বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬

শরতে - হেমন্তে বাংলার এক নতুন রূপ

শরতে - হেমন্তে বাংলার এক নতুন রূপ

শাহ্ ফুয়াদ ॥ বাংলা মাস বর্ষা-শরৎ-হমন্ত আর খ্রীষ্টিয় মাস আগষ্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর সম-সাময়িক। সেইন্ট গ্রেগারি প্রবতির্ত গ্রেগারিয়ান ক্যালেণ্ডার বাঙালির বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের জীবনে এক অদ্ভূত ও আশ্চর্যজনক প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে, যার পরিণতিতে এ সমাজে বাংলা পঞ্জিকার ব্যবহার আজ হয়ে উঠেছে দুর্লভ। তবু বাংলার মানুষের ওপর এর প্রকৃতি, জলবায়ু, আবহাওয়া এমনই এক প্রভাব সৃষ্টি করে রেখেছে যা কোনভাবেই যেন  ছেদ হওয়ার নয়। কত অপচেষ্টা ষড়যন্ত্র চলেছে, চলছে বাঙালিত্ব, বাঙালিয়ানাকে ভুলিয়ে দিতে। কিন্তু তা কি কোনোদিন সম্ভব?  যেখানে রয়েছে ৫২’ আর ৭১’। বাঙালি তাই চিরকাল বাঙালিই থাকবে। বাঙালিত্ব ভুলে গিয়ে, বাঙালিত্ব ভুলিয়ে দিতে, বাঙালিত্ব বিসর্জন দিয়ে যে-ই অন্যকিছু হতে যাবে সে এখানে পথ হারাবেই। বাঙালিকে ধর্মের নামে মুসলমান, হিন্দু, পাকিস্তানী, আফগান, আরবী বা শিক্ষার নামে ইংরেজ বা ইউরোপীয় বানাবার চেষ্টা যতই হোক না কেন তা যে দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাংলার মাটিতে ধর্মের নামে সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়ে যারা রাজনীতি করতে চেয়েছে, অবৈধ পন্থায় ক্ষমতায় গিয়ে বাঙালির চেতনাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদেরকে মন্ত্রী বানিয়েছে, তারা যে দিন দিন আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। বাঙালির সত্য দিন দিনই নতুন করে উদ্ভাসিত হচ্ছে। ‘বিশ্বাসঘাতকেরা নিজ নিজ কামনায় ধরা পড়ে’-হাক্কানী সাধক-এঁর বাণী সাধারণ মানুষদের কাছে সত্য হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। জঙ্গিপোনা চাষের জন্য বাংলার মাটি উপযুক্ত জায়গা নয়, বাংলার মাটি যে খুবই শক্ত। এসবেরই ধারাবাহিকতায় বাঙালির জীবনে, বাংলার প্রকৃতিতে প্রতি বছর বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত আসে। সচেতন এরই সাথে সাথে প্রতিটি বাঙালিকে করে দিতে ১৯৭৫’এর  দুঃসহ ১৫ আগষ্ট, খন্দকার মুশতাক আহমেদের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বগ্রহণ, ২৪ আগষ্ট মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর স্থলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নতুন সামরিক প্রধান হিসেবে নিয়োগ, ১ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্টের আদেশ বলে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) পদ্ধতি রহিত করা, ৫ অক্টোবর এক অর্ডিন্যান্স বলে রক্ষীবাহিনী বাংলাদেশ আর্মিতে একীভূত, ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় ৪ নেতা হত্যা, সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহীদের ঘটনায় কয়েক জন শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তা নিহত, জিয়াউর রহমানের প্রত্যাবর্তনকে জাসদ কর্তৃক স্বাগত জানানো, বেতার ঘোষণায় জিয়াউর রহমানের চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্বভার গ্রহণ, বিদেশে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ২০ নভেম্বর মেজর জেনারেল হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সামরিক বাহিনীর উপ-প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ, ১৯৭৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর ছিনতাইকৃত জাপানি বিমানের ঢাকা অবতরণ, ৩০শে ডিসেম্বর বগুড়ায় সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলযোগ, ঢাকা সেনানিবাসে সৈন্যদের মধ্যে গুলি বিনিময়। ঢাকা বিমানবন্দরে কর্তব্যরত অবস্থায় বিমানবাহিনীর ১১ জন অফিসার ও সেনাবাহিনীর ১০ সদস্য নিহত। ১১ অক্টোবর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৬০ জন নেতার সাথে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঘোষণা, ‘রাজনীতির ভিত্তি হতে হবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। ১৮ অক্টোবর বগুড়া ও ঢাকার ঘটনায় অভিযুক্ত ৪৬০ জনের বিচার সম্পন্ন। সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ৩৭ জনের মুত্যুদণ্ড কার্যকর, ২০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৩১ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চট্টগ্রাম শাখার সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন, ‘স্বাধীনতার শত্রুদের জনগণই দমন করবে’ ইত্যাদি ঘটনাবলীর স্মৃতি বাংলার প্রকৃতির মতো প্রতি বছরই ফিরে আসে শরৎ-হেমন্তের এই বাংলায়। আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে জিয়াউর রহমান কাদের এবং কীভাবে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার শত্রু বলতে তিনি কাদেরকে বোঝাতেন। একজন বাঙালির ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় জীবনের উন্নয়ন-কর্মকাণ্ডে উল্লিখিত এই সব তারিখ ও সময় দিক্ নির্দেশনা দিবে অগণিত কাল। আমরা যেন এসব ভুলে না যাই-এই কথাটি আমাদের বলতে। উল্লেখ্য, আরবি শব্দ ‘সন’ ও ‘তারিখ-কে ফার্সিতে বলা হয়, ‘সাল’। ‘তারিখ’-এর বহুবচন ‘তাওয়ারিখ’ যার এক অর্থ ইতিহাস। (বাংলাদেশের তারিখ, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান)।
বাঙালির নেত্রী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বসভা জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদানসহ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় প্রায় ১৭ দিনের সফর শেষে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরেছেন। জাতিসংঘে এবারও তিনি বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন, তিনি ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ এবং ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ নামের দু’টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভুষিত হয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বসভায় সম্মানের আসন এনে দিয়েছেন। এ ধরনের আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তি একজন সচেতন বাঙালি বিশেষ করে যারা প্রবাসে থাকেন তাদের কাছে কত বড় গর্ব ও অহংকারের বিষয় সেটি একজন সচেতন মানুষই কেবল বুঝতে পারেন। এমন একজন বাঙালিকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জানাতে না পারলে জাতি হিসেবে, এ দেশের নাগরিক হিসেবে দীনতাই কেবল প্রকাশ পায়। যানজটের কারণে ভোগান্তি - বর্তমান সময়ের একজন বিশ্বখ্যাত বাঙালিকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা আয়োজনের সাথে এটা তেমন কিছুই নয়। রাজনীতির মধ্যেকার সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে চিন্তা করতে পারলে বিষয়টা পরিষ্কারভাবেই ধরা পড়ে বিবেকবান মানুষদের কাছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর পেরিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সড়কের দু’পাশে লাখো মানুষের করতালি আর অভিবাদনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যখন গণভবনে পৌঁছলেন তখন সেখানে কোমলমতি শিশুসহ সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিক্ষাবিদগণ যেভাবে তাঁকে বরণ করে নিলেন, গণমাধ্যমের কল্যাণে সারা জাতি তা প্রত্যক্ষ করেছে। শরতে- হেমন্তে বাংলার এ যেন এক নতুন রূপ, নতুন প্রাপ্তি, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এক নতুন প্রেক্ষাপট-‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী, ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে, তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে’- রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গানে এবং নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ ও শামীম আরা নিপার নৃত্যের তালে বরণ করা হয় প্রধানমন্ত্রীকে। এই অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিজ দলের নেতাকর্মীসহ জনগণেরও অনেক কিছু শেখার আছে। কারণ, তাঁর দল ও সরকারের বিভিন্ন স্তরের লোকদের মধ্যে সঙ্কীর্ণতা এমনভাবে ঢুকে গেছে যে, নিজেদেরকে তারা বাঙালির চেয়ে মুসলমান পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে, বাংলা ভাষায় কথা বলে নিজেকে বাঙালি ভেবে গর্ববোধ না করা যে কত বড় হীনমন্যতা, তা এই দলের অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে এখনো প্রকট হয়ে আছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবোধে দেশকে, সমাজে গড়ে তোলা। একজন খাঁটি বাঙালিই হতে পারেন নিঃসন্দেহভাবে একজন খাঁটি মুসলিম।

প্রকৃতির নিয়মে শরতে-হেমন্তে বাংলা তথা বাংলাদেশ প্রতি বছরই নতুন করে জেগে উঠে, নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটে বাঙালির জীবনে। সামনে, ২১-২২ অক্টোবর, এই হেমন্তেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। স্মরণ করতে হয়, ১৯৫৫ সালের আওয়ামী-মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলটির অসাম্প্রদায়িক যাত্রা শুরু হয়েছিল বলেই এটি সত্যিকার অর্থে জনগণের দলে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানসহ বাঙালির সকল অর্জনের সাথে আওয়ামী লীগ তাই একাকার হয়ে আছে।’ ‘আওয়াম’ বা ‘আম’ শব্দের অর্থই যে সাধারণ মানুষ বা জনগণ। সাধারণ মানুষই এর জীবনীশক্তি। অথচ এটাও ঠিক যে, এই দলে সব সময়ই ষড়যন্ত্রকারী, বিশ্বাসঘাতক ও সুবিধাবাদীরা বড়সড় জায়গা দখলে রেখেছে এবং তাদের কারণে শুধু সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই নন, প্রাণ দিয়েছে আরও অনেকে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদেশের হাজার হাজার মানুষ, গোটা বাঙালি জাতি, বাধাগ্রস্ত হয়েছে স্বাধীনতার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন। এত কিছুর পরেও একথা আজ সর্বজনস্বীকৃত যে, দেশি-বিদেশি এইসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে রাষ্ট্র কার্যকর হয়েছে, অসংখ্য বিস্ময়কর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পাদনের মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যে দেশে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে, সাধারণ মানুষের (আওয়াম) স্বার্থকে সবার ওপরে গুরুত্ব দিয়ে এবং বাঙালি জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে স্বাধীনতার সোনালী ফসল ঘরে তোলার মধ্য দিয়ে যড়যন্ত্রকারীরা চূড়ান্তভাবে পরাস্ত হবে- সেটাই আজ দেখতে চায় জাতি।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন