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৫

ভারতবর্ষ ভাগ না হলে!



ভারতবর্ষভাগ না হলে!

সংলাপ॥ ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ জাপানের আত্মসমপর্ণের সাথেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। যুদ্ধোত্তর ব্রিটেনে তখন শ্রমিক দলের সরকার ক্ষমতাসীন ছিল। ক্লিমেন্ট এটলি সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ব্রিটেনের সরকার ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়ে। সে জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশন ভারতে পাঠানো হয়। সেই তিন সদস্যরা ছিলেন- লর্ড পেথ্রিক লরেন্স, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস্‌ ও মিঃ এ. ডি. আলেক্সজান্ডার। ক্যাবিনেট মিশনের পক্ষ থেকে ১৬ই মে ১৯৪৬ এক ঘোষণায় জানানো হয়- পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে মুসলিম লীগের দাবী অনুযায়ী পাকিস্তান সৃষ্টি করলেই সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হবে না। সেটাকে মাথায় রেখেই ক্যাবিনেট মিশন ভারতের অখণ্ডতা বজায় রেখে ক্ষমতা হস্তান্তরের এক পরিকল্পনাতৈরী করে। সেটিই ইতিহাস খ্যাত ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান। তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আজাদ ছিলেন তার রূপকার। প্ল্যানের এক নম্বর সুপারিশ ছিল-ব্রিটিশ ভারত ও করদ রাজ্যগুলো নিয়ে একটিই ভারত ইউনিয়ন গঠিত হবে। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ এই তিনটি দপ্তরই শুধু ইউনিয়ন সরকারের হাতে থাকবে। উক্ত তিনটি বিষয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের ক্ষমতাও ইউনিয়ন সরকারের হাতে থাকবে। বর্ণিত তিনটি বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয় তথা উদ্বৃত্ত ক্ষমতা থাকবে প্রদেশ সমূহের।
প্রদেশগুলো এ-বি-সি এই তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ সংবিধানতৈরী করবে। প্রস্তাবিত তিনটি গ্রুপের এ-গ্রুপ ছিল অমুসলিম প্রধান প্রদেশগুলো নিয়ে। বি-গ্রুপ ছিল মুসলিম প্রধান প্রদেশগুলো নিয়ে। বাংলা ও আসাম নিয়ে ছিল সি-গ্রুপ। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানে ইউনিয়নস্তরে পাকিস্তান দাবী-আগ্রাহ্য হলেও-প্রদেশ স্তরে মুসলিম লীগের দাবী অনেকটাই মানা হয়ে যায়।
যে কয়টি প্রদেশ নিয়ে মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবী করছিল- ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যনে আসাম সহ তার সব কয়টিই দুটি গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হয়। (গ্রুপ-বি ও গ্রুপ-সি)। ওই সব প্রদেশের স্বতন্ত্র সংবিধান তথা শাসন ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার বিষয়টা সুস্পষ্ট অবস্তুায় আসাতে মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ করে।
(Mr. Jinnah had to admit that there could be no fairer solution of the minority problem than that presented in the Cabinet mission plan. He told the Council that the scheme presented by Cabinet mission was the maximum that we could secure. As such, he advised the muslim league to accept the scheme and the Council voted unanimously in its favour. India wins freedom. Revised version)
মুসলিম লীগ স্বতন্ত্র পাকিস্তান দাবী থেকে সরে আসায় দেশব্যাপী স্বস্তির বাতাবরণতৈরী হয়। কিন্তু সেই স্বস্তির ছিল বিজলীর ক্ষণিক চমকের মতো ক্ষণস্থায়ী। গ্রুপ সি-তে বাংলা ও আসাম যুক্ত হলে মুসলিম জনসংখ্যা সামান্য বেশী হয়ে যেত। হিন্দু গরিষ্ঠ আসামের কংগ্রেস নেতৃত্ব ওই রকম গ্রুপিং-এ অন্তর্ভুক্ত হয়ে সংখ্যালঘু হতে রাজী ছিলেন না। এ বিষয়ে জাতীয় কংগ্রেসের ব্যাখ্যা ছিল-ক্যাবিনেট মিশন পস্ন্যান অনুযায়ী প্রদেশগুলো ইচ্ছে করলে গ্রুপিং থেকে বের হয়ে যেতে পারে। মুসলিম লীগের ব্যাখ্যা ছিল তার বিপরীত। লীগের মতে একবার গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হলে আর বের হওয়া যাবে না। এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের অভিমত মুসলিম লীগের পক্ষে যায়। এই টানাপোড়েনের ফলে শেষ পর্যন্ত ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান পরিত্যক্ত হয়। পরবর্তী ইতিহাস ক্ষমতা হস্তান্তরের অনিৱম অধ্যায়। সেই অধ্যায়টি ছিল বেপরোয়া ক্ষিপ্রগতির। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ সরকার নিঃসন্দেহ হয়ে যায়- ভারত বিভাগ এড়ানো যাবে না। পরবর্তী ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন। ভারতে আসার আগেই মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়সীমা বেঁধে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের নিকট আর্জি জানান। এটলি সরকার সেই মতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইঙ্গিত দেন- ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে। মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসেন ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে। ভারত ভাগ এড়াতে মাউন্টব্যাটেন এক অদ্ভুত প্রস্তাব উপস্তুাপন করেন। সেটি ‘প্ল্যান বলকান। তার সারমর্ম ছিল- ইউরোপের বলকান দেশগুলোর মতো ক্ষমতা হস্তান্তর করা। মাউন্টব্যাটেনের পূর্বসূরী লর্ড ওয়াভেলও ‘অপারেশন ব্রেকডাউন নামে একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিলেন। তাতে ভারতকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে সে সব অঞ্চলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা ছিল। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দল দ্বারাই ওই অবাস্তব পরিকল্পনা দুটি বাতিল করা হয়। প্রকৃতপক্ষে অপারেশন ব্রেকডাউন ও পস্ন্যান বলকান দুটিই ছিল ‘আই ওয়াশ্‌’ গোত্রীয়। ব্রিটিশ সরকার আন্তরিকভাবেই ভারত বিভাগ চায় না- এরকম একটা ভনিতার প্রয়োজনে ওই অবাস্তব পদক্ষেপ দুটি নেয়া হয়েছিল। ক্যাবিনেট মিশন পস্ন্যান, অপারেশন ব্রেকডাউন ও প্ল্যান বলকান ফলপ্রসূ না হওয়ায় দেশবিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকারের সেই প্রকৃত অভিপ্রায়কে ফলতি রূপ দিতে মাউন্টব্যাটেন এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন। মাউন্টব্যাটেন জানতেন- কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে মুসলিম লীগ সুপ্রিমো জিন্নার যে সুদীর্ঘ টানাপোড়েন চলছে তাতে উভয় অংশই ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁদেরধৈর্যচ্যুতি ক্রমশই বাড়ছে। তা পরিলক্ষিত করে মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তর দশ মাস এগিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট করায় কৌশল নিলেন। সেটাকে সন্দেহ মুক্ত তথা বিশ্বাসযোগ্যতা দিতে মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস নেতৃত্বের সামনে একটি ‘টোপ’ রাখেন।
সেটি ছিল- কংগ্রেস যদি কমনওয়েলথে থাকতে প্রথমাবধিই রাজী থাকে তা হলে ক্ষমতা হস্তান্তর দশ মাস আগেই হবে। চরমধৈর্যচ্যুত কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব তাতে রাজী হয়ে যান। মুসলিম লীগের কমনওয়েলথে থাকতে প্রথমাবধিই আপত্তি ছিল না। তাছাড়া পাকিস্তান হাতের মুঠোয় চলে আসায় জিন্না আর দর কষাকষিতে না যাওয়াই ভাল মনে করেন। তাই খন্ডিত ও পোকায় খাওয়া (জিন্নার ভাষায়) পাকিস্তানেই রাজী হয়ে যান। জিন্নার রাজী হবার আরেকটি গুরুতর কারণ ছিল। আর কেউ না জানুক জিন্না নিজে জানতেন তাঁর দূরারোগ্য ক্ষয়রোগ হয়েছে। চিকিৎসক তাঁকে জানিয়েছেন, তিনি আর ছয় মাস বাঁচবেন। জিন্না এটাও জানতেন তিনি যদি পাকিস্তান সৃষ্টি করে না যেতে পারেন তা হলে পাকিস্তান বাস্তবায়িত হবে না। ভারত উপমহাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের ধৈর্যচ্যুতির সুযোগটাকে কাজে লাগাতে মাউন্টব্যাটেন ঘড়ির কাঁটাকে এগিয়ে আনেন। এতেই তাঁর তথা ব্রিটিশ সরকারের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। মাউন্টব্যাটেনের কৌশল মাফিকই ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট মধ্য রাতে দেশ বিভাগ, ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারত ও পাকিস্তান দুটি ডমিনিয়নের সৃষ্টি হয়। ক্যাবিনেট মিশন পস্ন্যান ব্যর্থ হলে ওয়াভেল ও তাঁর উত্তরসুরী মাউন্টব্যাটেন দেশের শাসনব্যবস্তুা অচিরেই ভেঙ্গে পড়বে-এরকম একটা ‘জু জু’ বার বার সামনে নিয়ে আসছিলেন। সেটা তাঁরা জ্ঞাতসারেই করছিলেন-যাতে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃবর্গ তড়িঘড়ি সিদ্ধানেৱ উপনীত হন। কার্যতঃ তাই হয়েছিল।ধৈর্যচ্যুত কংগ্রেস নেতৃত্ব ধরতে গেলে মাউন্টব্যাটেনের নিকট আত্মসমর্পণই করেছিলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের ‘স্টিয়ারিং’ মাউন্টব্যাটেনের হাতেই সঁপে দেয়া হয়েছিল। ব্যতিক্রম ছিলেন গান্ধীজী ও মৌলানা আজাদ। দেশবিভাগের বিরুদ্ধে দু’জনেরই দৃঢ় অবস্থান ছিল। গান্ধীজী বলেছিলেন, শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ুক বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হউক- ‘আমরাই সব সামলাব’। মৌলানা আজাদ বলেছিলেন- সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানে দেশ ভাগ খুবই ভুল সিদ্ধান্ত। তার চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করাটাই শ্রেয়। মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসেন ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে। তার পাঁচ মাসের মধ্যেই দেশভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। যদি ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়সীমা পূর্ব ঘোষিত সময়সীমা অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের জুন মাসে থাকত তাহলে ততদিনে জিন্নার মরণব্যাধির কথা চাপা থাকত না। সেরকম পরিস্থিতিতে কংগ্রেস নেতৃত্ব অবশ্যই অপেক্ষা করতেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিই তাঁদের অপেক্ষা করার জন্য বাধ্য করত। ভারতকে অবিভক্ত রাখতে জিন্নাই ছিলেন বড় কাঁটা। জিন্নার মৃত্যু হলে মুসলিম লীগের নিকট পাকিস্তান অধরা থেকে যেত। তখন ভারত উপমহাদেশে স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশকে অন্য কিছু ভাবতে হতো। জিন্নার দূরারোগ্য ব্যাধির কথা জানতেন বলেই কি মাউন্টব্যাটেনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ক্ষিপ্রগতি? সেটা আজও রহস্যাবৃত। মাউন্টব্যাটেনের বিতর্কিত প্রয়াস সমূহও ভেসেৱ যেত যদি কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব আর কিছুদিনধৈর্য ধরতেন। কিন্তু ভবিতব্যকে এড়ানো গেল না। ভাগ হয় ভারত। ভাগ হয় বাংলা। ভাগ হয় পাঞ্জাব। ভারতের অখণ্ডতা বজায় রাখতে সাম্প্রদায়িক সমস্যাই ছিল প্রধান অন্তরায়। সেটাকে হাতিয়ার করেই জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের সূত্র এবং পাকিস্তান দাবী। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানে মৌলানা আজাদ ভবিষ্যৎ ভারতের রূপরেখা এতই নিপুনভাবে এঁকেছিলেন যে, মুসলিম লীগও তা গ্রহণ করে। নিয়তির পরিহাসই বলা যায়- মৌলানা আজাদের বহু পরিশ্রম সাধ্য ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ‘মেঘাচ্ছন্ন আকাশে রূপালী রেখার’ মতো দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। যদি ক্যাবিনেট মিশন পস্ন্যান অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরিত হতো তাহলে স্বাধীনোত্তর ভারতের ভৌগোলিক তো বটেই সে সাথে সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সর্বোপরি আর্থ সামাজিক পরিকাঠামো ভিন্ন রূপ নিত। সে ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধান হতো অন্য ধরনের। তাতে বর্তমান সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা বিলাতের ওয়েস্টমিনিস্টার ধাঁচের সরকারের ঠাঁই হতো না। বাস্তব কারণেই অখ- ভারতের নিকট আমেরিকার শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাই বেশী গ্রহণীয় হতো। সে সূত্রে রাষ্ট্রপতিপ্রধান সরকারের সম্ভাবনা বেশী ছিল (জনগণ দ্বারা নির্বাচিত)। দেশ বিভাগের সময় ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল চব্বিশ শতাংশ। পাঁচটি প্রদেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। যদি ভারত ভাগ না হতো তাহলে বর্তমান কাশ্মীরকে নিয়ে সেই সংখ্যাটা ছয় দাঁড়াত। যদি ভারত অখণ্ড থাকত তাহলে বর্তমান মুসলিম জনসংখ্যা হতো ২৭/২৮ শতাংশ। দেশভাগের ফলে সেই সংখ্যাটা বর্তমানে ১৪ শতাংশ। যদি ভারত অবিভক্ত থাকত-তাহলে ছয়টি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং দেশের মোট জনসংখ্যার ২৭/২৮ শতাংশ হওয়ার সুবাদে মুসলিমদের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়ে যেত। দেশবিভাগের ফলে একদিকে ভারতের মুসলিমরা যেমন পূর্বাপেক্ষা দুর্বল সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন তেমনি পাকিস্তানে হিন্দুরাও।
তাই উভয় রাষ্ট্রেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চরম ব্যাধিরূপে ঠাঁই নেয়। দ্বিজাতিতত্ত্বকে মান্যতা তথা স্বীকৃতি দিয়ে দেশটা ভাগ হয়। সেটা ছিল সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেবার নামান্তর। পরিণাম স্বরূপ ক্ষমতা হস্তান্তরের পঁয়ষট্টি বছর পর্যন্ত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সময় সময় ছোবল মারতে থাকে। যদি ভারত ভাগ না হতো তাহলে জনবিন্যাসের যে ভারসাম্য দাঁড়াত, সেটা অনেকাংশেই সাম্প্রদায়িক সুস্থিতির রক্ষাকবচ হতো। পাকিস্তান প্রসঙ্গ না থাকলে এ দেশের হিন্দু-মুসলিম হৃদ্যতা ও ঐক্যের বুনিয়াদ অনেক দৃঢ় হতো। অখ- ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবস্থান বিশ্বের প্রথম সারিতে থাকত। যেহেতু যুদ্ধের উন্মাদনা থাকত না তাই প্রতিরক্ষা ব্যয় আনুপাতিক হারে অনেক হ্রাস পেত। সেই অর্থ দেশের দারিদ্র দূরীকরণে ব্যয়িত হতে পারত। যদি দেশ ভাগ না হতো তাহলে বিশাল ভারতীয় রেল আরও বিশালত্ব পেত। রাজধানী এক্সপ্রেস ছুটে চলত লাহোর, ইসলামাবাদ, করাচী, পেশোয়ার, কোয়েটা অভিমুখে। চলত ফ্রন্টিয়ার মেল, সিন্ধ এক্সপ্রেস। পূর্ব প্রানেৱ ট্রেন ছুটে চলত শিয়ালদহ থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোহর, রংপুরসহ প্রায় সারা পূর্ববঙ্গে। সে সাথে ত্রিপুরা ঘেঁসে চালু থাকত আগেকার সেই আসাম বেঙ্গল রেল। চলত সুরমা মেল। দেশভাগের আগে ভারতের শিল্প-সংস্কৃতি একদিকে ছিল লাহোর কেন্দ্রিক অন্যদিকে কলকাতা কেন্দ্রিক। যদি দেশভাগ না হতো তাহলে লাহোরের গৌরবময় ভূমিকার ছোঁয়ায় ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতি আরও অনেক সমৃদ্ধ হতো। তেমনি পূর্ব প্রান্তে বঙ্গ সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্তুান কলকাতা তার অতীত গৌরবকে আরও মহিমান্বিত করতে পারতো।
খেলাধূলার ক্ষেত্রে ভারতীয় ক্রিকেট দলগুলো হতো দূর্ধর্ষ (প্রজন্ম পরম্পরায়)। পর্যটন ক্ষেত্রে যুক্ত হতো সিন্ধু সভ্যতার সেই মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা, প্রাচীন শিক্ষাঙ্গন তক্ষলীলা, খাইবার গিরিপথ ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র তীর্থ স্থান নানকানা সাহিব (শুরু নানকের জন্মস্থান)। বর্ণিত বিষয়গুলো কল্পনার জাল বুনে সৃষ্টি করা নয়। সেগুলো আমাদের ছিল মাউন্টব্যাটেনের রহস্যময় তাড়াহুড়ো ও জাতীয় নেতৃবর্গের অবিমৃশ্যকারিতায় আমরা সে           সব হারিয়েছি। চিন্তাবিদদের মানসপটে তারই প্রতিচ্ছবি বার বার ফুটে উঠে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন